রোহিঙ্গা শিশুর কান্নাও 'অবৈধ'?
India deports Rohingyas: রোহিঙ্গাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, যা তাঁদের আইনি কর্মসংস্থান, ধারাবাহিক শিক্ষা এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো থেকে বঞ্চিত করে।
‘বহু যুদ্ধ করিয়া সহিদ হল পিতা।
রণক্ষতে ভাগ্যবলে আমি আইলুং এথা।।
কতেক আপনা দুঃখ কহিনু প্রকাশি।
রাজ আসওয়ার হৈলুং রোসাঙ্গেত আসি।।’
একথা স্পষ্ট করে বলে, শুরু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন মায়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যেই সংঘটিত হয়েছিল, যা একটি বিশাল শরণার্থী সংকট সৃষ্টি করে। যে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের প্রতি ভারত সরকারের আচরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা তীব্র সমালোচনা করছে। গত ১৫ মে ২০২৫, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে রোহিঙ্গাদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়ার খবরে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে এই "অবিবেচনাপ্রসূত, অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ড" এর তদন্ত শুরু করেছেন। ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে আন্দামান সাগরে ফেলার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনে উদ্বিগ্ন হয়ে জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ এই ধরনের "অবিবেচনাপ্রসূত, অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ড"-র তদন্ত শুরু করেছেন এবং ভারত সরকারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে অমানবিক এবং জীবন-হুমকিপূর্ণ আচরণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, যার মধ্যে মায়ানমারের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে তাঁদের জোর করে ঠেলে দেওয়াও অন্তর্ভুক্ত।
"নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এই ঘটনাটি মোটেও অমানবিক নয়। আমি এই ঘটনাবলী সম্পর্কে আরও তথ্য, সাক্ষ্য চাইছি এবং ভারত সরকারকে কী ঘটেছে তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি" জানিয়েছেন মায়ানমারের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ। তাঁরা এই নীতিগুলির জন্য ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং তার মতাদর্শগত পিতৃসুলভ সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-কে দায়ী করেন। ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে, জোরপূর্বক ফেরত পাঠানো (Refoulement)-র অভিযোগ, ভারত বারবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু মানবধিকার সংগঠনগুলি বারবার বলেছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখনই মায়ানমারে ফিরে গেলে তাঁদের পুনরায় নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হবে। এটি আন্তর্জাতিক আইনের নন-রিফুলমেন্ট (non-refoulement)-এর মৌলিক নীতির লঙ্ঘন, যা কোনো শরণার্থীকে এমন দেশে ফেরত পাঠাতে নিষেধ করে যেখানে তাঁদের জীবন বা স্বাধীনতার জন্য গুরুতর হুমকি রয়েছে।
আরও পড়ুন- বাংলাদেশে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী! বাড়ি ফিরতে পারবেন?
মনে রাখতে হবে, ভারত সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের "অবৈধ অভিবাসী" এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারছে কারণ ভারত রাষ্ট্র ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। বিজেপি এবং আরএসএস-এর হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ (হিন্দুত্ব) কাঠামোর মধ্যে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রায়শই "অনুপ্রবেশকারী" এবং ভারতের ধর্মীয় গঠন পরিবর্তনের জন্য "ডেমোগ্রাফিক জিহাদ"-এর অংশ হিসাবে চিত্রিত