মাওবাদী দমনের একমাত্র পথ কি এনকাউন্টার?

Maoist encounter: অতীতে বাস্তারে একাধিক এনকাউন্টার ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে। গত ২৫ বছরে বাস্তারে যে হাজার হাজার এনকাউন্টার হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র দু'টি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হয়েছে।

'অপারেশন কাগার'-এর 'সাফল্য' হিসেবে সিপিআই-এর (মাওবাদী) সাধারণ সম্পাদক ও সুপ্রিম কমান্ডার নাম্বালা কেশব রাও ওরফে বাসভরাজু সহ ৩০ জনেরও বেশি মাওবাদীর নিহত হওয়ার খবর প্রকাশ করেছে নিরাপত্তাবাহিনী। ছত্তিশগড়ের নারায়ণপুর জেলার ঘন আবুঝামাদ জঙ্গলে দেশের সবচেয়ে 'ওয়ান্টেড' মাওবাদী নেতা বাসভরাজু, যাঁর মাথার দাম ১.৫ কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল, তাঁকে নিকেশ করা সাম্প্রতিক ইতিহাসে মাওবাদী বিদ্রোহ দমনের অন্যতম বড় ঘটনা নিঃসন্দেহে। বাসভরাজুকে এনকাউন্টার করা হয়েছে। মাওবাদীদের ক্ষেত্রে শব্দটি নতুন নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এমন শীর্ষ স্থানীয় মাও নেতাদের জীবিত গ্রেফতার করে কেন সরাসরি বিচারের আওতায় আনা হয় না? এনকাউন্টারই কি একমাত্র পথ?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ছত্তিশগড়ের জঙ্গলে নিরাপত্তারক্ষী এবং মাওবাদীদের সংঘর্ষে নিহতদের সংখ্যা ছাড়া মাওবাদীদের হতাহতের খবর গণমাধ্যম খুব কমই প্রকাশ করে। অনেক বিশ্লেষক এও মনে করেন যে, প্রকাশিত সংবাদ থেকে এমন মনে হওয়াও অস্বাভাবিক নয় যে মাওবাদীদের কেবল মৃত্যুই হয়; তারা আহত হয় না, বা আত্মসমর্পণ করে না বা অভিযানে ধরা পড়ে না।

ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে, মাওবাদীদের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কিন্তু বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়েছে এনকাউন্টারে। তাঁদের কোনওভাবেই জীবিত অবস্থায় ধরে বিচারের প্রক্রিয়ায় আনা হয়নি। মনে করা যাক কিষেণজির কথা। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় নিরাপত্তা বাহিনী ৫৫ বছরের শীর্ষ মাওবাদী নেতা মল্লোজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজিকে হত্যা করে। কিষেণজি জামবনি এসেছিলেন নিহত মাওবাদী রাজ্য কমিটির সদস্য শশধর মাহাতোর স্ত্রী সুচিত্রা মাহাতো, ঝাড়খণ্ডের মাওবাদী স্কোয়াড নেতা সিপাই ওরফে রমেশ এবং বিনপুরে সক্রিয় বিরশা ওরফে হিরোর মতো শীর্ষ মাওবাদী কমরেডদের সঙ্গে বৈঠক করতে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে, যৌথ বাহিনী বুড়িশোল বনের ভেতরে এবং আশেপাশে অভিযান শুরু করে এবং ত্রিস্তরীয় ১,০০০ সদস্যের নিরাপত্তা বলয় দিয়ে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। ঘন জঙ্গলে ৩০ মিনিটের প্রবল বন্দুকযুদ্ধের পর কিষেণজির মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন- মাথার দাম ৪০ লক্ষ! মাওবাদী কমান্ডার হিডমার নাগাল পেতে কেন মরিয়া নিরাপত্তাবাহিনী?

২০০৭ সালের জুন মাস। সিপিআই-এর (মাওবাদী) সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সান্ডে রাজামৌলি, যিনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন. চন্দ্রবাবু নাইডুকে হত্যার পরিকল্পনায় প্রায় সফল হয়েছিলেন, পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ৪৭ বছর বয়সি এই নকশাল নেতার বিরুদ্ধে ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ওড়িশায় ১২০টি মামলা ছিল। আরও সাতটি রাজ্যে 'ওয়ান্টেড' তালিকায় ছিলেন তিনি। তাঁর মাথার দাম ধার্য হয়েছিল ১৬ লক্ষ টাকা।

