মেয়াদ ফুরনো ওষুধ ব্যবহার করা কি নিরাপদ?
ধরা যাক, আপনার হালকা জ্বর আর মাথা ব্যথা হচ্ছে, আপনি ড্রয়ার খুলে যে প্যারাসিটামল বার করলেন, দেখলেন ঠিক দু'সপ্তাহ আগে শেষ হয়ে গিয়েছে তার মেয়াদ। এমতাবস্থায় আপনি কী করবেন?
যত দিন যাচ্ছে, পৃথিবী জুড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে চিকিৎসার মূল্য। এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন গরিব দেশের মানুষেরা চিকিৎসার খরচ বহন করতেই পারেন না, কত মানুষ মারা যান বিনা চিকিৎসায়, বিনা ওষুধে। দামি দামি ওষুধ, ইঞ্জেকশন, ইনসুলিন বা অ্যন্টিডোটস তাদের জন্য নয় যারা দু'বেলা দু'মুঠো খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খায়। কিন্তু বিধাতার অদ্ভুত লীলায়, রোগ কখনো মানুষের ক্রয় ক্ষমতা দেখে আসে না। সে ঔষধের দাম বোঝে না, নিরাময়ের খরচ বোঝে না। সে চলে আসে সূর্য ডোবার পরের ঝুপ করে নাম অন্ধকারের মতো। যারা চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ওষুধ কিনতে পারে, তাদের বেশিরভাগ ঘরে ফিরে যায় আবার। আর যারা পারে না, তাদের আর ফেরা হয় না হয়তো।
ঠিক এই সময় দাঁড়িয়ে কোটি কোটি টাকার ওষুধ ফেলে দেওয়া হয় মেয়াদ শেষের তারিখ বা এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি ভাবতেই পারেন মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ফেলে দেওয়াই তো উচিত, তার জন্যই তো মেয়াদ শেষের তারিখ দেওয়া থাকে। এখানেই আসে দ্বিমত প্রকাশের জায়গা।
১৯৭৯ সালে FDA অর্থাৎ ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যডমিনিস্ট্রেশন প্রতিটা ওষুধের একটা মেয়াদ শেষের তারিখ থাকার আইন পাস করায়। কিন্তু এই মেয়াদ শেষের তারিখ আসলে কী? যে কোনও ওষুধে মেয়াদ শেষের তারিখ মানে হলো ওষুধটির প্রস্তুতকারক বার্তা দিচ্ছেন যে অন্তত ওই দিন অবধি ওষুধটি তার পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করবে। কিন্তু তারপর কী? সেই উত্তর জানতেই US FDA একটা পরীক্ষা শুরু করেন ১৯৮৫ - ১৯৯০ সালের মধ্যে। তাঁরা ১০০-এর বেশি মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ওষুধের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে ফলাফল দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। তাঁরা দেখেন, ৯০%-এর বেশি ওষুধ মেয়াদ শেষের তারিখের প্রায় ১৫ বছর পর অবধিও ব্যবহারযোগ্য থেকে যায়।
এবার আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, তার মানে কি সব ওষুধের ক্ষেত্রেই এই ১৫ বছরের ব্যবহারযোগ্য মেয়াদ প্রযোজ্য? উত্তরটা হল- না। মেয়াদ তারিখ শেষের পরেও ওষুধের ব্যবহারযোগ্যতা নির্ভর করে ওষুধের স্টোরেজ পদ্ধতি এবং ওষুধের প্রকৃতির ওপর।
স্টোরেজ পদ্ধতি:
আগেই বলেছি ওষুধের 'এক্সপায়ারি ডেট' মানে হল, প্রস্তুতকারক বার্তা দিচ্ছেন যে, অমুক দিন অবধি এই ওষুধ নিজের পূর্ণ শক্তি এবং দক্ষতায় কার্যকারী থাকবে। অর্থাৎ মেয়াদ শেষের তারিখের পর ওষুধটি আস্তে আস্তে হারাবে তার উপযোগিতা। ওষুধের উপযোগিতা কীভাবে হ্রাস বা বৃদ্ধি পায়? উত্তরটা হলো, স্টোরেজ পদ্ধতির দ্বারা। ওষুধ কে আমরা কোথায় রাখছি তার ওপরে নির্ভর করে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ওষুধ ব্যবহারযোগ্য থাকবে কিনা! ওষুধ সবসময় ঠান্ডা, শীতল এবং অন্ধকার পরিবেশে রাখতে হয়। এর জন্যই ওষুধ রাখার আদর্শ জায়গা হলো ফ্রিজ বা রেফ্রিজেটর। ওষুধ যদি উত্তপ্ত, আদ্র, রোদের আলো যুক্ত বা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে রাখা হয় তবে ধীরে ধীরে তার কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। ফলত ওষুধ যদি সঠিক ভাবে রাখা হয়, তবে তা মেয়াদ শেষের তারিখের পরেও ব্যবহারযোগ্য থেকে যায়।
ওষুধের প্রকৃতি:
সব ধরণের ওষুধ মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্যবহার করা নিরাপদ নয়। বিশেষত ইঞ্জেকশন, ইনসুলিন, অ্যন্টিবায়োটিক, বা তরল জাতীয় যে কোনও ওষুধ মেয়াদ শেষের পর ব্যবহার করা উচিত নয়। এইসব ক্ষেত্রে ওষুধ তরল রূপে থাকায় তার কার্যকারিতা হ্রাস পেতে থাকে খুব তাড়াতাড়ি। একমাত্র ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা শক্ত রূপে থাকা ওষুধগুলোই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ব্যবহারযোগ্য থেকে যায়, যদি তা ঠিকভাবে স্টোরেজ করা হয়ে থাকে। এবার, এইসব ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট-এর ও প্রকারভেদ আছে। ধরা যাক, কারও বুকে বাইপাস সার্জারি