পবিত্র দিনেই কেন খুন ইজরায়েলের সাধারণ মানুষ? কারা এই হামাস, কী-ই বা তাদের লক্ষ্য?
Hamas Israel Attack : হামাস এই দিনটিকে বেছে নিয়েছে কারণ এটি শুধু ইহুদি ধর্মের পবিত্র দিনই নয়, ১৯৭৩ সালের সংঘাতের ৫০ বছরও।
শ'য়ে শ'য়ে মানুষের লাশ, আর যুদ্ধের আতঙ্ক! আরও একবার ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের মানুষ অনিশ্চিত জীবনের মুখে। শনিবার ইজরায়েলে হামলা চালায় হামাস জঙ্গি গোষ্ঠী। পাল্টা, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধও ঘোষণা করে দিয়েছেন। ইজরায়েল বলেছে যে, হামাস প্যালেস্টাইনের এলাকা গাজা উপত্যকা থেকে বহুমুখী হামলা শুরু করার পর থেকে ৭০০ জনেরও বেশি ইজরায়েলি নিহত হয়েছেন, বেশিরভাগই সাধারণ নাগরিক। আহত হয়েছেন আরও ২,১৫০ জন। ৫০০০ রকেট আছড়ে পড়ে ইজরায়েলে, আকাশ, স্থলপথ, সমুদ্রপথ সব কিছুর মাধ্যমেই ইজরায়েলে হামলা চালিয়েছে হামাস। ইহুদিদের পবিত্র দিন ছিল সেটি, সিমচাট তোরাহ-র দিন, ছুটির দিন। হামাসের জঙ্গিরা গাজা সীমান্ত থেকে ১৫ মাইল পর্যন্ত ইজরায়েলি শহর এবং অন্যান্য সম্প্রদায় সহ গাজা স্ট্রিপের বাইরে ২২টি স্থানে প্রবেশ করে। কিন্তু ফের কেন এই হামলা? কারাই বা এই হামাস?
তার জন্য ফিরে যেতে হবে ৫০ বছর আগে। দিনটা ছিল ৬ অক্টোবর, ১৯৭৩। ইহুদি ধর্মের পবিত্রতম দিন ইয়োম কিপপুরে, আরব দেশগুলির একটি জোট ইজরায়েল-অধিকৃত অঞ্চলগুলিতে হঠাৎ আক্রমণ শুরু করে। শুরু হয় ইয়োম কিপপুর যুদ্ধ। ইজরায়েল আরব জোটের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধের বেশিরভাগটাই ঘটে গোলান হাইটস, সিনাই এবং ইজরায়েলের দখলে থাকা অন্যান্য এলাকায়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন একটি গ্লোবাল নিউক্লিয়ার অ্যালার্ট জারি করেন। যুদ্ধ যত তীব্র হয় পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলির (ওপেক) আরব সদস্যরা ইজরায়েলকে সমর্থনকারী সমস্ত পশ্চিমি দেশগুলিতে তেল সরবরাহ স্থগিত করে, বিশ্বব্যাপী শক্তি সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করে। দুই সপ্তাহের হামলা এবং প্রায় ২০,০০০ মৃত্যুর পরে, ইজরায়েল যুদ্ধ শুরুর আগে তার দখলে থাকার চেয়ে আরও বেশি জমি দখল করে বিজয়ী হয়।
ঠিক ৫০ বছর পর, ৬ অক্টোবর, ২০২৩। গাজার হামাস গোষ্ঠী 'অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড' শুরুর ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে ইজরায়েলের উপর ৫,০০০-এরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করে। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য আরব এবং ইসলামিক দেশগুলিকে ডাক দিয়েছে হামাস।
আরও পড়ুন- ৫০ বছরের প্রতিশোধ! ৫০০০ রকেটের হামলা! গান শুনতে এসে লাশ হয়ে গেলেন ওরা…
হামাসের সদস্যরা সাম্প্রতিক এই হিংসার জন্য ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে দীর্ঘদিনের উত্তেজনাকেই দায়ী করেছেন। বিশেষ করে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণ নিয়ে বিরোধ রয়েছে এর নেপথ্যে। এই জায়গাটিকে মুসলিম এবং ইহুদি দুই পক্ষই সম্মান করে। এই জায়গার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ২০২১ সালে ইজরায়েল এবং হামাসের মধ্যে রক্তক্ষয়ী ১১ দিনের যুদ্ধ ও হিংসার দীর্ঘ ইতিহাস। ইহুদি ধর্মের পবিত্রতম দিনগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে সিমচাট তোরাহ। সেই দিনে ইজরায়েলি হামলা ১৯৭৩ সালের ইয়োম কিপপুর যুদ্ধ মনে করিয়ে দেয়।
