ফের নতুন করে হামলা বেইরুটে, পেজার বিস্ফোরণে কেন জড়াচ্ছে ইজরায়েলের Unit 8200-র নাম?

Pager Explosions in Lebanon: এই গণপেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের এই পরিকল্পনার পিছনে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা ইউনিট ৮২০০-র হাত রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

গত দু'দিন ধরে লাগাতার পেজার বিস্ফোরণ হয়ে গিয়েছে লেবানন ও সিরিয়ার বিচ্ছিন্ন এলাকা জুড়ে। একটার পর একটা পেজার ফেটে প্রায় চার হাজারের কাছাকাছি মানুষ জখম হন। ১২ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছিল তখন। কিন্তু সেই সংখ্যাটা রাতারাতি কয়েক গুণ বেড়ে গেল। বুধবার নিহত হিজবুল্লা কম্যান্ডারদের জানাজা নিয়ে শেষকৃত্যের সময় বেইরুটের দাহিয়েহ-তে তাঁদের ঘাঁটিতে ফের ফাটতে লাগত একের পর এক পেজার এবং ওয়াকিটকি।  নতুন করে পেজার বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২। নতুন করে জখম সাড়ে চারশোরও বেশি। 

একদিন আগেই লেবানন ও সিরিয়ার বিক্ষিপ্ত অংশ জুড়ে পেজার বিস্ফোরণের খবর আসে। যে হামলার দায় ইজরায়েলের উপরেই ঠেলেছিল লেবাননের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ। হিজবুল্লাহের সঙ্গে ইজরায়েলের সংঘাত চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। এই হিজবুল্লাহদের আবার মদত দিয়ে চলে ইরান। লেবাননে মঙ্গলবারের পেজার বিস্ফোরণ কাণ্ডের পর হামলার দায় ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের উপরেই ঠেলেছিল আমেরিকা।

বুধবারের হামলার নিশানায় শুধু পেজার নয়, হিজবুল্লাহ জঙ্গিদের ব্যবহার্য ওয়াকিটকিগুলোরও বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। যে কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হয়েছে আরও বেশি। নতুন এই হামলায় ২০ জন নিহত ও প্রায় সাড়ে চারশো জনেরও বেশি মানুষ আহত হন। এমনকী বেইরুটের বেশ কয়েকটি এলাকায় হোম সোলার এনার্জি সিস্টেমেও বিস্ফোরণ হয়েছে। এত বিরাট হামলার পিছনে যে দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা রয়েছে, তা এককথায় মেনেছে বিশেষজ্ঞ মহল। এত বড় হামলার নেপথ্যে ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের হাত থাকতে পারে বলেই দাবি করেছিল আমেরিকা। এরই মধ্যে উঠে আসছে নয়া নাম।

আরও পড়ুন: বিস্ফোরক লুকানো ছিল পেজারেই, লেবাননে বিধ্বংসী হামলার নেপথ্যে ‘ধুরন্ধর’ মোসাদ?

ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা ধুরন্ধর মোসাদের কথা তো সকলেই জানেন। কিন্তু এই গণপেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের এই পরিকল্পনার পিছনে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা ইউনিট ৮২০০-র হাত রয়েছে। ওয়েস্টার্ন সিকিওরিটি সূত্রের খবর, দীর্ঘ এক বছর ধরে এই হামলার পরিকল্পনা করেছে এই ইউনিট ৮২০০। কীভাবে পেজারগুলির ভিতরে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, তা ডিভাইসগুলি তৈরির সময়েই নিশ্চিত করেছিল তারা।

কারা এই ইউনিট ৮২০০?

সূত্রের খবর, ইজরায়েলের এলিট ইন্টালিজেন্স ইউনিট হিসেবে পরিচিত এই শাখাটি। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার মতো করেই প্রশিক্ষণ দিয়ে এদের তৈরি করা হয়েছে। সাইবার প্রতিরক্ষা থেকে শুরু প্রযুক্তিগত হামলা, সব ব্যাপারেই এরা দুর্দান্ত দক্ষ। বিভিন্ন হাইপ্রোফাইল অপারেশন পরিচালনার কাজে এদেরকে ব্যবহার করা হয়। ২০০৫-১০ সালে স্টাক্সনেট ভাইরাস হামলার নেপথ্যে ছিল এরাই। যারা ইরানের পারমাণবিক সেন্ট্রিফিউজগুলি ধ্বংস করেছিল। ২০১৭ সালে লেবাননের রাষ্ট্রীয় টেলিকম সংস্থা ওগেরোতে সাইবার হামলা চালায় তারা। ২০১৮ সালে আইএসআইএসের একটি চক্রান্ত ব্যর্থ করার নেপথ্যেও এই ইউনিট ৮২০০। আপাতত এই ইউনিটটিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ইজরায়েলের প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইয়োসি কুপারওয়াসা। কার্যত ইজরায়েলের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সেরা এই ইউনিট, তেমনটাই দাবি করেছেন ইয়োসি।

এত দক্ষতা সত্ত্বেও গত অক্টোবরে হামাসের এই হামলার খবর আগেভাগে দিতে পারেনি মোসাদ বা এই ইউনিট ৮২০০, কেউই। সেই নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়েছিল তারা। যার ফলে তাদের এক কর্মকর্চা পদত্যাগও করেন। সেই ইউনিট ৮২০০-ই সমস্ত ব্যর্থতা ঢেকে হিজবুল্লাহ দমনে নেমেছিল এক গোপন অপারেশনে, তেমনটাই মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল। যদিও মোসাদের তত্ত্বাবধানকারী আইডিএফ বা ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রক, কেউই এই ঘটনায় ইউনিট ৮২০০-র জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেনি।