হয়েছে। অপারেশনের পর তিনি হৃদযন্ত্রের সাবলীল চলাচলের জন্য কিছু ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট খান। সেক্ষেত্রে সেই ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্যবহার না করাই উচিত। কারণ কোনও কারণে ঔষধটির কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়ে থাকলে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হতে পারে, এবং ব্যক্তিটির প্রাণসংশয় ঘটতে পারে। আবার ধরা যাক কারোর মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে বা গ্যাস অম্বলের সমস্যা হচ্ছে, সে ফ্রিজ থেকে পুরনো ওষুধ বার করে দেখল, ওষুধটির কিছুদিন আগেই মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে ওষুধটি ব্যবহার করা যেতেই পারে।
শেলফ লাইফ এক্সটেনশন প্রোগ্রাম (SLEP), FDA ডিপার্টমেন্ট ওব ডিফেন্স মেয়াদ শেষ হওয়া ওষুধের কার্যক্ষমতার ওপর একটি পরীক্ষা করেন। তাদের মুল লক্ষ্য ছিল, চলতি বাজারে ওষুধের দাম কমানো। যাতে, সাধারণ গরিব মানুষরাও সহজে প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে পারেন। পরীক্ষার ফলাফল আসার পর তারা দেখতে পান ৮৮% ওষুধ সঠিকভাবে স্টোরেজ করলে, মেয়াদ শেষের ১ বছর পরেও সমান কার্য্যকারী। কিছুকিছু ওষুধের ক্ষেত্রে সেটা মেয়াদ শেষের ৬৬ মাস পরেও একই। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ২৭৮ মাস অর্থাৎ মেয়াদ শেষের ২৩ বছর পরেও ওষুধটির কার্যক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে না। কিছু কিছু ওষুধের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষের তারিখ পার হয়ে যাওয়ার পর ভেষজ গুণ কমে যাচ্ছে যা রোগীর জন্য ক্ষতিকারক। মনোক্লোনাল অ্যন্টিবডিজ সেইসব ওষুধের মধ্যেই একটি। এই ওষুধ মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্যবহার করা নিরাপদ নয়।
২০১৫ সালে মায়ো ক্লিনিকের পক্ষ থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থারা ওষুধের একটা প্রাথমিক মেয়াদ শেষের তারিখ দিয়ে রাখতে পারে। ভবিষ্যতে সেই ওষুধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে, আবার পরীক্ষার মাধ্যমে তার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে মেয়াদ বাড়িয়ে দিলে সারা পৃথিবী জুড়ে ওষুধের অপচয় বন্ধ হবে। অপচয় বন্ধ হলে দাম কমবে ওষুধের। দাম কমলে পৃথিবীর বিভিন্ন গরিব দেশগুলোতে জীবনদায়ী ওষুধগুলোর ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। গরিব রোগীরাও চিকিৎসা পাবে। এই পদ্ধতির আমদানী মানুষের উপকার তো করবেই, তার সঙ্গে পৃথিবীর রসদের অপচয়ও বন্ধ হবে।
যদিও FDA বলে, মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর কোনওরকম ওষুধের ব্যবহার করাই উচিত নয়। যেহেতু প্রতিটা ওষুধের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে ওষুধটি কীভাবে স্টোর করে রাখা হয়েছে তার ওপর। একটি গবেষণা অনুযায়ী, ৬৬% সাধারণ মানুষ ওষুধ স্টোরেজের সঠিক পদ্ধতি জানেন না। যার ফলে, ওষুধের কার্যক্ষমতা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কমতে থাকে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেই সব ওষুধ শরীরের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকারক।
কিছু প্রশ্ন:
ওষুধ স্টোরেজের সঠিক পদ্ধতি কী? -
ঠান্ডা এবং অন্ধকার জায়গায় ওষুধ রাখুন। বাথরুম বা রান্নাঘরে বা গাড়িতে ওষুধ রাখা নিরাপদ নয়। শিশু এবং গৃহপালিত পশুদের আওতার বাইরে ওষুধ রাখবেন।
মেয়াদ শেষের পরেও কী ওষুধ ব্যবহার করতে পারি? -
যে সমস্ত ওষুধ তরল রূপে থাকে না, অর্থাৎ, ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট তা সঠিকভাবে স্টোর করা থাকলে ব্যবহারযোগ্য থাকে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও।
কিন্তু যে কোনও তরল ওষুধ মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ব্যবহার করা নিরাপদ নয়।
কোন কোন ধরনের ওষুধ মেয়াদ শেষের পর ব্যবহার করা নিরাপদ নয়? -
ইনসুলিন, ওরাল নাইট্রোগ্লিসারিন, ভ্যাকসিন, ব্লাড প্রোডাক্টস, ইঞ্জেকশন, অ্যন্টি বায়োটিক, চোখের ড্রপ, পাউডার জাতীয় ঔষধ যেগুলো দেখতে পুরানো হয়ে গ্যাছে এবং যে কোনও ওষুধ যার রং বদলে গিয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.drugs.com/article/drug-expiration-dates.html
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC7040264/
https://www.fda.gov/drugs/special-features/dont-be-tempted-use-expired-medicines