রাতের নলেন, নোনা জিরেন, বাংলার গুড় আজও স্বপ্ন দেখায়...

Interview Jaggery Collector Bengal Heritage : পরবর্তী মুখ বলতে আর কেউ নেই এই পেশায়। তাছাড়া আমরাই তো ভবিষ্যত দেখতে পাই না মাঝে মাঝে ওদের কোন মুখে জোর করব!

শীত মানেই বাংলার বাড়িতে বাড়িতে নতুন গুড়। গুড়ের পায়েস, পিঠে-পুলি, মিষ্টি আর তার সঙ্গে হল আমলের নলেন গুড়ের আইসক্রিম, চা সহ আরও কত কি! শহরে শীত পড়তে না পড়তেই পারদ গুড়ের পারদ তুঙ্গে। ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে দেদার বিকোচ্ছে ‘নলেন গুড়’, ‘পাটালি’। অবশ্য এরই মাঝে আবার উঁকি দিচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরের গুড়ও। কিন্তু কোনটা খাঁটি আর কোনটা ভেজাল তার হদিশ মিলবে কীভাবে? কোন গুড়ে কতটা বালি মিশে তার হদিশ কীভাবেই বা করবে বাঙালি! ইনস্ক্রিপ্ট এগিয়েছিল সেই খোঁজেই। খুঁজতে গিয়েই আলাপ হয় তিনজন গুড় মক্কেলের সঙ্গে। শিউলি রমেশ মণ্ডল, যিনি বহু বছর ধরে গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করেন। সেইসঙ্গে ছিলেন 'বাংলাপণ' সংস্থার দুই উদ্যোক্তা সুমিত দাস এবং অনিতেশ চক্রবর্তী। ইনস্ক্রিপ্টের পক্ষ থেকে তাঁদের সঙ্গে কথোপকথনে সামিল হলেন অরিত্র সোম। সেখানেই মিলল খাঁটি গুড়ের গন্ধ। সামনে এল রাতের নলেনের মতো লুপ্তপ্রায় গুড় ও বাঙালির ঐতিহ্যও।

অরিত্র - কতদিন ধরে শিউলির পেশার সঙ্গে যুক্ত আপনি? আপনার পূর্বপুরুষরাও কি এই কাজই করতেন?

রমেশ মণ্ডল - আমি দশ বছর হল সরাসরি শিউলি পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। এর আগে বাবা-কাকাদের সঙ্গে থেকে কাজে হাত লাগাতাম। ছোটবেলায় বাবাকে, ঠাকুরদাকে দেখেছি বছরের এই সময়টা ভীষণ ব্যস্ততায় কাটত। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও একটু একটু করে জড়িয়ে পড়ি। টুকটাক যা পড়াশোনা করেছি তাই দিয়ে আগে কিছু টিউশনি পড়াতাম। তবে শিউলি হিসেবে কাজ করার প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। বাপ-ঠাকুরদাদের দেখেই সেটা এসেছে। যতই হোক,ওটাই তো আমাদের শিকড়, তার তো টান থাকবেই।

অরিত্র - শিউলিদের কাজ তো বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। শীতকালেই আপনারা এই কাজে নামেন। তারপর তো আর থাকে না। তখন কী করেন আপনি? কী করে সংসার চলে? 

রমেশ - যা সময় পড়েছে, তাতে কেবল শিউলি হয়ে সত্যিই আর সংসার চলে না। অন্য রোজগারের চেষ্টা করতেই হয়। মূলত চাষবাসই করি আর কি! আর এই শিউলি। গুড় তো মরশুমি ব্যবসা, বছরের অন্য সময় খাব কী? বাড়িতে বউ, এক ছেলে রয়েছে, ওদেরই বা কী খাওয়াব! তাই চাষই ভরসা। টিউশনিও পড়াতাম। গরীবের সংসার, কোনও মতে টেনেটুনে চলে যায় আর কি!

অরিত্র - রাতের নলেন তো বিশেষ একরকমের গুড়। তার ঐতিহ্য আছে, ইতিহাস আছে। বাংলার সঙ্গে নিবিড় যোগ। এখন রাতের নলেন তো কেউ করতে চান না। আপনি কেন এই নলেন নিয়ে কাজ করছেন?

