থিয়েটার করতেন চুটিয়ে, স্ত্রী-শিশুদের খুন করে ইজরায়েল! হামাসের মাস্টারমাইন্ড দেইফ এক রহস্য

Hamas Master Mind Mohammed Deif : ২০১৪ সালে ইজরায়েলি বিমান হামলায় তাঁর স্ত্রী, ৭ মাসের শিশুপুত্র এবং ৩ বছরের মেয়ে নিহত হয়।

৯/১১ মনে পড়ছে ইজরায়েলের। ৬ অক্টোবর হামাসের বিধ্বংসী হামলায় ইজরায়েলের ১২০০-র কাছাকাছি সাধারণ মানুষের প্রাণ গিয়েছে। ইজরায়েল পাল্টা হামলা চালিয়েছে প্যালেস্টাইনের উদ্দেশে। হামাসের এই জল-স্থল-অন্তরীক্ষ কাঁপানো হামলার পেছনের গোপন মাস্টারমাইন্ড যিনি, তিনি ফিলিস্তিনি জঙ্গি মহাম্মদ দেইফ। হামাস গাজা উপত্যকা থেকে হাজারে হাজারে রকেট নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটি অডিও টেপ সম্প্রচারিত হয়। তাতে উল্লেখ ছিল 'ইজরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান' কথাটি। এই হামলাকে হামাস বলছে 'আল আকসা ফ্লাড'। জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে ইজরায়েলি হামলার প্রতিশোধের পাল্টা হামলা ছিল এটি। ২০২১ সালের মে মাসে, ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থানে ইজরায়েলি হামলার পর আরব এবং মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফুটতে থাকে। ঠিক তখনই মহাম্মদ দেইফ পাল্টা হানার পরিকল্পনা শুরু করেন।

রমজানে আল আকসা মসজিদে ইজরায়েলের হামলা, প্রার্থনাকারীদের মারধর, তাদের উপর হামলা, বয়স্ক ও যুবকদের মসজিদ থেকে টেনে বের করার দৃশ্য এবং ফুটেজ যত ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ তত বাড়তে থাকে। মসজিদের মধ্যে সেই হামলার জেরে ইজরাইল এবং হামাসের মধ্যে ১১ দিনের টানা যুদ্ধ চলে। দু' বছর পার করে ইজরায়েলে হামাসের হামলা, ১৯৭৩ সালের আরব-ইজরায়েল সংঘাতের পর সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা।

আরও পড়ুন- পবিত্র দিনেই কেন খুন ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ? কারা এই হামাস, কী-ই বা তাদের লক্ষ্য?

মহম্মদ দেইফ মিতভাষী এবং জনসমক্ষে কখনই উপস্থিত হন না। তাই যখন হামাসের টিভি চ্যানেল ঘোষণা করে যে তিনি শনিবার বক্তৃতা দিতে চলেছেন, ফিলিস্তিনিরা জানত বড় কিছু একটা ঘটতে চলেছে। মহম্মদ দেইফ তাঁর ভাষণে সেদিন বলেন, "আজ আল আকসার ক্রোধ, আমাদের জনগণ ও জাতির রাগ ফেটে বেরোচ্ছে। আমাদের মুজাহেদিন (যোদ্ধারা), আজ অপরাধীকে বোঝানোর দিন যে তার সময় শেষ হয়েছে।" দেইফ কে? কেউ জানে না। দেইফের মাত্র তিনটি ছবি মেলে। একটি ছবি তাঁর যখন ২০ বছর মতো বয়স, সেই সময়ের। অন্যটিতে দেইফ মুখোশ পরে আছেন এবং অডিও বক্তৃতা সম্প্রচারের সময় তাঁর একটি ছায়ার ছবি দেখা যায়। দেইফ থাকেন কোথায়? তাও কেউ জানে না। সম্ভবত গাজায় কোনও এক সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় তাঁর বাস। অদেখা-অজানা এই মহম্মদ দেইফ ইজরায়েল হামলার পরিকল্পনা ও পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

ফিলিস্তিনি এক সূত্র বলছে, গাজায় রাতারাতি ইজরায়েলি বিমান হামলায় যেসব বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, তার একটি দেইফের বাবার বাড়ি। সূত্র বলছে, এই হানায় দেইফের ভাই এবং পরিবারের অন্য দুই সদস্য মারা গেছেন। হামাসের এক ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, হামলার প্রস্তুতির সিদ্ধান্তটি যৌথভাবে নেওয়া হয়েছিল। হামাসের আল কাসাম ব্রিগেডের নেতৃত্বে আছেন দেইফ এবং গাজার হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, তারা দু'জনে মিলে এই সিদ্ধান্ত নেন। তবে মূল মাথা ছিল দেইফেরই। এই অভিযানের তথ্য মাত্র কয়েকজন হামাস নেতাই জানত।

