গণহত্যার রক্ত মোছার চেষ্টা! গাজার হাসপাতাল-হামলার দায় পিআইজি-র উপরে কেন চাপাচ্ছে ইজরায়েল?
Gaza Hospital attack: গাজার হাসপাতালের উপরে সাম্প্রতিক রকেট হামলায় অন্তত ৫০০ নিরাপরাধ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। যার দায় হাত থেকে ঝেড়ে পিআইজি-র উপরে ঠেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নেতানিয়াহু সরকার।
হাসপাতালে গিজগিজ করছে মুমূর্ষু রোগীদের ভিড়। রয়েছে শিশু, রয়েছে পুরুষ-নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। গাজার সেই হাসপাতাল চত্বরেই আশ্রয় নিয়েছেন কত যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ, হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন প্রিয় মানুষর সেরে ওঠার। কেউ বা অপেক্ষা করেছেন একটু শুশ্রুষা পাওয়ার। এই যুদ্ধের বাজারে এই হাসপাতালটুকুকেই সুরক্ষাকবচ ভেবেছিলেন যাঁরা, তাঁদের ভুল ভেঙেছে অচিরেই। আচমকাই সেই হাসপাতালের উপরে নেমে এসেছে আঘাত। রকেটের ধাক্কায় মুহূর্তে সব ছাই হয়ে গিয়েছে। হাসপাতালের করিডোর জুড়ে সাদা চাদরে ঢাকা মৃতদেহের ভিড় তখন। রক্তাক্ত মানুষের হাহাকার আর কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে বাতাস। মানুষের চিকিৎসা করতে এসেছিলেন এমন বহু চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী মারা গিয়েছেন এদিনের হামলায়। ইজরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষ লাগার পর থেকে বারবার গাজা স্ট্রিপের উপরে নেমেছে রকেট, বোমা, গুলি। হামাস জঙ্গিদের শেষ করার লক্ষ্যে একের পর এক নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে চাঁদমারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ইজরায়েলি সেনা। মুহূর্তে নিজের দেশে শরণার্থী হয়ে গিয়েছেন একগুচ্ছ মানুষ। সেই ভিটেমাটিহারা মানুষের মিছিল হাঁটছে পশ্চিম তিরের দিকে।
গত কয়েকদিনে অন্তত হাজার ছয়েক রকেট হামলা হয়েছে গাজার উপরে। একটি মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদলের দাবি, সেই সবকটা রকেট হামলাকে মিলিয়ে দেখলে তা পারমাণবিক বোমার এক তৃতীয়াংশের সমান প্রায়। দিন কয়েক আগেই উত্তর গাজা থেকে বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল ইজরায়েল সরকার। হুমকি এসেছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বোম ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে ওই এলাকা। তাতে নাকি হামাস জঙ্গিদের খতম করা যাবে সহজেই। আর তার সঙ্গে যে নিরপরাধ বাসিন্দাদের মৃত্যুশয্যা রচিত হবে সেখানে, তারা সকলেই কোলাটোরাল ড্যামেজ। বড় বড় যুদ্ধে যেমনটা হয়েই থাকে। এদিকে হামাসরাও সাধারণ মানুষকে মানব ঢাল বানিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করছে, আর পোকামাকড়ের মতো মরে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। তেমনই একটি হামলা বুধবার নামল গাজার আল আহলি হাসপাতালে। মুহূর্তে সব শেষ। মৃত্য়ুর ঢল নামল গাজার ওই হাসপাতালে।
আরও পড়ুন: গাজার হাসপাতালে রকেট হামলার দায় কার? কেন যুদ্ধের বলি নিরীহ শিশুরা?