রমেশ - দেখুন সব কিছুরই তো একটা সেরা ব্যাপার থাকে! সেরকম গুড়ের সেরা হল রাতের নলেন। আজকাল অবশ্য অনেকেই এই নাম শুনলে অবাক হবেন। কিন্তু নলেনের আসল স্বাদ ওই রাতেই। মাঝে একেবারেই হারিয়ে গিয়েছিল এটি। তাছাড়া এই গুড় তৈরি করা অনেক পরিশ্রমের কাজ। সেই খাটনির ঠিক মতো দাম না পেলে পুরোটাই ক্ষতি। তার ওপর বাজারে তো এখন সব সস্তার জিনিসে ভরে গিয়েছে। তবে এই বছর অবশ্য পরিস্থিতির কিছুটা বদল ঘটেছে। 'বাংলাপণ' নামে এক সংস্থার নাম শুনি। তারপর তাঁদের সঙ্গে আলাপ হয়। সেখানেই সুমিতবাবু আবার সাহস জোগান। আশ্বাস দেন, পরিশ্রমের উপযুক্ত পারিশ্রমিক জুটবে। তারপর থেকেই কোমর বেঁধে নেমে পড়ি রাতের নলেনের খোঁজে। আগে অবশ্য আমরাও খাঁটি রাতের নলেন দিতে পারতাম না ক্রেতাদের। কী করেই বা দেব, দাম পেতাম না যে! বাধ্য হয়ে এমনি গুড়ের ওপরে রাতের নলেনের প্রলেপ দিয়ে বিক্রি করতে হতো। কিন্তু এই বছর আমরা যেটা করছি তা একেবারেই খাঁটি রাতের নলেন। এ গুড়ের স্বাদই আলাদা।

অরিত্র - তাহলে তো এখন খুবই পরিশ্রম যাচ্ছে আপনাদের!

রমেশ - হ্যাঁ, সে যাচ্ছে বৈকি... 

অরিত্র - আচ্ছা এই যে সেরা গুড়ের কথা বললেন আপনি। রাতের নলেন তৈরি করতে বিস্তর খাটনি। কীভাবে তৈরি করেন এই গুড়? যদি একটু বিস্তারিতভাবে বলেন...

রমেশ - দেখুন, ভালো গুড় পেতে গেলে তো পরিশ্রম করতেই হবে। রাতের নলেন, নাম শুনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন রাত ছাড়া এই গুড় মেলে না। সূর্যের আলো লাগলেই এর স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। তাই রাত থাকতে থাকতেই হাঁড়ি বাঁধা, হাঁড়ি নামানো দুইই করতে হয়। শীতের ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতে গুড় নামিয়ে জাল দিতে হয়। শিশির ভেজা দিন হলে তবেই মেলে খাঁটি রাতের নলেন। এই গুড় জাল দেওয়ারও আবার পদ্ধতি আছে। ধৈর্য্য ধরে সঠিক আঁচে সমানে রসটি নাড়তে হয়। জাল দিতে দিতে যখন মধুর মতো হয়ে যায় তখন হাঁড়ি নামাতে হয় উনুন থেকে। একটু ঠাণ্ডা হলে কাঠি দিয়ে নেড়ে নিলে তবে প্রস্তুত হয় রাতের নলেন। তবে, গাছের কাঠ কতটা শুকিয়েছে তার ওপরই কিন্তু নির্ভর করে আসল নলেনের স্বাদ।

অরিত্র - রাতের নলেনের একটা ইতিহাস আছে। এর স্বাদও অন্যরকম। রাতের নলেন এমনি কতটা আলাদা? এর বিশেষত্ব ঠিক কী?