করা হয়। এই বক্তব্য তাঁদের ‘মানুষ’ সত্তার অবমূল্যায়ন করে এবং বৈষম্যমূলক নীতির জন্য একটি অনুমতিপ্রদানকারী পরিবেশ তৈরি করে। অথচ হিন্দু, শিখ বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের (আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তিব্বত থেকে আগত) বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)-এর মাধ্যমে দ্রুত নাগরিকত্ব দেওয়ার চেষ্টা বহাল রয়েছে, সেই আইনি লব্জেই আবার মুসলিম রোহিঙ্গাদের স্পষ্টভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের ফেরত পাঠানোর লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ভারতের কোনো ধর্মীয় শরণার্থীর সুরক্ষার ক্ষেত্রে কোনো জাতীয় কাঠামো নেই। রোহিঙ্গাদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, যা তাঁদের আইনি কর্মসংস্থান, ধারাবাহিক শিক্ষা এবং পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো থেকে বঞ্চিত করে। আনুষ্ঠানিক শিবিরগুলি (যেমন জম্মু, দিল্লি, হায়দ্রাবাদে)-তে বসবাসকারীদের অবস্থা শোচনীয়। সেখানে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি, খাদ্য সহায়তা না পাওয়ার রিপোর্ট রয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্বিচারে আটক, কর্তৃপক্ষের দ্বারা হয়রানি এবং ফেরত পাঠানোর হুমকির অসংখ্য রিপোর্ট রয়েছে, যা একটি নিরন্তর ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
বিজেপি-আরএসএস-এর সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলির দ্বারা ভারতীয় বাঙালি মুসলিমদের 'রোহিঙ্গা' অভিহিত করার মাধ্যমে রাজনৈতিক শিকার বানানোর কৌশলের মাধ্যমে বাংলা-চিন-আরাকানের সমৃদ্ধ আন্তঃসাংস্কৃতিক ইতিহাসের অপমৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা চলছে। বিজেপি-আরএসএস বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে থাকা গোষ্ঠীগুলির দ্বারা একটি সুপরিকল্পিত এবং ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের মতো রাজ্যগুলির বাংলাভাষী মুসলিমদের, তাঁদের প্রকৃত নাগরিকত্ব বা প্রজন্মগত বসবাসের ইতিহাস না জেনেই, প্রকাশ্যে 'রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী' আখ্যা দেওয়া চলছে। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে মিথ্যাভাবে 'বিদেশী অনুপ্রবেশকারী' আখ্যা দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈধতা কেড়ে নেওয়ার পর, নিজ দেশেই নাগরিকত্বহীন করে দেওয়ার এ এক কূটকৌশল।
এই 'রোহিঙ্গা' নামটিকে কেবল একটি রাজনৈতিক গালাগালিতে পর্যবসিত করা, একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বিমোচন-এর কাজ। এই হিন্দুত্ব-সন্ত্রাস বাংলা ও আরাকান (বর্তমানে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য) অঞ্চলের মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন গভীর সংযোগকে অস্বীকার করে, যার একটি অংশ রোহিঙ্গারা। এর ফলে বঙ্গ-চীন-আরাকান বাণিজ্যের ইতিহাসের অপমৃত্যু ঘটবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বঙ্গোপসাগর ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র। বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত আরাকান উপকূল- চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে পূর্ব বাংলার সংযোগ স্থাপনের বিশাল বাণিজ্য নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।

জম্মুতে রোহিঙ্গা শরণার্থী
বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সঙ্ঘের মুখপত্র ‘পরম’ পত্রিকার রেশম পথ সংখ্যাতে বি বি কুমার রচিত ‘ভারতের উত্তরপূর্বের রাজ্য, পূর্বের প্রতিবেশী দেশ এবং বাণিজ্য পথ’ শীর্ষক রচনাটিতে বলা হচ্ছে,