জর্ডনে আরব রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠক বাতিল হওয়ার পর সটান ইজরায়েলে পৌঁছে গেলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বিমানবন্দরে ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাইডেনের আলিঙ্গনের গভীরতাই মেপে দেবে তাঁদের বন্ধুত্বের জল। বন্ধুত্ব বড় বালাই। যার জেরে গাজার হাসপাতালের ঘটনা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেই কথা ঘোরালেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বরং হাসপাতালে রকেট হামলার দায় চাপালেন অন্য কারওর উপরে। নেতানিয়াহু সপাটে বলে দিলেন, এই হামলার নেপথ্যে মোটেও ইজরায়েলি সেনার হাত নেই। বরং নৃশংস এই হামলার জন্য দায়ী প্যালেস্টাইনের আর একটি স্থানীয় জঙ্গি দল প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ।
তা কারা প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ বা PIG? ১৯৭০ সাল নাগাদ জন্ম এই জঙ্গি গোষ্ঠীর। সুন্নি এই মুসলিমপন্থি জঙ্গি সংগঠনটি তৈরি হয়েছিল প্যালেস্টাইনে ভূমিতে ইজরায়েলের জবরদখল প্রতিহত করার জন্য। প্যালেস্টাইনি যত কটা জঙ্গি সংগঠন রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে কট্টরবাদী দল এটিই। PIG-র নেতৃত্বে রয়েছেন জিয়াদ আদ-নাখালা ও মুহম্মদ আল-হিন্দি। হামাসের পরে প্যালেস্টাইনের বৃহত্তম সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন এটিই যার অস্তিত্ব গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, দু-জায়গাতেই রয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে ইজরায়েলে নানা হামলার পিছনে রয়েছে এই দলটি। হামাস আর পিআইজি-র লক্ষ্য মোটামুটি একই। প্যালেস্টাইনে ইজরায়েল দখলীকৃত ভূমিগুলিকে স্বাধীন করা। আর সেই পিআইজি-র উপরেই এদিনের হাসপাতাল হামলার দায় চাপিয়েছেন নেতানিয়াহু। কিন্তু পিআইজি এই হামলার দায় নেয়নি মোটেই।
মজার ব্যাপার হল, এদিন সকালেই নেতানিয়াহু তাঁর সোশ্যাব ব্লগিং সাইটে ঘোষণা করেছিলেন গাজার হাসপাতালে হামলার কথা। জানিয়েছিলেন, ওই হাসপাতালের ভিতরেই নাকি রয়েছে হামাসদের ঘাঁটি। যার উপর রকেট ফেলে সেই ঘাঁটি বিনষ্ট করার কৃতিত্ব নিজের দেশের সেনাকেই দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু। এই পোস্টই তিনি করেছিলেন ১৭ অক্টোবর, সন্ধ্যে ৮টা ২৩ নাগাদ। আর তার পর রাত ১২টা ৫৮ নাগাদ সেই পোস্টটি মুছে ফেলে ভুল স্বীকার করে কী লিখলেন নেতানিয়েহু। জানালেন, সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদন শেয়ার করে তিনি যে রকেট হামলার কথা বিখেছিলেন তা নাকি মিথ্যা। গাজার হাসপাতালে হামলায় কোনও দায় নেই ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের। সেই সুরই শোনা গেল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গলাতেও।
আরও পড়ুন: বন্ধুত্বে অন্ধ! গাজার হাসপাতালে ইজরায়েলি ধ্বংসলীলার দায় অন্য ঘাড়ে চাপাচ্ছেন বাইডেন?
এ যুদ্ধে ইজরায়েলের বিরোধিতা করেছে প্রায় ২০টির বেশি দেশ। অথচ সেই তালিকায় নেই আমেরিকার নাম। গোড়া থেকেই বন্ধু-দেশ ইজরায়েলের পাশেই থেকেছে আমেরিকা। সমর্থন করেছে নেতানিয়াহু সরকারকেও। আর এত এত নিরপরাধ মানুষের উপরে হামলার পরে কৌশল করে এখন মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করছে ইজরায়েল। গাজার হাসপাতালের উপরে সাম্প্রতিক রকেট হামলায় অন্তত ৫০০ নিরাপরাধ নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। যার দায় হাত থেকে ঝেড়ে পিআইজি-র উপরে ঠেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নেতানিয়াহু সরকার। ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্সও এককথায় জানিয়ে দিয়েছে, এই হামলার পিছনে তাঁরা ছিলই না। গাজার জঙ্গিগোষ্ঠীদের দিক থেকেই উড়ে এসেছে এই রকেট। এদিকে নেতানিয়াহুর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট কিন্তু বলছে অন্য কথাই। এত এত নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ, শিশু, বয়স্কের রক্ত হাতে মাখার পর ইজরায়েলের সেই দাবি কার্যত মানছে না বিশ্বের কোনও মানবাধিকার পর্যবেক্ষক দলই।