রমেশ - আলাদা তো বটেই। অন্য যে কোনও গুড়ের থেকে স্বাদে-গন্ধে-চেহারায়, সবেতেই আলাদা। আর বিশেষত্ব হল ওই গাছ চেনা আর গুড় সংগ্রহ এটুকুই। খাঁটি নলেনের কাজ শুরু হয়ে যায় সেই আশ্বিন কার্তিক মাস থেকেই। দেখুন ভালো গুড়ের স্বাদ কিন্তু নির্ভর করে গছের কাঠের ওপরই। তাই আসল কাজ হল কাঠ চেনা। এই যেমন বাজারের অনেক গুড়ের মধ্যে থেকে ক্রেতাদের আসল গুড় চিনতে হয় তেমনই আমাদের চিনতে হয় খাঁটি গাছ। তারপর সেই গাছের ডাল প্রথমে ঝুরে মসৃণভাবে চাঁচতে হয়। তারপর তার চোখ কেটে নল দিতে হয়। তবে প্রথম যে গুড়টা পাওয়া যায় তা কিন্তু স্বাদে একটু নোনতা হয়, তবে গন্ধে একেবারে খাঁটি মেজাজ। আর এর ঠিক পরে গাছ শুকিয়ে এলে তার থেকে পাওয়া যায় রাতের নলেন। তবে সবই নির্ভর করে ওই সঠিক নির্বাচনের ওপর, কোন গাছ কতটা শুকোলে ভালো গুড় পাওয়া যাবে সেটার ওপরই নির্ভর করে স্বাদ।

অরিত্র - আচ্ছা রমেশবাবু, রাতের নলেন পেতে গেলে গাছের কি আলাদা যত্ন নিতে হয়?

রমেশ - দেখুন আমরা যারা শিউলি তাদের তো খেজুর গাছই সব, তাই গাছের কীসে কষ্ট হয় সেটা দেখার দায়িত্বও আমাদেরই। সে কারণেই ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি অবধিই চলে এই গুড় সংগ্রহ। এরপর আর গাছ কাটা হয় না, তাতে ক্ষতি হয় গাছের। এছাড়া খেঁজুর গাছ তো আলাদা করে চাষ করার কিছু নেই, তবে গাছ বাঁচানোর জন্য কোনও রাসায়নিক ব্যবহার করি না আমরা। স্বাভাবিক নিয়মেই বেড়ে ওঠে গাছ। চাষের জমি লাগোয়া গাছগুলোকে আল দিয়ে ঘিরে রাখা হয় যাতে ক্ষতি না হয় গাছের। কেবল লক্ষ্য রাখতে হয় যদি কোনও পোকা লাগে তবে সঙ্গে সঙ্গে তা বের করে দিতে হয় নচেৎ ক্ষতি হতে পারে গাছের। পরিমিত সূর্যের আলো পেলেই রসে ভরে ওঠে গাছ। স্বাদও হয় দারুণ।

অরিত্র - আপনারা তো এই পেশাকে ভালোবাসেন। গাছকেও ভালোবাসেন। এর ভবিষ্যৎ কী দেখছেন? আগামী প্রজন্ম কি তৈরি শিউলিদের ধারা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য?

রমেশ - দেখুন আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে আজকের প্রজন্মের বেড়ে ওঠার অনেক তফাৎ। এখন সবাই ছুটছে। ওদের অত সময় কোথায়! তাছাড়া বাবা কাকারা সারাজীবন কষ্ট করে কতোই বা রোজগার করতে পেরেছে যে তারা এই কাজে এগিয়ে আসার সাহস পাবে! ওরা তো আজকাল মাঠেই যায় না, এত পরিশ্রম করবে কী করে বলুন!আমার ভাইপো ছাড়া গোটা গ্রামে পরবর্তী মুখ বলতে আর কেউ নেই এই পেশায়। তাছাড়া আমরাই তো ভবিষ্যত দেখতে পাই না মাঝে মাঝে ওদের কোন মুখে জোর করব! তবে আমার বিশ্বাস যদি পরিশ্রমের প্রকৃত পারিশ্রমিক মেলে, যদি ওদের মধ্যে এই বিশ্বাস তৈরি করা যায় যে এই কাজেরও ভবিষ্যত আছে, তবে এ কাজ থেকে মুখ ফেরাতে পারবে না আগামী প্রজন্ম। আবারও শিকড়ের কাছেই ফিরবে তারা। আর বাংলার ঐতিহ্যকে, খাঁটি স্বাদকে ধরে রাখতে গেলে সেটুকুর বড্ড প্রয়োজন।

অরিত্র - আচ্ছা, এই যে বাংলার গুড়ের ঐতিহ্য, যা নিয়ে মূলত তোমাদের কাজ, সেখানে শিউলিদের ভবিষ্যতকে কীভাবে দেখছ তোমরা? কীভাবে শুরু হল বাংলাপণ? গল্পটা বলো...

