যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্গতি হতে চলেছে প্রেসিডেন্সির মতোই
Jadavpur University Ragging : এ রাজ্যে কতদিন ধরে কলেজগুলির ছাত্র ইউনিয়নের ভোট হয়নি কেউ খেয়াল রেখেছেন?
বহু বছর আগে প্রেসিডেন্সি কলেজকে আর চারটে সরকারি কলেজের মতো দেখতে গিয়ে তৎকালীন বাম সরকার একে একে প্রেসিডেন্সির বিখ্যাত শিক্ষকদের অন্যান্য কলেজে বদলি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। তাতে তিতিবিরক্ত হয়ে সেই শিক্ষকদের অনেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। যাদবপুরের ইংরেজি বিভাগ বা তুলনামূলক সাহিত্যের মতো বিভাগ সেই শিক্ষকদের আলোকে আলোকিত হয়। প্রেসিডেন্সির সেই গৌরব তখনই শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু সরকারি নীতির কল্যাণে গৌরবের শেষের শুরু হয়েছে তখনই। তার পরে বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলে সেই প্রেসিডেন্সি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিয়ে, প্রেসিডেন্সিরই কয়েকজন বিখ্যাত প্রাক্তনীদের নিয়ে পরামর্শদাতা কমিটি গড়ে, সরকারের স্নেহধন্য ও তাঁবেদার একজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় বসিয়ে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার স্বপ্ন দেখিয়ে পুরো ব্যবস্থাকে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেটি না হয়েছে হাতি না ঘোড়া। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির তালিকায় প্রেসিডেন্সিকে আর দেখা যায় না।
যেখানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এখন খবরের শিরোনামে সেখানে প্রেসিডেন্সিকে টেনে আনার একটাই কারণ। সরকারি বদান্যতায় এবং অতি-হস্তক্ষেপে নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কী হাল হয়, তা প্রেসিডেন্সি দেখিয়েছে। ভয় হয়, এবার পালা যাদবপুরের।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যু দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক যন্ত্র কতটা অকেজো ছিল। হস্টেলে প্রাক্তন ছাত্ররা গেস্ট হিসেবে থাকে, সেখানে র্যাগিং এখনও হয়, তাতে নতুন ছাত্রদের হেনস্থা হতে হয় — এসব বাইরের লোকেদের জানা না থাকতে পারে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জানা ছিল না এটি কখনই বিশ্বাসযোগ্য নয়। গোদা কথায়, জেনে বুঝেও কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
আরও পড়ুন-র্যাগিং চলছে, চলবে…
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ছাত্রটিকে ‘মার্ক্সবাদীরা’ মেরেছে। মানে তৃণমূল সরকারের আমলে যাদবপুরের মেন হস্টেল একটি দ্বীপের মতো অবস্থান করছে। শাসক দল যেখানে এক ইঞ্চি জমি ছাড়ে না, সেখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই 'মার্ক্সবাদীরা' রাজত্ব করতে পারে! অপরাধ হলেও সরকার বা পুলিশ-প্রশাসন মায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে না। রাজ্যের বিরোধী দলগুলির নেতাদের তো এই সব 'মার্ক্সবাদীদের' কাছে ক্লাস করা উচিত!
এই ঘোলা জলে কিছু প্রসঙ্গ উঠে আসছে। যেমন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মদ-গাঁজার ঠেক। সেখানে বহিরাগতদের আনাগোনা যত্রতত্র। ক্যাম্পাসের ভিতরে সারে সারে বোতল সাজানো ছবিও পোস্ট হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। এ সবের জন্য দায়ী করা হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরার অভাব। এমনকী এই সেদিন পর্যন্ত যিনি উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে গেলেন (টানা ন'বছর) তিনিও ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা বসাতে না পারাকেই যেন দায়ী করেছেন দেখলাম। আর হস্টেল যেন তাঁর দায়িত্বের মধ্যেই ছিল না। কারণ, ওটা স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার বোর্ডের আওতায় আসে।
