ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ইরান! কেন দুই দেশের সর্ম্পকের অবনতি হলো?

Iran-Israel War: এমনকি ১৯৪৮ সালে যখন ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, তখন তুরস্কের পর ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশ ইরান। দুই দেশের মধ্যে গড়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক।

সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক ঘাঁটিতে ইজরায়েল হামলা চালায়। এর পাল্টা জবাব দিতে ইজরায়েলেও ইরানে হামলা করে। এর মধ্যে দিয়েই ইরান-ইজরায়েলের এবারের সংঘাতের শুরু হয়। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইজরায়েলের হামলায় এখনও পর্যন্ত ২২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে ইজরায়েল বলছে, ইরানের হামলায় দেশটির ২৪ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। এখন পরস্পরের শত্রু হলেও, একদা ইরান এবং ইজরায়েল ছিল বন্ধু-রাষ্ট্রো। এমনকি ১৯৪৮ সালে যখন ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়, তখন তুরস্কের পর ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া দ্বিতীয় মুসলিম দেশ ইরান। দুই দেশের মধ্যে গড়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক। শুধু তাই নয়, ১৯৫৭ সালে যখন ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘সাভাক’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এতে সহায়তা করেছিল ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। কেন দুই দেশের সর্ম্পকের অবনতি হলো?

ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন

ইরানের সরকার ইজরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখলেও ইরান ভেতরে ভেতরে আগে থেকেই ইজরায়েল বিরোধি। ইরানের শাহ শাসন বিরোধী বামপন্থীদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের নেতা ইয়াসির আরাফাতের যোগাযোগ ছিল। আবার আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং তাঁর অনুসারীরাও ছিলেন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার বিরোধি।

ইরানে ইসলামি বিপ্লবে

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পরই মূলত ইরান-ইজরায়েল সম্পর্ক খারাপ হয়। এরপর ইরানের বিপ্লবী সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনিদের পক্ষ নেওয়ার ঘোষণা করে এবং তেহরানে ইজরায়েলের দূতাবাসকে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে পরিণত করে। তখনই ইরান ইজরায়েলের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

মূলত নতুন ইরান সরকারের ইজরায়েল নীতি পরিবর্তন হওয়ার কারণেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হওয়া শুরু করে। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান সরকার আমেরিকা এবং ইজরায়েলকে তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো। অন্য আরব দেশগুলি ইজরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রের মধ্যস্থতার বিষয়ে একমত হলেও ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি একমত হননি। ইজরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন।

ইরানের সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়া

দু'দেশের সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পেছনে মূল কারণ দুটো। প্রথমত, ইরানের মিসাইল তৈরির চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, পরমাণু প্রকল্প গ্রহণ। ইরানের এমন উত্থানকে ইজরায়েল হুমকি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। তারা ইরানের সামরিকভাবে শক্তিশালী হওয়া বিভিন্ন ক্ষেত্র, বিশেষত পরমাণু প্রকল্প ভেস্তে দিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। যা দু'দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ করে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তার

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান তার প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়। লেবাননে ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তায় গড়ে ওঠে হেজবুল্লাহ। এতে ইরান এবং ইজরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়ে।ইরান আগে থেকেই ইজরায়েলের সম্ভাব্য সামরিক হামলা মোকাবিলার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের শক্তিশালী করেছিল। ইজরায়েলের পার্শ্ববর্তী দেশ লেবানন এবং সিরিয়ায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী তৈরি করেছে তেহরান।

গাজায় অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তা

হামাসের প্রধান সহায়তাকারী হচ্ছে ইরান।ইজরায়েল হামাস যুদ্ধে অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন এই যুদ্ধ হয়তো শেষ পর্যন্ত ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। গাজায় অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তাও দেয় ইরান। অতীতে ইজরায়েল লেবানন কিংবা সিরিয়ায় হামলা করলেও সেটি ইরান-ইজেরায়েল যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করেনি। তবে ইজরায়েল-হামাসের সাম্প্রতিক যুদ্ধে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছিল।

গত বছর, এপ্রিল ও অক্টোবরে ইরান ও ইজরায়েল পরস্পরের বিরুদ্ধে একাধিক হামলা চালিয়েছিল— যদিও তখন ইজরায়েলের হামলা এখনকার মতো ভয়াবহ ছিল না। ইরান-ইজরায়েলের সংঘর্ষ শুরু হয় এমন সময় যখন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চেয়েছিলেন তেহরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখতে একটি চুক্তি করতে, কিন্তু সম্প্রতি সংঘাত বেড়ে যাওয়ায় সর্বশেষ আলোচনাপর্ব বাতিল হয়।

উল্লেখ্য, ইজরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার প্রথমদিনেই ইরানে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীরা নিহত হন। এধরণের হামলা এটিই প্রথম নয়। ইজরায়েল এর আগেও লেবানন কিংবা সিরিয়ায় ইরানের সন্দেহজনক ঘাঁটিগুলিতে হামলা করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান হয়তো সেটি নিজের উপর হামলা বলে মনে করেনি বলে সংঘষে যায়নি। আবার ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষে প্রশ্ন উঠেছিল, ইজরায়েল-হামাস চলমান যুদ্ধে ইরান সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারে কিনা? বিশেষজ্ঞরা তখন বলেছিলেন, ইরানের ভেতরেও বিভিন্ন শক্তিশালী বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী গোষ্ঠী সক্রিয় আছে। ইরান বাইরের যুদ্ধে জড়ালে বিদ্রোহীরা সেই সুযোগ নেবে। এছাড়া ইরানের ভেতরে সরকার বিরোধী বিক্ষাভও আছে। মাশা আমিনির মৃত্যুর পরে যে বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতি হয়েছিলো, সেটা ইরানের সরকারকে যথেষ্ট টালমাটাল করে ফেলেছিলো। সুতরাং সেখানকার সরকার বাইরের বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে ভেতর থেকে অস্তিত্বের সংকটে পড়তে চাইবে না। অন্যদিকে আবার অনেকের মত ছিল, ইরান ইজরায়েলের ভূখণ্ডে সরাসরি আঘাত হানতে সক্ষম। এটা সে দু'ভাবে করতে পারে- হেজবুল্লাহ’র মিলিশিয়া বাহিনী দিয়ে সরাসরি আক্রমণ কিংবা উচ্চপ্রযুক্তির মিসাইল হামলার মাধ্যমে। এখন মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশের চলমান যুদ্ধে যে কোনো ভুল পদক্ষেপ পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে দিতে পারে। শঙ্কাটা এখানেই।

More Articles