অবৈধই ছিল প্রথমে, অথচ দামও আকাশছোঁয়া! কীভাবে বাঙালির হেঁশেলে জাঁকিয়ে বসলো ‘পোস্ত’?
Posto or Poppy Seeds in Bengal : দাম বাড়লেও স্বাদে ভাটা পড়েনি এক রত্তিও! কীভাবে বাঙালি বাড়িতে জনপ্রিয় হয়ে উঠল পোস্ত?
ভাত, ডাল সঙ্গে একটু আলু পোস্ত; ব্যাস! এতেই মাছ, মাংসের স্বাদ নিমেষে ভুলতে পারে বাঙালি। সাদা মিহি দানা, কেজি প্রতি দাম প্রায় দুই হাজার টাকা ছুঁইছুঁই। যদিও দামের জেরে আহারে ভাটা পড়ে মা এক রত্তিও। আজও নিরামিষ পদ হিসেবে পোস্তর জুড়ি মেলা ভার। আলু ছাড়াও, ঝিঙে, পটল, চিচিঙ্গা, বড়ি ইত্যাদি দিয়ে পোস্তর পদ রাঁধা হয় বাংলার হেঁশেলে। মূলত ঘটি বাড়ির রান্না হিসেবেই পরিচিত হলেও, বাঙাল বাড়িতে ঝাল ঝাল পোস্ত রাঁধা নিয়ে বেশ তরজা চলে। যদিও আকাশছোঁয়া দামের ঠেলায় বর্তমানে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে এই পদ, তবুও ভালোবাসার জোর তো দাম দিয়ে ঠেকানো যায় না, তাই আজও সপ্তাহান্তে অন্তত একবার পোস্ত খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে পারেন না বেশিরভাগ বাঙালিই।
শিল নোড়ায় বাটা পোস্ত, সঙ্গে অল্প কাঁচা লঙ্কা আর সর্ষের তেল, জবাব নেই এ স্বাদের। আজও এই ক্লাসিক স্বাদে মজেন অধিকাংশ। কিন্তু জানেন কি কবে থেকে প্রথম পোস্ত খাওয়ার চল শুরু হয় এ দেশে? কীভাবেই বা বাঙালির বাড়িতে অনুপ্রবেশ ঘটে সাবেকি পোস্তর?
বাংলার চিরন্তন পদ হলেও পোস্তর উদ্ভাবন আসলে বিদেশের মাটিতে। প্রথমদিকে চীনই ছিল আফিম চাষের ঘাঁটি। তাই ব্রিটিশরা প্রাথমিকভাবে বিদেশ থেকেই আমদানি করতো পোস্ত। যদিও শোনা যায়, এ দেশে মুঘল আমলে তরকারির ঝোল গাঢ় করতে পোস্ত বাটা মেশানোর রেওয়াজ ছিল। অন্যদিকে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পরপরই তারা চিনের বিশাল অবৈধ আফিমের বাজারে হানা দেয়। আসলে সেই সময় চিন থেকে চোরাপথে বাংলাতে আফিম আসতো। লাখ লাখ টাকার আফিম চোরাপথে এদেশে নিয়ে আসা হতো ফলে এতে খরচও পড়তো বিশাল। তাছাড়া ধইরা পড়ার ভয় তো ছিলই। এই সময় ব্রিটিশরা ঠিক করল আর আমদানি নয় এবার ভারতের মাটিতে চাষ করা হবে আফিম। কিছুদিনের মধ্যেই ব্রিটিশরা আফিম উৎপাদনের জন্য বাংলায় পোস্ত চাষ করাতে শুরু করে। যদিও এতে বাংলার এতদিনের কৃষিজ ভিতে চরম আঘাত আসে। পোস্ত চাষের ফলে অন্যান্য সবজি চাষে ভাটা পড়ে। ফলে কৃষকরাও কিছুতেই রাজি হতে চান না চাষ করতে, যদিও পরাধীন ভারতীয়দের চাওয়ার ওপর কিছুই নির্ভর করতো না ব্রিটিশ শাসকদের। জুলুম করেই শুরু হয় পোস্ত চাষ।
আরও পড়ুন - ভুল থেকেই জন্ম জনপ্রিয় মিষ্টির! যে রহস্য লুকিয়ে আছে গুলাব জামুনের নেপথ্যে
যেহেতু পোস্ত চাষ সামগ্রিকভাবে মাটির ফলন ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয় সেহেতু বাংলায় ব্রিটিশ আমলে পোস্ত চাষ হওয়ায় সবজি চাষে ব্যাপক ক্ষতি দেখা যায়। কেবলমাত্র আলু চাষের ক্ষেত্রে এ ক্ষতি পরিলক্ষিত হয় না ফলে আলুর সঙ্গে পোস্ত বাটা মিশিয়ে রান্না করার প্রবণতা সেই সময় কৃষক ঘরে লক্ষ্য করা যায়। কথিত আছে, এক কৃষকের স্ত্রী শুকনো ও অবশিষ্ট আফিম ফুলের বীজ পোস্ত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন। তিনি তা বেঁটে তাতে সর্ষের তেল ছড়িয়ে দেন, এরপর সেদ্ধ আলু সহযোগে পান্তা ভাত খান। এবং সেই স্বাদ থেকেই প্রথম আলু পোস্ত রাঁধার কথা মাথায় আসে তাঁর। যা পরবর্তীতে বাঙালি হেঁশেলে জাঁকিয়ে জায়গা করে নেয়।
যদিও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে এদেশে আফিম চাষ ব্যান করে করে দেওয়া হয়। কিন্তু ততদিনে বাঙালি তথা ভারতীয়দের জিভের সঙ্গে ভালো রকম বন্ধুত্ব হয়ে গেছে পোস্তর ফলে চাহিদা বাড়তে থাকে অন্যদিকে কমতে থাকে জোগান। স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়তে থাকে। সময়ের সঙ্গে এই বাড়তি দাম এতটাই আকাশছোঁয়া হয়ে যায় যে তা প্রায় মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যায়। যদিও সাবেকি বাংলার রান্না হিসেবে প্রস্তুত তার আজও অটুট দাম দিয়ে হলেও মাঝে মাঝে পোস্ত খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনা বাঙালি। আলু পোস্ত, পোস্ত বাটা, পোস্ত বড়া, ঝিঙে পোস্ত, পটল পোস্তর এই নিরামিষ জগতে ক্রমেই ঢুকে পড়ে চিকেন পোস্ত, পেঁয়াজ পোস্ত, রুই পোস্তের মত আমিষ পদেরাও। স্বাদ তাতে বেড়ে যায় বহুগুণ। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পোস্ত চাষে অনুমতি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠিও দিয়েছেন বলে শোনা যায়। ফলে পরবর্তীতে বাংলায় পোস্ত চাষ হলে দাম অনেকটাই কমতে পারে বলে আশা আম জনতার।