‘উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির মধ্যে দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য পথ অতীতের তিব্বত আর বার্মাকে জুড়ত। খুব পুরনো এক বাণিজ্য পথ ছিল পেশোয়ার থেকে পার্বতীপুর (বর্তমান বাংলাদেশ) পর্যন্ত। এই রাস্তাটি প্রাচীন কাল থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা হয়ে য়ুনানের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করত।’
চট্টগ্রামের মতো বন্দরগুলি প্রকৃত অর্থেই কসমোপলিটান কেন্দ্র ছিল। চৌধূরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্মা তত্ত্বনিধি প্রণীত চট্টগ্রামের ইতিহাস জানাচ্ছে,
‘ভ্রমণকারীগণের ভ্রমণবৃত্তান্ত পাঠেও চাটিগাঁর সুবিস্তৃত বাণিজ্যের কথা অবগত হওয়া যায়। চাটিগাঁইয়া পোত লইয়া চাটিগাঁইয়া নাবিকগণ নক্ষত্র ধরিয়া বাণিজ্যার্থে ভারতমহাসাগরের নানাদ্বীপেও পারস্য, সিংহল, মিশর দেশ পর্যন্ত গমন করিত। আরব দেশের "মৌজা" নামক স্থানে তাহাদের প্রধান আড্ডা ছিল। তখনকার দিনে চট্টগ্রাম এক বাণিজ্য প্রধান নগর ছিল এবং দেশীয় বিদেশীয় বণিকদিগের পক্ষে জলপথে বাণিজ্য করিবার ইহা যে একট বিশেষ সুবিধাজনক বন্দর ছিল তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। বর্তমান চট্টগ্রামের ও তন্মধ্য-প্রবাহী নদী সকলের এবং অদূরবর্তী বঙ্গোপসাগরের প্রাকৃতিক অবস্থা পর্যালোচনা করিলে ইহা বেশ অনুমান হয় যে, সেই সময়ে নদী সকলের ও সমুদ্রের অবস্থা এইরূপ ছিল না। কর্ণফুলী প্রভৃতি নদী সকল তখনকার দিনে অতিশয় বিপুলকায়া ও সুবিস্তীর্ণা ছিল, এবং সমুদ্র চট্টগ্রাম শহরের অতি নিকটবর্তী ছিল। ঐ সকল নদীর নিকটবর্তী ও অদূরবর্তী গ্রাম সকলের নাম ও প্রাকৃতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিলেও স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ঐ সকল গ্রাম এক সময়ে নদীগর্ভস্থ ছিল, পরে চর পড়িয়া ক্রমে ক্রমে গ্রামে ও বর্তমান অবস্থায় পরিণত হইয়াছে। যেমন চরখিজিরপুর, চরখিধিরপুর ইমামল্লারচর, চরলক্ষা, চরপাথরঘাটা, মনোহরখালী, পতেঙ্গা ইত্যাদি, ইত্যাদি। মোটের উপর বলিতে গেলে, তখনকার দিনে চট্টগ্রামের নদীসকলও নিকটবর্তী সমুদ্র, চর প্রভৃতি দ্বারা বাণিজ্যসহরের অদূরবর্তী চরলক্ষা, জুলধা প্রভৃতি নদীর অপর তীরবর্তী স্থানগুলি সেই সময়ে সমুদ্রের কুক্ষিগত ছিল। বর্তমান (Fairy Hill) ফেয়ারিহিলে পাদদেশ ধৌত করিয়া সমুদ্রের লবণাম্বুরাশি আনোয়ারা পাহাড়ের পাদদেশে উছলিয়া পড়িত। দেয়াঙ্গের পাহাড় পর্তুগীজ জলদস্যুগণের একটী প্রধান আড্ডা ছিল'।
সব বাঙালি মুসলিমকে 'রোহিঙ্গা' আখ্যা দেওয়া এই জলবাণিজ্যের সমূহ স্মৃতি থেকে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং একটি জটিল সভ্যতাগত বিনিময়কে একটি অবৈধ অনুপ্রবেশ নামক সরলরৈখিক হিন্দুত্ব আখ্যানের উপাদান করে তোলে। এই রাজনৈতিক রণহুংকার আরাকানি রাজদরবারগুলির (১৫-১৮ শতক) গৌরবময় অধ্যায়কে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে, যাঁরা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্টপোষক ছিলেন। দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল-এর মতো কবিরা—যাঁদের বাংলা সাহিত্যের অলঙ্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়—আরাকানের রাজাদের পৃষ্টপোষকতায় তাঁদের মহাকাব্যগুলি ( সতী ময়না, পদ্মাবতি) রচনা করেছিলেন। এই সময়কাল এমন সাহিত্য পরম্পরার জন্ম দিয়েছিল, যা বাংলা, ফার্সি ও স্থানিক বাচনকে-কে মিশিয়েছিল। এর কাছাকাছির ভূগোলে, চট্টগ্রামের সেনাপতি পরাগল খাঁর ছেলে ছুটি খাঁ, কবি শ্রীকর নন্দী-কে দিয়ে মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বের বঙ্গানুবাদ করান। সেই হিসাবে একজন বাঙ্গালি মুসলিমকে 'রোহিঙ্গা' আখ্যা দেওয়ার অর্থ হল বাংলা সাহিত্যের, বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে মুছে ফেলার চেষ্টা করা।
আরও পড়ুন- উদ্বাস্তুদের মানচিত্র কোথায়? কীভাবে বাংলাদেশে ভিটেহারা হয়ে এলেন রোহিঙ্গারা?
রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে চিনের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল, ভারতের দ্বিমুখিতা ও BIMSTEC-এ নেতৃত্ব দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে, এবং বঙ্গোপসাগরে BRICS-এর সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। চিন ASEAN (the Association of Southeast Asian Nations)-এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য চেষ্টা করে চলেছে। তারা মায়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপকে উৎসাহিত করেছে এবং নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করতে চেয়েছে। একইসঙ্গে ASEAN-এর সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক স্থিতাবস্থা নীতিকে তারা সম্মান জানিয়েছে, পশ্চিমা শক্তিদের মতো সাংশান নির্ভর রাজনীতি না করে আলাপচারিতার পরিবেশ বানাতে চেয়েছে। ভারত BIMSTEC (Bay of Bengal Initiative for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation)-এর নেতৃত্ব দাবি করলেও, রোহিঙ্গা বিষয়ে তার দ্বিচারিতা রয়েছে: ভারত সরকার "অবৈধ অনুপ্রবেশ" আখ্যান-এর পিছনে লুকিয়ে, পুশব্যাকের রাজনীতি করছে, যা এই আঞ্চলিক সমন্বয়ের চিন্তার সাথে সাংঘর্ষিক। রোহিঙ্গা সংকটে সে তার মানবিক দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে BRICS (Brazil, Russia, India, China, South Africa জোট) একটি গঠনমূলক ভুমিকা পালন করতে পারে। BRICS মায়ানমার, বাংলাদেশকে নিয়ে ASEAN-এ একটি নিরপেক্ষ ফোরাম তৈরি করতে পারে, যেখানে শান্তি বার্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। BRICS দেশগুলি রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে শর্তাধীন ভাবে মানবিক খাতে বিনিয়োগ করতে পারে, যা রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পথ সুগম করবে। ভারত সরকার আর যদি কিছু মনে নাও রাখতে চায়, এ কথা যেন তারা মনে রাখে যে, ২০২৩ সালে প্রকাশিত ‘The Bay of Bengal as Zone of Peace and Prosperity’ শীর্ষক আসিয়ান নথিতে তাঁদের গবেষক তাত্ত্বিক সঞ্জয় পুলিপাকার তরফে বলা হয়েছিল, এক কথায় স্বীকার করা হয়েছিল যে,
‘Bangladesh and Myanmar had a maritime dispute. The significance of the dispute can be gauged from the fact that the maritime territory under contention was around 150,000 square kilometres (sq km) of the Bay of Bengal, with significant energy resources’
বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের অর্থনৈতিক গুরুত্বকে অনুধাবন করে বলা হয়েছিল,
‘Moving forward, it is crucial to address sensitive political issues to improve the overall climate for economic growth, investment and trade.’
আজ অন্ততপক্ষে অর্থনৈতিক লাভের কথা ভেবেও কেন যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের যন্ত্রণা মেটাতে সদিচ্ছুক হচ্ছে না নরেন্দ্র মোদির সরকার। তা বোঝা এমন কিছু দুষ্কর নয়। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা এখন বৈশ্বিক ক্ষেত্রে ভারতের বদনামিতেও পিছপা হচ্ছে না। কিন্তু আমরা, যাঁরা বাংলার মানুষ, যাঁদের আবাস কলকাতা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত, তাঁদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, যে ভূমির বাসিন্দা রোহিঙ্গারা সেখানেই একদিন পিতৃহারা সৈয়দ আলাওল পর্তুগিজ হার্মাদদের কবল থেকে পালিয়ে ঠাঁই নিয়েছিলেন রোসাঙ্গ রাজসভাতে। সেদিন সব হারানো তাঁর জুটে গিয়েছিল অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান। আমরা যাঁরা নিজেদের মধ্যযুগীয় না প্রতিপন্ন করে বিষম আত্মরতিতে ভুগি, তাঁরা কি এতটাই ‘দেশপ্রেমিক’, এতটাই বেশি ‘হিন্দু’ হয়ে উঠলাম যে রোহিঙ্গা জননী ও শিশুদের কান্নাকে আর একটু দায় ও দরদ দিয়ে দেখতে ভুলে গেলাম?
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)

Whatsapp