হামাস এই দিনটিকে বেছে নিয়েছে কারণ এটি শুধু ইহুদি ধর্মের পবিত্র দিনই নয়, ১৯৭৩ সালের সংঘাতের ৫০ বছরও। হামাসের হামলার পরই ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং প্যালেস্টাইনের গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গাজা উপত্যকায় আক্রমণ শুরু করেন। এই হামাস আসলে কারা? কীই বা এদের ইতিহাস, আদর্শ, কীই বা দাবি?
হামাসের সূত্রপাত
১৯৮৭ সালে আহমেদ ইয়াসিন এবং আবদেল আজিজ আল-রান্টিসি ইজিপশিয়ান মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা হিসাবে হামাস সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হামাস মানে হরকাত আল-মুকাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়া, যার অর্থ ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন। 'হামাস' শব্দটির অর্থ উদ্যম। ১৯৮৮ সালে হামাস জানায়, এর লক্ষ্য ছিল প্যালেসটাইনকে মুক্ত করা এবং ইজরায়েল, পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকার বিস্তৃত এলাকায় একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। পরবর্তী বছরগুলিতে হামাস গোষ্ঠীটি জানিয়েছে যে, ইজরায়েল ১৯৬৭-এর পূর্ববর্তী সীমান্তে পিছু হটলে, ক্ষতিপূরণ দিলে এবং প্যালেস্টাইনের শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিলে তারা যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করবে এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্কও শেষ করবে। ইজরায়েল অবশ্য হামাসের এসব দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। ইজরায়েল মনে করেছে এসব বলে আদতে বিশ্বকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে হামাস।
হামাস সংগঠন কীভাবে চলে?
হামাসের একটি সাংস্কৃতিক শাখা রয়েছে, দাওয়াহ এবং একটি সামরিক শাখা রয়েছে, ইজ আদ-দিন আল-কাসেম ব্রিগেড। হামাসকে সমর্থন করে ইরান এবং এটি ইরান, সিরিয়া ও লেবাননের ইসলামপন্থী দল হিজবুল্লাহ নিয়ে গঠিত একটি ব্লকের অংশ। ব্লকের সব সদস্য এই অঞ্চলে মার্কিন নীতির বিরোধিতা করে। ইরানের বিদেশ মন্ত্রক জানাচ্ছে, হামাসের এই সাম্প্রতিক হামলা 'দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনের জনগণের আস্থার' প্রমাণ। প্যালেস্টাইন এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে হামাসের সমর্থক রয়েছে। ইরান, সিরিয়া এবং ইয়েমেন হামাসকে নিয়ে গর্বিত এবং এই হামলাকে 'বীরের হামলা' বলে সমর্থনও জুগিয়েছে তারা। কাতার এই পরিস্থিতির জন্য ইজরাইলকেই দায়ী করেছে। আরব লিগ এবং জর্ডনও ইজরায়েলের নীতি এবং বর্তমানের হিংসার সঙ্গে এর যোগসূত্রকেই দায়ী করেছে।
সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে দেখতে গেলে, ইজরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, কানাডা, মিশর এবং জাপান হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে মনে করছে। ২০১৮ সালে, হামাসের কার্যকলাপের নিন্দা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাতিল করা হয়।
আরও পড়ুন- ‘খ্রিস্ট’ : ঈশ্বর নয়, রোমানদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী যিশুর প্রতিবাদের কাহিনি
হামাস বনাম ফতাহ
