মানসিক চাপ, অভ্যেস... কীভাবে ছাড়বেন ধূমপান?
যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের দিকে আঙুল না তুলে, আসুন না, আমরা সবাই মিলে তাঁদের মনটা একটু জানার চেষ্টা করি।
ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়।
হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। কোনও ভুল নেই। মনোবিদরাই এই কথা বলছেন। কিন্তু কেন ক্ষতিকারক নয়, এই বিষয়ে যাওয়ার আগে, যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁদের দিকে আঙুল না তুলে, আসুন না, আমরা সবাই মিলে তাঁদের মনটা একটু জানার চেষ্টা করি। কেন তাঁরা এই বদভ্যাসে জড়িয়ে গেলেন, অন্যরা কেন গেলেন না, যদি এইভাবে দেখি বা ভাবি, তাহলে তাদের প্রতি কিঞ্চিৎ সহানুভূতিশীল হওয়া যায়।
তাই শুরুতেই একটা ঘটনার কথা বলি, রাহুল তখন ক্লাস নাইনের ছাত্র, সামনে মাধ্যমিক। আমরা জানি, এই বয়সটা একটু বেশিই সেনসিটিভ, শরীর ও মন দুই দিক দিয়েই। কিন্তু এই বয়ঃসন্ধির সময়েই জীবনে সবচেয়ে বড় করে নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ, জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। বাবা-মায়ের অফুরন্ত আশা, তাঁদের নিজেদের জীবনে না পূরণ হওয়া ইচ্ছে, পাড়া-প্রতিবেশীর অহেতুক উত্তেজনা- সমস্তকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত চিন্তাসুলভ পরিস্থিতি। এর ফলে মনের ওপর প্রবল চাপ। এই অবস্থায় রাহুলের অঙ্কের টিউশনে আদ্রিতাকে নিয়ে মন আর হরমোন একাকার। তাই এই প্রবল চাপ থেকে সাময়িক মুক্তির পথ হিসেবে অনির্বাণ প্রথম সিগারেট ট্রাই করতে বলে রাহুলকে। অঙ্ক টিউশনে ঢোকার আগে, মক টেস্ট শুরু হওয়ার ঠিক আগে, এমনকী, পেট পরিষ্কার না হলে বাথরুমে ঢোকার আগে, ওফ্ কী যে স্বস্তি! টোটকার মতো কাজ করে, চটজলদি সমাধান এবং অতি-অবশ্যই সেই সময়ের জন্য ধূমপান একেবারেই ক্ষতিকারক নয়। অনেক সময় ওদের মধ্যে আবার প্রতিযোগিতাও হয়, যেমন মুখ দিয়ে ধোঁয়া নিয়ে নাক দিয়ে বের করা। দুটো সিগারেট একসঙ্গে খাওয়া, শেষ অবধি ছাই জমিয়ে রেখে ইনহেল করা ইত্যাদি। তবে অনেক সময় দলে এমন অনেকে থাকে, যারা ধূমপান করে না। অগত্যা তাদের নিয়ে হাসি ঠাট্টা চলে। তারাও আওয়াজ খাওয়ার ভয়ে ধূমপান শুরু করে দেয়। আর এই বিষয়টাকেই ধরে নেওয়া যেতে পারে ধূমপান শুরু হওয়ার প্রথম কারণ, peer pressure বা বন্ধুত্বের চাপ।
আরও পড়ুন: পল্লবী-বিদিশা-মঞ্জুষাদের মতো মানুষরা চরম মুহূর্তে মনের কথা বলবে কাকে?