অনিতেশ চক্রবর্তী - দেখো, শিউলিদের নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনেক আগেই লিখে গিয়েছেন। তারপর সময়ের প্রবাহে সেই চিত্রটা আরও এগিয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় এখনও শিউলিরা ক্ষেতমজুর। বছরের একটা মাত্র সময়ে কেবল চিকচিক করে ওঠে চোখ, বাকিটা সময় অন্ধকার। বাজারে খাঁটি গুড়ের কদর করার লোক যত কমেছে শিউলিরা ততই প্রান্তিক হয়েছেন। আর ঠিক এই জায়গা থেকেই জার্নি শুরু বাংলাপণের। মানুষের কাছে খাঁটি গুড় পৌঁছে দেওয়া এবং একজন শিউলিকে সঠিক পারিশ্রমিক বুঝিয়ে দেওয়া এটুকুই লক্ষ্য।

অরিত্র - আচ্ছা হঠাৎ কেন গুড় নিয়ে কাজ করার কথাই মনে হল তো তোমাদের? কীভাবে পথ চলছে বাংলাপণ? ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছ?

অনিতেশ - গুড় হল বাংলার ঐতিহ্য। গুড় থেকেই এসেছে গৌড় শব্দটি। বাংলার ঐতিহ্য মানে ঠিক কী? সেখানে তুর্কি বিজয়, মঙ্গলকাব্য, বাউল, ফকির, সহজিয়া অথবা চৈতন্যদেব ঠিক যেভাবে এসেছেন ঠিক সেভাবেই আসে বাংলার গুড়ও। খাঁটি গুড়। একসময় পর্তুগিজরা এই গুড় নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি দিত, বাংলার সওদাগরের নৌকা গুড় নিয়ে যেত। বহু সাহিত্যে রয়েছে নলেন গুড়ের প্রশস্তি। বাংলার পাটালিকে বলা হত ‘নব বার্তা’, যা জীবনের বার্তা নিয়ে আসে। শীত শুষ্ক ঋতু, অথচ সেই সময় একটা গাছের বুকে রস আসছে। কী অদ্ভুত না! এহেন বাংলার বিখ্যাত গুড় পাওয়া যেত কুষ্টিয়া, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং দক্ষিণবঙ্গের বহড়ুতে। শোনা যায়, সেই সময় বাংলার গুড় খেয়ে স্বাদে মুগ্ধ হয়ে খোদ রানি ভিক্টোরিয়া এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সেই থেকে ওই বিশেষ গুড়ের নাম হয় ‘হাজারি গুড়’। বিখ্যাত বিখ্যাত সব গুড়ের গল্প ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমাদের এই বাংলায়। বাঙালি তো ছানার মিষ্টির স্বাদ পেয়েছে অনেক পরে, আগে গুড়ের পিঠেপুলির স্বাদই ছিল বাংলার একচেটিয়া। পুরাণেও রয়েছে গুড়ের প্রসঙ্গ। দেখা যাচ্ছে, দেবী পার্বতী শিবকে তুষ্ট করার জন্য গুড় পাক করছেন।

এই যে গুড়, এ যেন বাংলার এক অনন্য স্বাদ। অথচ এই রসায়ন ঘেঁটে গেল দেশভাগের পর থেকে। শিউলিরা হলেন ছিন্নমূল। অন্যদিকে গুড়ের বাজারে ঢুকে পড়ল চিনি। সস্তার চিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে লাগল গুড়। মানুষও সস্তায় বিকল্প ভেবে মুখ ফেরাতে লাগলেন। আর তার জেরেই টিকে থাকার লড়াইয়ে খাঁটি গুড়ে এসে পড়ল ভেজাল সংস্কৃতি। নাহলে প্রতিযোগিতার বাজারে চিনির সঙ্গে এঁটে ওঠা তো তখন রীতিমত দুষ্কর। ব্যাস এভাবেই লোপাট হতে শুরু করল খাঁটি গুড়ের স্বাদের স্মৃতি। বাংলাপণের জার্নি শুরু ঠিক এখান থেকেই। বর্তমান প্রজন্মকে খাঁটি গুড়ের স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে খাঁটি গুড়ের স্বাদ পেয়েছেন আমরা তা পাইনি, তাই আমাদের গুড় চিনতে গেলে সবার আগে সেই স্মৃতিকে চেনা প্রয়োজন। আর সেখান থেকেই শিউলিদের পাশে থাকা। যাতে তাঁরাও সাহস পান ১০০ শতাংশ খাঁটি খেঁজুরের গুড় প্রস্তুত করার। আগে যে মূল্য পেতেন তার প্রায় তিনগুণ পারিশ্রমিক এখন পাচ্ছেন তাঁরা। ফলে বাঙালিও নতুন করে খাঁটি গুড়ের স্বাদ চিনতে পারছে।