বিষয়টা এতই গোপন ছিল যে ইরান, যে কিনা ইজরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু এবং হামাসের অর্থ, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস, সেই ইরানও জানত না কী ঘটতে চলেছে। হামাস, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব, ইরান-সমর্থিত লেবানিজ জঙ্গি হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সঙ্গে কোনওভাবেই এই অভিযান নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। ইরানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ আয়াতুল্লাহ আল খামেনি জানিয়েছেন, ইজরায়েলের উপর এই হামলার সঙ্গে তেহরান জড়িত নয়।

ইজরায়েলকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে হামাস, ইজরায়েলের শত্রু আর ইরানের মিত্র। হামাস কোনও লড়াই শুরু করতে আগ্রহী নয়, বরং গাজায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। কিন্তু হামাসের বৈদেশিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান আলি বারাকা বলছেন, এই যুদ্ধের জন্য দুই বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছিল হামাস।

শান্ত কণ্ঠে দেইফ তার ভাষণে বলেছিলেন, হামাস বারবার ইজরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ বন্ধ করার জন্য, নির্যাতিত বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য এবং ফিলিস্তিনি জমি দখল বন্ধ করার জন্য সতর্ক করেছিল। কোনও কিছুই না হওয়াতে এই আক্রমণ।

আরও পড়ুন- হুইলচেয়ারে বসেই পাথর ছুড়ে প্রতিবাদ! বিশ্বকে ধাক্কা দেয় প্যালেস্তাইনের যে লড়াই

এক বছরেরও বেশি সময় ধরে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে অশান্তি চলছে। এই এলাকাটি প্রায় ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৫০ কিলোমিটার চওড়া। ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল এই জায়গাটি দখল করার পর থেকে ইজরায়েলি-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই এলাকাটি। দেইফ বলেন, হামাস আগেও ইজরায়েলকে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দিতে একটি মানবিক চুক্তিতে সই করতে বলেছিল, কিন্তু ইজরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করে।

১৯৪৮ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পরে স্থাপিত হয় খান ইউনিস শরণার্থী শিবির। সেই রিফিউজি ক্যাম্পে ১৯৬৫ মহাম্মদ মাসরি নামে জন্মগ্রহণ করেন এই জঙ্গি নেতা। ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া প্রথম ইন্তিফাদা বা ফিলিস্তিনি বিদ্রোহের সময় হামাসে যোগদানের পর মহাম্মদ দেইফ নামে পরিচিত হন তিনি। ১৯৮৯ সালে ইজরায়েল দেইফকে গ্রেফতার করেছিল এবং প্রায় ১৬ মাস আটকে রেখেছিল।

দেইফ গাজার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন এবং জীববিদ্যা ছিল তাঁর বিষয়। শিল্পকলার প্রতিও দেইফের আগ্রহ প্রবল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদন বিভাগের প্রধান ছিলেন ছিন, থিয়েটার অভিনয়ও করতেন নিয়মিত। হামাসে যোগ দিয়ে এবং বড় দায়িত্ব পেয়ে দেইফ এই জঙ্গি গোষ্ঠীর নেটওয়ার্ক এবং বোমা তৈরিতে দক্ষ হয়ে ওঠেন। বেশ কয়েক দশক ধরেই ইজরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকার শীর্ষে রয়েছেন তিনি। আত্মঘাতী বোমা হামলায় অজস্র ইজরায়েলির মৃত্যুর জন্য ব্যক্তিগতভাবে দায়ী দেইফ। দেইফ এমনই এক হামলা একটি চোখ খুইয়েছেন, একটি পায়ে গুরুতর আঘাতও পেয়েছেন। ২০১৪ সালে ইজরায়েলি বিমান হামলায় তাঁর স্ত্রী, ৭ মাসের শিশুপুত্র এবং ৩ বছরের মেয়ে নিহত হয়। স্মার্ট ফোনের মতো আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না দেইফ। তিনি অধরা। তিনি ছায়ার মানুষ। হামাসের মতো উগ্রপন্থায় বিশ্বাসী দলের এই নেতা, তবু ছায়াতে থেকেও বদলে দিলেন ইজরায়েলের এমন অজস্র সাধারণ মানুষের জীবন। একটা যুদ্ধ, ২ বছরের পরিকল্পনা, আর দীর্ঘদিনের রাগ তাঁর হাতিয়ার কেবল।

More Articles