২০০৯ সালের মে মাস। জঙ্গলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে সিপিআই (মাওবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্যাটেল সুধাকর রেড্ডি এবং রাজ্য কমিটির সদস্য ভেঙ্কটাইয়া নিহত হন। সুধাকর রেড্ডির মাথার দাম ছিল ১২ লক্ষ টাকা। ২০০৩ সালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইডু এবং ২০০৭ সালে এন জনার্দন রেড্ডির হত্যার চেষ্টার অভিযোগ ছিল এবং ২০০০ সালে প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ মাধব রেড্ডির হত্যার মতো বেশ কয়েকটি মামলায় 'ওয়ান্টেড' ছিলেন সুধাকর রেড্ডি।

২০১০ সালের জুলাই। বন্দুকযুদ্ধে চেরুকুরি রাজকুমার ওরফে আজাদ নিহত হন। মাওবাদীদের মুখপাত্র আজাদের মাথার দাম ছিল ১.২ মিলিয়ন টাকা। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি-মাওবাদীর (সিপিআই-মাওবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আজাদ ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাওবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সাম্প্রতিক, ছত্তিশগড়ের নারায়ণপুর জেলায় এক সংঘর্ষে সিপিআই (মাওবাদী) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নাম্বালা কেশব রাও ওরফে বাসভরাজুর (৭০) মৃত্যুও এনকাউন্টারে। দলের মুখপত্র 'জঙ্গ' পত্রিকার সম্পাদক নবীনসহ প্রায় ২৬ জনকে হত্যা করেছে নিরাপত্তাবাহিনী।

সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, "২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছত্তিশগড়ে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এক বছরের মধ্যে ৩৮০ জন মাওবাদী নিহত হয়েছেন।" এখানেই প্রশ্ন তুলেছে তেলঙ্গানার সিভিল লিবার্টিজ কমিটির মতো একাধিক মানবাধিকার গোষ্ঠীর কর্মীরা। কেন মাওবাদী নেতাদের ধরে বিচারপ্রক্রিয়ায় আনা হয় না। যেখানে আজমল কাসভের মতো সন্ত্রাসবাদীরও বিচার হয়েছে, সেখানে কেন মাওবাদী নেতাদের জন্য এই সুযোগ নেই? বিচারবিভাগীয় তদন্ত না করে কেন রাষ্ট্র নিজে থেকে একজন মাওবাদীকে নিকেশ করছে। একে কি বিচারবহির্ভূত হত্যা বলা যায়?

পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজের (পিইউসিএল) মতো মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলির অভিযোগ, মাওবাদীদের নির্মূল করার অজুহাতে বৃহৎ পরিসরে সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে। ২০২৪ সাল থেকে, বাস্তারে হিংসা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সামরিকীকরণ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুয়ো এনকাউন্টারে আসলে নিরীহ আদিবাসীদের হত্যা করা হচ্ছে। গত দেড় বছরে পিইউসিএল কমপক্ষে ১১টি ঘটনাকে ভুয়ো এনকাউন্টার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যেমন, গত ২৫ মার্চ পুলিশ দাবি করেছিল যে বাস্তার থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার পূর্বে বিজাপুরের বোর্দগা গ্রামে মাওবাদী বিদ্রোহী সুধাকর ওরফে সুধীর, পান্ড্রু আত্রা এবং মান্নু বর্ষাকে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পুলিশের বক্তব্য মিথ্যা। গ্রামবাসীদের দাবি, পুলিশ রাতে গ্রামটি ঘিরে ফেলে, ১৭ জনকে ধরে নিয়ে যায়, সাতজনকে ছেড়ে দেয়, তিনজনকে গুলি করে এবং বাকি সাতজনকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যায়।

অতীতে বাস্তারে একাধিক এনকাউন্টার ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়েছে। গত ২৫ বছরে বাস্তারে যে হাজার হাজার এনকাউন্টার হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র দু'টি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মুখোমুখি হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে আল জাজিরার এক প্রতিবেদন থেকে।

নিরাপত্তাবাহিনী দাবি করেছিল, গত ৩১ মার্চ এনকাউন্টারে নিহতদের মধ্যে ছিলেন দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটির সদস্য গুম্মাদভেলি রেণুকা। মাওবাদীরা দাবি করেন, রেণুকা ওরফে ভানু বা চৈতে কোনও এনকাউন্টারে নিহত হননি। শরীর অসুস্থ থাকায় বিজাপুর জেলার ভৈরমগড় ব্লকের একটি বাড়িতে একা বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মাওবাদীদের অভিযোগ, পুলিশ ভোর ৪টায় বাড়িটি ঘিরে ফেলে, রেণুকাকে গ্রেফতার করে এবং পরে ইন্দ্রাবতী নদীর ধারে তাঁকে হত্যা করে।