অরিত্র - আচ্ছা খাঁটি গুড় বলতে ঠিক কী? কোন কোন গুড়ের স্মৃতি নতুন করে ফিরে পাচ্ছে বাঙালি?

অনিতেশ - খাঁটি গুড়ের পরিচয় তার স্বাদেই। কেবল কয়েকটা কথায়, কয়েকটা বিশেষণে এর ব্যাখ্যা অসম্ভব। তবে গুড়ের সেরা হল রাতের নলেন। বিলুপ্তির পথে যে গুড়, সেই গুড় ফিরে এল আবার। তার সঙ্গেই এল গাছের প্রথম নলেনের স্বাদ, গাছকে দ্বিতীয়বার কাটার পর এল দোকাট্টা গুড়। জিড়েন গুড়েরও তিনটে প্রকারভেদ আনা হল এবছর। সুন্দরবনের নোনা জিরেন তার মধ্যে একেবারেই অন্য স্বাদের। এছাড়াও এল শুকনো ঝুরা নলেন এবং আনন্দ গুড়। নতুন নতুন স্বাদ চিনল বাংলা। আর শিউলিরাও ঘুরে দাঁড়ালেন। নতুন করে কাজের উদ্যম পেলেন।

অরিত্র - এই যে রাতের নলেন, এর তো একটা বিশেষত্ব আছে। একটা আলাদা চরিত্র আছে। প্রতিটা আলাদা, ইউনিক জিনিসেরই বিশেষ মার্কেট ভ্যালু আছে। মুড়ি আর মিছরির আলাদা দর। বাজার কি এই গুড়ের দাম দিতে প্রস্তুত? তোমরা কী করে মানুষের কাছে বিষয়টিকে নিয়ে যাচ্ছ?

অনিতেশ - অবশ্যই দাম দিতে প্রস্তুত। সঠিক স্বাদের স্মৃতি ফিরিয়ে দিতে পারলে যে বাংলার ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব সেটা করে দেখিয়েছেন বাংলার শিউলিরাই। গোটা দেশে ইতিমধ্যেই প্রায় চার টন গুড় বিক্রি হয়ে গিয়েছে, আরও তিন টন বিক্রির পথে। আর ওই যে বললেন মুড়ি আর মিছরির দর আলাদা, স্বাদই তো তার প্রমাণ। একবার খাঁটি গুড় মুখে দিলেই তো হিসেব স্পষ্ট।

অরিত্র - রাতের নলেনের একটা আলাদা জায়গা আছে। আর্কাইভাল ভ্যালু আছে। একটা ঐতিহ্য আছে। এবার এই ব্যাপারটি যখনই জনপ্রিয়তার জায়গায় চলে আসবে, তখনই সামনে আসবে কর্পোরেটরা। তারা তো এই ব্যাপারটি নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। শিউলিরা গাছকে ভালোবাসেন। কর্পোরেট এলে কি সেই ব্যাপারটা থাকবে?