প্যালেস্টাইনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হামাসের উত্থানের সঙ্গে সরাসরি যোগ ও সংঘাত রয়েছে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ফতাহ-র। ১৯৯০-এর দশকে আধাসামরিক সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ফতাহ। পরে এরা সশস্ত্র প্রতিরোধ ছেড়ে দেয় এবং ইজরায়েলি রাষ্ট্রের পাশাপাশি ১৯৬৭-এর সীমানা অনুসারে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবকে সমর্থন করে। ২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যুতে ফতাহ-র নেতৃত্ব দুর্বল হয় এবং তালেগোলে হামাস শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২০০৭ সালে, ফতাহর সঙ্গে গৃহযুদ্ধের পর হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ দখল করে। তারপর থেকেই হামাস গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করে আর ফতাহ পশ্চিম তীরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে।
হামাস নিজেদের ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচয় দিলেও ফতাহ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে। ইজরায়েলের প্রতিও দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। হামাস ইজরাইলকে স্বীকৃতি দেয় না। হামাস সশস্ত্র প্রতিরোধের আহ্বান জানায় আর ফতাহ সমাধানের উপায় খুঁজতে আলোচনার জন্য চাপ দেয়। গত কয়েক দশক ধরে এই দুই বাহিনী ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনে একাধিক চুক্তি ভেস্তে গেছে। সংঘাতের সর্বশেষ পরিণতি হচ্ছে নির্বাচন বয়কট। হামাস ২০২১-২২ সালে প্যালেস্টাইনের স্থানীয় নির্বাচন বয়কট করে। ফতাহ দলটির বর্তমান নেতৃত্ব হচ্ছেন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।
গাজা স্ট্রিপ হচ্ছে ইজরায়েল, মিশর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে একটি ৪১ কিমি দীর্ঘ এবং ১০ কিমি প্রশস্ত অঞ্চল। প্রায় ২.৩ মিলিয়ন মানুষের বাস এখানে। বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব দেখা যায় যেসব জায়গাতে, এই গাজা স্ট্রিপ তাদের মধ্যেই একটি। ইজরায়েল গাজা এবং এর উপকূলরেখার উপর আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণ করে। সীমান্ত দিয়ে কারা এবং কী আসবে তাও তারাই ঠিক করে। একইভাবে মিশর গাজা সীমান্ত দিয়ে কারা প্রবেশ করবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। জাতিসংঘের মতে গাজার জনসংখ্যার প্রায় ৮০% আন্তর্জাতিক সাহায্যের উপরই নির্ভর করে এবং প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ রোজ কী খাবেন তার জন্যও অন্যের সাহায্যের উপর নির্ভর করেন।
পশ্চিম তীর এবং গাজা- প্যালেস্টাইনের অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। সেই রোমান সময় থেকে পূর্ব জেরুজালেম এবং ইজরায়েল সবই প্যালেস্টাইনের অংশ বলেই পরিচিত ছিল। বাইবেলে ইহুদিদের দেশ হিসেবেই এর কথা বলা ছিল এবং ইহুদিরা নিজেদের প্রাচীন মাতৃভূমি হিসাবেই দেখে এই জায়গাটিকে। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েলকে রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই জায়গাটিকে এখনও অনেকেই প্যালেস্টাইন হিসাবেই মনে করেন কারণ তারা ইজরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারকে মানতেই চান না। প্যালেস্টাইনের বাসিন্দারাও পশ্চিম তীর, গাজা এবং পূর্ব জেরুজালেমের জন্য 'প্যালেস্টাইন' শব্দটিই ব্যবহার করে। এই হামলার পর হামাসের জঙ্গি কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আরবদের এই অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম বা এই অঞ্চলের অন্যত্র প্যালেস্টানিয়রা এই আহ্বানে সাড়া দেবেন কি না।