বেশিরভাগের ধূমপান শুরু হয় এইভাবেই। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিণত হয় অভ্যাসে। আর সেই অভ্যাস ত্যাগ করা হয়ে যায় ভীষণভাবে জটিল। নিয়মিতভাবে ধূমপান করার ফলে শরীর সিগনাল দিতে শুরু করে, যাকে আমরা বলি ট্রিগার হওয়া। যার থেকে একটা অস্বস্তি শুরু হয়। শুধু মানসিক নয়, শারীরিক উত্তেজনাও শুরু হয় প্রবলভাবে, যাকে আমরা মনোবিজ্ঞানীরা বলি ‘withdrawal symptoms'। যা যথেষ্ট কষ্টকর! তার চেয়ে আরও একবার ধূমপান করে নেওয়া সেই মুহূর্তে ইনস্ট্যান্ট রিলিফ।
আরও একবার রাহুলের গল্পে ফিরি। রাহুল এখন বড় হয়ে গেছে। শুধু মাধ্যমিক নয়, জীবনের অনেক ওঠা-পড়া টানাপোড়েনের পরীক্ষা সামলেছে। এখন সেলসে একটা চাকরি করছে, জীবনের টার্গেটে বাধা এলেও কোম্পানির টার্গেটে ছেদ পড়লে বসের অপমান, প্রোমোশনে বাধা! একটু ভালো করে বাঁচতে চাওয়া জীবন আরও দূরে চলে যায়, চাপ ক্রমশই বাড়তে থাকে। ছোটবেলায় যে টেনশন থেকে মুক্ত হতে ধূমপান শুরু হয়েছিল, বড়বেলায় সেই টেনশন পরিণত হল অ্যাংজাইটি আর স্ট্রেসে। এবং তার সঙ্গে জোট বাঁধল অস্থিরতা। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল অতিরিক্ত ভাবনা (overthinking)। তাই যুদ্ধ জয় করার জন্য 'বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া’ দেওয়া হয়ে দাঁড়াল লড়াই করার সাহসের একমাত্র পথ।
এবার রাহুল নয়, সোমনাথের প্রসঙ্গে আসি। সোমনাথ ছোটবেলা থেকেই ফেলুদার একটু বেশিই ভক্ত।ফেলুদার বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ওকে আকর্ষণ করে, আয়নায় ফেলুদা হতে গিয়ে ও অনেকবারই কাগজ পাকিয়ে সিগারেটের পোজ দিয়েছে। ফেলুদার এই আটিটিউড ওকে মুগ্ধ করে। তাই সিগারেট খাওয়া যেমন ওর ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ঘটায়, তেমন ওকে ওর আইডিয়াল সেলফের কাছেও পৌঁছে দেয়। এবং এইভাবে সোমনাথের মতো নানা মানুষের ধূমপান অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় তাদের অজান্তেই।
ধূমপান করার আরও একটি বড় কারণ হলো সংযোগ। লক্ষ করে দেখবেন, চা খাওয়ার পর সিগারেট খাওয়া বা চা খেতে খেতে সিগারেট খাওয়া বেশ কমন একটা ব্যাপার কিন্তু। মাটির ভাঁড়ে দুধ চা আর পাশে জ্বলন্ত সিগারেট, সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এই ছবি বেশ পপুলার।অনেকে আবার পান খাওয়ার পর সিগারেট খান। দুপুরের লাঞ্চ আর রাতের ডিনারের পর সিগারেট না খেলে খাবারই হজম হয় না অনেকের।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে রাখি। বেশ কিছু মানুষ আছেন, যারা ইচ্ছাকৃত বেশি ধূমপান করেন, তাঁদের ধূমপান করা অনেক সময় ভীষণভাবে নিষেধ তা সত্ত্বেও। এও এক ধরনের ইচ্ছামৃত্যুর পন্থা। মনোবিদরা যাকে বলেন chronic Suicide। অনেক সময় সম্পর্ক ভেঙে গেলে, বা জীবনের নানা হতাশা-দুঃখ থেকেও অ্যালকোহল বা সিগারেটের নেশা শুরু হয়, আখেরে যা প্রবল যন্ত্রণা থেকেই হয়। আমরা আসলে প্রকাশ হওয়া ব্যবহারটাই দেখি, তার আড়ালে আসল যন্ত্রণা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়।
কাজেই বোঝা যাচ্ছে, কারণ আছে বিস্তর এবং তার কোনওটাই কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তাই যতই বউয়ের শাসন বা প্রেমিকার চোখরাঙানি থাকুক, আসলে এরা কেউ বুঝতেই চায় না, নিজের অজান্তেই ধূমপান কখন প্রিয় মানুষের চেয়েও বেশি প্রিয় ও প্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। এবার মনোবিদ হয়ে কীভাবে যিনি ধূমপান করছেন, তার পক্ষ নিই? যেখানে তা শরীরের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক তো বটেই, মৃত্যুর কারণও হতে পারে। ছুটির দিনে রিল্যাক্স করে সিনেমা দেখতে গেলেও ভয়ংকর ছবি আমার আগাম পরিণতি দেখিয়ে দিচ্ছে যেখানে, সেক্ষেত্রে সমাজ তো মনোবিদ হিসেবে বাতিল করে দেবে! নিদেনপক্ষে যারা তাদের প্রিয় মানুষকে ক্রমাগত ‘খাবার পরে একটা করে,কথা দিয়েছো' আওড়ে 'অপুর সংসার'-এর অপর্ণা হয়ে উঠেছেন, তাঁরা তো বয়কট করবেনই। তাই দু'দিক মেনেই সমাধানের উপায় বাতলাতে হবে।