সুমিত দাস - দেখো স্পষ্ট কথায় বলতে গেলে কর্পোরেট তখনই ঢুকবে যখন দেখবে এখানে ব্যবসা আছে। আমরা এমন একটা সময় দাঁড়িয়ে আছি যখন বাজারে চাকরি-বাকরি নেই, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাও ঘরে বসে। ফলে বাংলার নিজস্ব ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার কাজে তারা যদি নতুন করে উদ্যোগ নেয় তবে তো ক্ষতির কিছুই নেই বরং খাঁটি নলেনের স্বাদ ফিরবে এবং শিউলিরাও ফিরবেন পরিচিত আলোকে। তাই কতটা কর্পোরেট ঢুকল সেটা বড় নয়। একটু স্বপ্ন তো দেখতেই হবে। আগামীতে গুড়ের ঐতিহ্য ফিরে আসুক এটাই আসল কথা। আর আধুনিকতার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যে অভ্যাস আমরা হারিয়ে ফেলেছি সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এখানে জানিয়ে রাখি, খেজুরের গুড় এমনই একটি জিনিস যা মাটির হাঁড়িতে সারা বছর সঞ্চয় করে রাখা যায়, বর্তমানে সেই প্রথা বিলুপ্তির পথে, তবে আমরা শিউলিদের হাত ধরে সেই দিকেই এগোতে চাইছি যাতে খাঁটি নলেনের স্বাদ বাঙালির জিভে বছরভর লেগে থাকে। মানুষের অভ্যাস যদি টিকে থাকে, যদি খাঁটি গুড়ের স্বাদ বাঙালিকে আকৃষ্ট করে তবে আর্কাইভাল ভ্যালুও থাকবে।

অরিত্র - কিন্তু কর্পোরেট ঢুকে পড়া মানেই তো যোগানের ওপর চাপ বৃদ্ধি। এতে করে কি গাছের ক্ষতি হবে না?

সুমিত - কর্পোরেট যদি যোগান বেশি চায় তবে তো তারা গাছ কাটার পাশাপাশি নতুন গাছ লাগানোর দিকেও নজর দেবে। এবার মানুষ যদি দেখে খেজুর গাছের থেকে অন্য চাষে লাভ বেশি তবে তো সেই দিকেই ঝুঁকবে। ঠিক যে কারণে আজ বিলুপ্তির পথে এই গুড় শিল্প। সুতরাং কর্পোরেটের হাত ধরে যদি খেঁজুরের গুড়ের যোগান বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয় তবে তো সার্বিক লাভ গুড় শিল্পেরই। মানুষ দেখবে এই কাজেও পয়সা আছে, ফলে আগ্রহী হবে। শিউলিদের ভবিষ্যত প্রজন্মের যে অনীহা সেটাও দূর করা যাবে।

অরিত্র - কিন্তু যদি এভাবেই আবার ঢুকে পড়ে ভেজাল? রাতের নলেনের নামের ভ্যালুকে কাজে লাগিয়ে খাঁটি গুড়ের পরিবর্তে যদি ভেজাল দেওয়া হয়, সেটা কীভাবে রোখা সম্ভব?

সুমিত - দেখো ভেজাল এমন একটা জিনিস সেটা যে কোনওভাবে আসতে পারে। ব্যবসা বিষয়টাই খুব দ্বিমুখী একটা প্রক্রিয়া। তাই ভেজালের দায় কেবল উৎপাদকের নয়। বাজারে যদি সস্তার বিকল্প খোঁজাই লক্ষ্য হয় তবে তো ভেজাল মিশবেই। নাহলে শিউলিরাই বা খাবেন কী! কিন্তু যদি শিউলিদের একবার আমরা সেই স্বপ্নটা ফিরিয়ে দিতে পারি যেখানে তাঁরাও দেখবেন যে, এই পেশায় থেকেও স্বচ্ছলভাবে সংসার চালানো যায় তবেই তো সাহস করে পরবর্তী প্রজন্মও হাঁড়ি বাঁধতে গাছে উঠবে।

এই দায়টাই তো আসল। খাঁটি গুড় চেনানোর দায়। শিউলিদের পরিশ্রম চেনানোর দায়। গ্রামীণ অর্থনীতির বুকে শিউলি পেশাকে পাকাপাকি একটা জায়গা করে দেওয়ার দায়। এইটুকুই স্বপ্ন ছিল আমাদের। কিছুটা পথ এগিয়েছি মাত্র, আরও অনেকটা পথ চলা বাকি। আজকের শিউলির সন্তানদের হাতে একটা ভরপুর সম্ভাবনা তুলে দেওয়ার সফরেই তো ফিরবে বাংলার হারিয়ে যাওয়া গুড় সংস্কৃতি।

More Articles