বাস্তারের সমাজকর্মীদের অনেকে বলছেন, বিপুল সংখ্যক মানুষকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং অনেক দিন ধরে পুলিশ হেফাজতে রাখা হচ্ছে। এদের পরিবারের সদস্যরা জানেনই না যে তারা মৃত না জীবিত। মাওবাদী বলে নাবালক সহ নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যার অভিযোগ আছে নিরাপত্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি ঘটেছিল ২০১৩ সালের মে মাসে। প্রায় ১,০০০ নিরাপত্তা কর্মী এডসামেটা গ্রামে বীজ পান্ডুম উৎসব উদযাপনকারী আদিবাসীদের উপর গুলি চালায়, আটজনকে হত্যা করে। পরে পুলিশ দাবি করে যে তারা মাওবাদী। তবে, একজন অবসরপ্রাপ্ত হাইকোর্টের বিচারকের তদন্তে বলা হয় যে এই সংঘর্ষে নিহতদের কেউই মাওবাদী ছিলেন না।

আরও পড়ুন- বিপ্লবী ছাত্র থেকে সশস্ত্র মাওবাদী কমান্ডো! কেন কেশব রাওয়ের মৃত্যু মাওবাদীদের জন্যে বড় ধাক্কা?

২০১০ সালের মার্চে কলকাতায় এসে সমাজকর্মী হিমাংশু কুমার দান্তেওয়াড়ায় কাটানো ১৮ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কথা বলেন। হিমাংশু কুমার বলেছিলেন, সরকারের পক্ষে এই আদিবাসীদের কাছে পৌঁছনোর একমাত্র উপায় ছিল পুলিশ, সরকার আদিবাসীদের জমি কেড়ে নেওয়ার পথে হাঁটে। দীর্ঘদিনের একজন নিপীড়িত আদিবাসীদের পক্ষে এই অবস্থায় মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সরকারের হাত থেকে জমি এবং সম্পত্তি বাঁচানোর একমাত্র পথ নিজে বন্দুক ধরা। ছত্তিশগড় রাজ্য গঠনের পর সরকার খনিজ উত্তোলনের জন্য জমি কাড়তে থাকে। বাধা আসে আদিবাসীদের থেকে। সরকার সালওয়া জুড়ুম শুরু করে। আদিবাসীদের তাদের বাড়িঘর ছেড়ে থানার আশেপাশের ক্যাম্পে থাকতে বলা হয়। আদিবাসীরা বন্দি অবস্থায় থাকতে অভ্যস্ত নয়, তারা খোলা জঙ্গলে বাস করে। আদিবাসীদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হতো। হিমাংশু প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন এই আদিবাসীদের ভারতের মানুষই মনে করা হয় না?

আদিবাসীদের জন্য তাই কি মানবাধিকারের কোনও নীতিও প্রযোজ্য হয় না? জেনেভা কনভেনশনের ৩ নম্বর সাধারণ অনুচ্ছেদ 'আন্তর্জাতিক চরিত্রের নয় এমন সংঘাত' সম্পর্কে আলোচনা করা আছে। ভারত এই কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী। ওই অনুচ্ছেদে লেখা আছে,

১) শত্রুতায় সক্রিয় অংশগ্রহণ না করা ব্যক্তিরা... এবং যাদের আহত অবস্থায় বা আটক করে 'যুদ্ধ থেকে দূরে' রাখা হয়েছে তাদের সঙ্গে সমস্ত পরিস্থিতিতেই মানবিক আচরণ করা হবে।

এই লক্ষ্যে, উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিদের সঙ্গে যে কোনও সময় এবং যে কোনও স্থানে নিম্নলিখিত কাজগুলি নিষিদ্ধ এবং থাকবে:

ক) জীবন ও ব্যক্তির প্রতি হিংসা, বিশেষ করে সকল ধরনের হত্যা...
ঘ) সাজা প্রদান এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা...

২) আহত এবং অসুস্থদের নিয়ে এসে তাদের যত্ন নেওয়া হবে।

অথচ মাওবাদীদের ক্ষেত্রে কেন এই কনভেশনের উল্লিখিত নীতির প্রয়োগ নেই? বিচারবহির্ভূত হত্যাই কি মাওবাদী বিদ্রোহ দমনের জন্য রাষ্ট্রের একমাত্র অস্ত্র?

More Articles