মানে ক্যাম্পাসের সর্বোচ্চ পদাধিকারী এমনই দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে এমনই শক্তিশালী গোষ্ঠী রয়েছে যাঁদের তিনি বাগে আনতেই পারেননি। ওঁকে ছাত্রদরদি দক্ষ প্রশাসক বলেই ভাবতাম। সে ধারণা ভেঙে গেল। তিনি শুধু ঠেকা দিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন এতগুলো বছর।
আরও একটি প্রসঙ্গ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় হচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উন্নাসিকতা ও ফেক-বিপ্লবীদের নিয়ে। যাঁরা যাদবপুরে পড়ার সুযোগ পায়নি, তাঁরা গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিচ্ছে এ সুযোগে। এ খানিকটা সামাজিক হিংসার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু কিছু করারও নেই। হাতি কাদায় পড়লে এসব হবেই। তার সুযোগ যাদবপুরের একদল ছাত্রছাত্রীই করে দিয়েছে।
যে রাজ্যটি চলছেই আবগারি দফতরের রাজস্ব আদায়ের টাকায় এবং যে রাজ্যের অধিকাংশ জায়গায় সন্ধের পরেই প্রকাশ্যে রাস্তার ধারে ধারে মদের ঠেক বসে যায়, সেখানে যাদবপুর নিয়ে এই নীতিপুলিশি হাস্যকর। রাজ্যের অন্যান্য কলেজগুলির অরাজকতার দিকে এখন কারও মন দেওয়ার সময় নেই। সব ছেড়ে বেড়ে ব্যাটাকে ধর! স্বাভাবিক। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এত গর্বিত সবাই, সেখানেও এই পরিবেশের হদিশ পেলে তা খোরাক তো হবেই।
আরও একটি বিষয় নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে যে, যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে বাম বা অতিবাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে শেষে লক্ষ লক্ষ টাকার চাকরি নিয়ে হয় বিদেশে বা দেশে কর্পোরেট সংস্থার চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ে। এরা পুঁজিপতি। যে ছাত্র বাম রাজনীতি করল, সে পুঁজিবাদের বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ছাত্রজীবন শেষে এই পুঁজিবাদীদের দালাল কীভাবে হতে পারে সে!
এর মোদ্দা কথা হলো, এই ভেকধারী বামপন্থী ছাত্রদের হটাও!
২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জমিবিরোধী আন্দোলন করল, কেউ কেউ যখন অতিবাম নকশাল বা মাওবাদী দলে নাম লিখিয়ে বন্দুক ধরল — তখন সবাই সাধুপুরুষ ছিল। এখন তখ্ত বদলে গেছে বলে এরা সবাই খারাপ হয়ে গেল। নকশালপন্থী রাজনীতি করে আসা নেতা-নেত্রীরা যখন দক্ষিণপন্থী দলের এমপি, এমএলএ ও নেতা হয়ে যাচ্ছে তখন কোনও দোষ দেখা যাচ্ছে না। যত দোষ এখন নন্দ ঘোষের!
আরও পড়ুন- সিগারেটের ছ্যাঁকা থেকে বেধড়ক মার! ব়্যাগিংয়ের নামে যা চলে দেশের এই কলেজ-হস্টেলে…
আসলে মূল বিষয়টি থেকে আমরা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছি। যে যার মতো করে মনের ঝাল মেটাচ্ছে। সিসিটিভির নজরদারি, বহিরাগতদের আটকানোর চেষ্টা চলছে। নিয়ন্ত্রণ দরকার। তবে তা গায়ের ঝাল মেটাতে নয়। প্রেসিডেন্সিতেও একই ধরনের নিয়ন্ত্রণ হয়েছে। ছাত্রদের আড্ডার জায়গা প্রমোদদার ক্যান্টিনও আর নেই। কলেজও পুরনো ধুলো ঝেড়ে নতুন রূপ ও রঙে সেজেছে। তাতে শিক্ষার মানের কী হয়েছে — খবর রাখেন কেউ?