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, যুক্তি দিয়ে ভেবে নিজেকে আটকে রাখা দীর্ঘদিন ধরে মুশকিল। তাও মনস্তত্ব বলেছে, যাদের মধ্যে নিজের সম্পর্কে চেতনা বেশ প্রবল, আত্মবিশ্বাস বেশ দৃঢ়, যারা ভাগ্যে বিশ্বাসী কম, জীবনে বেশিরভাগ কাজ পরিশ্রমের মাধ্যমে জয়ে বিশ্বাসী, তারা চাইলে যে কোন মুহূর্তে সিগারেট ছেড়ে দিতেই পারেন। কিন্তু মানুষ তো আর একরকম নয়, আর আপনি ওইরকম হতে পারেননি বলে মনখারাপও করবেন না, কাজেই যেখানে শরীর চাইছে, ধূমপান না করলে শারীরিক কষ্ট হচ্ছে, সেখানে যুক্তিকে আপাতভাবে একটু সরিয়ে রাখতে হবে। কারণ যিনি ধূমপানে আসক্ত হচ্ছেন, তিনি জানেন দীর্ঘ সময় পর শরীরে মারণ-প্রভাব পড়তে পারে, তাও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না নিজেকে। এ এক সাংঘাতিক অসহায়তা। যা কিছুতেই বোঝানো যায় না প্রিয় মানুষকে, যিনি যত্নে ও অতি-সাবধানে আপনাকে কেয়ার করেই সিগারেট রাখছেন লুকিয়ে। তাহলে করণীয় উপায় কি নেই কিছু? নিশ্চয় আছে। আপনি সিগারেট কাল থেকেই সম্পূর্ণ ছাড়তে পারেন, তবে তা হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, যা আপনাকে শুরুতে কষ্ট দেবে প্রবল। তাহলে সেই কষ্ট কমানোর জন্য কি একটু একটু করে সিগারেট খাওয়া কমানো যায়? মানে ধরুন, কিছু 'মাস্ট টাইম' থাকেই। মানে খেতেই হবে, যেমন ধরুন, যেখানে সংযোগ প্রবল, যেরকম বাথরুমে যাওয়ার আগে, লাঞ্চটাইমের পরে বা বসের কাছে যাওয়ার ঠিক আগে, তখন আপাতভাবে ধূমপান জারি থাক। কিন্তু যে সময়গুলো এমনি ধূমপান করছেন, মানে 'ধুর, ভালো লাগছে না, একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম', বা বন্ধুদের ঠেকে আড্ডা দেওয়ার সময় একটার পর একটা সিগারেট টানছি যখন, সেখানে কি একটু সচেতন হওয়া যায়? যদি এভাবে শুরু করি? অন্তত সাতদিন টানা যদি করে ফেলতে পারেন, আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে নিজের ওপর। চেষ্টা করে দেখতে পারেন কিন্তু।
এবার বলব, তাদের কথা, যাদের জীবনে অহেতুক চাপ। তা আজকাল অবশ্য আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই আছে। তবে কিছু মানুষ থাকেন যারা ঠিক 'কুল' নন। অন্যকে কুল থাকার জ্ঞান দিয়ে নিজে থেকে থেকেই হট হয়ে যান। না না সেই ধরনের হট না, মাথা গরম করার কথা বলছি (যদিও মহিলাদের ধূমপান করা বিষয়টাকে অনেকেই ‘হট’ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করেন,সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি)। যাঁরা অহেতুক স্ট্রেসে ভোগেন, সাংঘাতিক অ্যাংজাইটিতে ভোগেন, তাঁদের অবশ্যই বুঝতে হবে, এর সমাধান ধূমপান কখনওই নয় এবং এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় আছে। যে পরিমাণ খরচা করছেন ধূমপানে, সেই খরচা থেকে মনোবিদের কাছে যেতেই পারেন। সেই সমাধান অনেক বেশি কার্যকর এবং প্রভাবদায়ীও।
এবার যারা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ছেন, বা সিগারেট টেনে 'হট' হয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা একটু সেফ জোনে আছেন। মানে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিত্বের উন্মেষ নিজে থেকেই ঘটাতেই পারেন। তার জন্য ধূমপান দরকার পড়বে কেন? এভাবে ভেবে দেখেছেন কি? ফেলুদা শুধুই ধূমপান করেননি, মগজাস্ত্র ব্যবহার করেছেন। আর 'ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে', তবে দোস্তির অনুরোধ রাখতে গিয়ে যদি জিন্দেগি যায়, তব কেয়া হোগা? তাই অনুরোধ রাখতে হলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণও রাখতে হবে। কয়েকদিন আগেই ৩১ মে World Health Organization (WHO)-এর 'World No Tobacco Day' ৩৫ বছর পূর্ণ করল।
সবশেষে বলি, এই যে আর্টিকলের ট্যাগ লাইন, ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক 'নয়', আপনার নিজস্ব জীবনও যদি এই 'নয়’-এর ওপর জোর দেয়, তবে আপনি নিশ্চিত বদলাবেন। আর আমরা তো সকলেই জানি, বড় বড় শহরে এইসব ছোট ছোট বদলই পরিবর্তনে বিপ্লব ঘটাতে পারে। তাই না?