মোবাইল মানেই জিপিআরএস ট্র্যাকিং, তাকে হ্যাক করাও অনেক সহজ। সে কারণেই যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে পেজারকে বেছে নিয়েছিল হিজবুল্লাহ জঙ্গিরা। আশঙ্কা ছিলই, তাঁদের যোগাযোগের ডিভাইস হ্যাক করে বড়সড় নাশকতা চালাতে পারে ইজরায়েল। সে কারণেই আগেভাগেই সতর্ক হয়েছিল তারা। কিন্তু তাতেও লাভ হল না। হিজবুল্লাহের অর্ডার দিয়ে আনানো ওই সব পেজারে যে আগেভাগেই বিস্ফোরক পুরে রাখা হয়েছে, তা ঘুনাক্ষরেও টের পাননি কম্যান্ডাররা। যে পেজারগুলিকে জরুরি জিনিস ভেবে সবসময় নিয়ে ঘুরতেন, সেগুলো যে একেকটা সম্ভাব্য বোমা, তা কে-ই বা জানত। গত সোমবার থেকে লেবাননে একের পর এক পেজার বিস্ফোরণ শুরু হয়। কারওর হাত উড়ে যায়, তো কারওর পা। কারওর বা চোট লাগে মাথায়। হাসপাতাল জুড়ে হাহাকার, তিল ধারণের জায়গা নেই শহরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে। দু-দিনের হামলায় নিহত হিজবুল্লাহ কম্যান্ডারদের শেষকৃত্যের সময় বেইরুটের ওই ঘাঁটিতে ফের পর পর বিস্ফোরণ। এবার আরও বেশি মানুষ নিহত হন।

লেবাননের হিজবুল্লাহ হোক বা প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী হামাস, এই দুই দলেরই পিছনে রয়েছে ইরান। অস্ত্রের জোগান থেকে শুরু করে নানাবিধ সহায়তা এরা পেয়ে থাকে ইরানের থেকেই। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার সাহসের ভিত্তিও আদতে ইরানের মদতই। গত কয়েক মাস ধরেই ইজরায়েলে লাগাতার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে হিজবুল্লাহরা। কখনও ইজরায়েলের দিকে ধেয়ে আসছে সারি সারি রকেট, কখনও ড্রোন। যা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ইজরায়েলের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও। কখনও পাল্টা আক্রমণ ফিরিয়ে দিচ্ছে নেতানিয়াহুর দেশও। এই পরিস্থিতিতে এত বিশাল হামলা লেবানন জুড়ে। সাধারণ নিরীহ একটি যন্ত্রকে যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে পোটেনশিয়াল বোমা হিসেবে। এই হামলার পরে যে ইরান ছেড়ে কথা বলবে না ইজরায়েলকে, তা একরকম স্পষ্ট।

আরও পড়ুন: ৯ জনের মৃত্যু, ২৭৫০ জন আহত! লেবাননে কীভাবে ঘটল পেজার বিস্ফোরণ?

হিজবুল্লাহদের ব্যবহৃত পেজারগুলি তৈরির মেয়াদ দেওয়া হয়েছিল তাইওয়ানের একটি সংস্থাকে। যদিও তার দায় স্বীকার করেনি তাইওয়ান। এদিকে বুধবার যে ওয়াকিটকিগুলি বিস্ফোরণ হয়েছে, সেগুলো বানিয়েছে জাপানের সংস্থা আইকম ইনকর্পোরেড। তাদের তরফে দাবি করা হয়েছে, এক দশক আগেই এই মডেলগুলির উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে তারা। ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকায় IC-V82 রেডিওগুলি রফতানি করেছে তারা। তারপর তা উৎপাদন ও রফতানি দুই-ই বন্ধ হয়ে যায়। এমনকী এই ওয়াকিটকিতে ব্যবহৃত ব্যাটারির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যায়। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কীভাবে এই যন্ত্রগুলিতে বিস্ফোরক ভরা হল? সব মিলিয়ে ঘনিয়েছে বেশ রহ্স্য। এই পেজার বিস্ফোরণ কাণ্ডের নেপথ্যে বড়সড় ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে ইজরায়েলের তরফে কোনও বিবৃতি না এলেও ইজরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, "আমরা এই মুহূর্তে যুদ্ধের একটি নতুন পর্বের শুরুতে রয়েছি।" গ্যালান্টের এই বক্তব্যকে ঘিরে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বের বড় অংশ। তাহলে কি পরোক্ষ ভাবে নতুন করে যুদ্ধঘোষণার কথাই বলে দেওয়া হল ইজরায়েলের তরফে। গাজায় প্রায় এক বছর ধরে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। হামাস-ইজরায়েল যুদ্ধে বলি হয়েছেন ইতিমধ্যেই অসংখ্য নিরাপরাধ ফিলিস্তিনি। এবার কি সেই যুদ্ধে তৈরি হতে চলেছে নতুন অক্ষশক্তি। আরও বড় কোনও বিশ্বযুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে পৃথিবী। সেই আশঙ্কাই নতুন করে উস্কে দিয়েছে সাম্প্রতিক এই হামলা।

 

More Articles