যাদবপুর নিয়ে এসব আলোচনায় একটা আলেখ্য তৈরি হচ্ছে বাংলার রাজনৈতিক পরিসরে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় যখন সরকারি খবরদারির বাইরে থেকেও ভালো কিছু করতে পারছে না, তাহলে এবার সরকারি খবরদারি শুরু করে দাও। গত ১২ বছরে তার চেষ্টা তো কম হয়নি! তৃণমূল ছাত্র পরিষদের শাখা খোলার চেষ্টা থেকে, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা — কিছুই বাকি থাকেনি।
এবার আরও একটা মওকা এসেছে। হাতছাড়া করা যাবে না। তাই হঠাৎ ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে উঠে আসা এক ছাত্রীর হাতে ব্যাটন তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসের বাইরে জোর মারপিট হচ্ছে। মিডিয়াতেও সেই আলোচনাই তুঙ্গে। সঙ্ঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন ও বিজেপির নেতারাও এই প্রক্রিয়ায় যোগ্য সঙ্গত দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের ভাগ্যেও আজ না হলে কাল শিঁকে ছিঁড়বে। সুতরাং লেগে থাকো।
আসলে যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সিতে ছাত্রদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাবই শাসকের গায়ে জ্বর এনে দেয়। তা বাম ও ডান — দুই জমানাতেই সত্যি। ওই অতিবাম রাজনীতি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বই কিছু নয়। ছাত্র সমাজ শাসকের বিরুদ্ধে মুখ ও মাথা তুলে কথা বলবে, প্রশ্ন করবে এটাই কাম্য। শাসক দলের ছাত্র সংগঠন তা করবে না। মূল ধারার ছাত্র সংগঠনগুলিও রাজনীতির বাঁধা গতেই চলবে। কিন্তু রাজ্যে ও দেশে সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ও প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করার সংস্কৃতিটাই উঠে যাচ্ছে।
এ রাজ্যে কতদিন ধরে কলেজগুলির ছাত্র ইউনিয়নের ভোট হয়নি কেউ খেয়াল রেখেছেন? কলেজ ইউনিয়নের ভোট মানেই গণ্ডগোল, সুতরাং এটা না করাই ভালো — আমরা এটাই নিজেদের বুঝিয়েছি। ঠিক এভাবেই আমরা নিজেদের বুঝিয়ে নেব — যাদবপুরে সরকার-পুলিশ-প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়ুক। এমনিতে তো কিছুই হচ্ছে না। ওই উন্নাসিক ছেলেমেয়েদের এবার শিক্ষা হওয়া প্রয়োজন। এই যুক্তিজালে আমরা বুঝতে পারব না, যেটুকু ভালো হচ্ছে তাও আর হবে না। যেমন প্রেসিডেন্সিতে হয়নি।
আরও পড়ুন- যাদবপুরের র্যাগিং সংস্কৃতি: মুখে বিপ্লব বুলি, রাত বাড়লেই শুরু দাদাগিরি
উচ্চশিক্ষাতে উৎকর্ষ থাকবে না, কোনও উৎকর্ষের প্রতিষ্ঠান থাকবে না — বাম আমলের সেই ধারাই ভুল ছিল। তা অনেক ক্ষতি করেছে। এখনও করছে। ভবিষ্যতেও করবে। সব কিছুকে রাজনীতির বেড়াজালে বাঁধলে চলে না। অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ বা হার্ভার্ডে একদল মেধাবী ছেলেমেয়েই জায়গা পাবে। তার মানে এই নয় যে এখানে যারা পড়তে পারে না, তারা মেধাবী নয়। এর বাইরেও অনেক মেধাবী মানুষ স্বক্ষেত্রে নিজেদের পরিচয় ইতিহাসের পাতায় গেঁথে রেখেছেন। যাদবপুরের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি তাই। কেউ সুযোগ পেয়েছেন, কেউ পাননি। যাঁরা সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা মেধা পরীক্ষায় পাস করেই সুযোগ পেয়েছেন। 'মেধা তালিকা থেকে ছাঁটাইয়ের' পরীক্ষায় অনেকেই বেড়া টপকাতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মেধাবী ছাত্রছাত্রী নিশ্চয়ই রয়েছে।
মনে রাখবেন, বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি খবরদারি বাড়িয়ে অন্য সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ করার প্রতিযোগিতায় কোনও রাজনীতিক নামেননি (যদিও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে অনেক আলাদা)। এখানে আমরা এর দেদার সুযোগ করে দিই।
সুতরাং এই ঘোলা জলের বিষয়গুলি সরিয়ে রেখে মূল বিষয়ে জোর দেওয়া দরকার। একটি ছাত্রের র্যাগিং হয়েছে। এই কুপ্রথা এখনও নির্মূল হয়নি। ছাত্রটির মৃত্যু অনেক ফাঁপা জায়গা দেখিয়ে দিয়েছে। যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক গাফিলতির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা হোক। অবাক লাগে এই গাফিলতি ঢেকেই কীভাবে এনআরএফ বা ন্যাকের র্যাঙ্কিংয়ে উপরের দিকে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি! একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্য না থাকলে এবং তা নিয়ে সরকার ও রাজ্যপাল ঝগড়া করতে থাকলে কী হয়, যাদবপুর দেখিয়েছে। এই সব বিষয়ে বেশি নজরদারি দরকার। রাজনীতির আলখ্যে ভেসে গেলে মূল বিষয়গুলি আলোচনার বাইরেই থেকে যাবে।
রাজ্যের নাগরিক হিসেবে এটা দেখা আমাদের কর্তব্য যে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উৎকর্ষকে রাজনীতির জালে বেঁধে ফেলে সর্বনাশ যেন না করা হয়। তাহলে যাদবপুরও প্রেসিডেন্সি হবে অচিরেই।