জ্বরের জন্য ১৪ দিনের নিভৃতবাসে থাকতে হয় জগন্নাথকেও! জেনে নিন পৌরাণিক কোয়ারেন্টাইনের গল্প
ভারতে কোয়ারেন্টাইনের ইতিহাস অনেক অনেকদিনের পুরনো। এমনকী, পুরীর জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে পর্যন্ত প্রতি বছর ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। আজ সেই ইতিহাসের গল্প করি চলুন।
প্রায় এক শতক পরে মানুষ ফের ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দটার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠল। প্লেগের পর সম্ভবত আমজনতার যৌথ মানস থেকে এ-জিনিস একেবারেই মুছে গিয়েছিল। আবার তাকে ফিরিয়ে আনল করোনা অতিমারী। বসন্ত, প্লেগ, ফ্লু বা করোনার মতো ছোঁয়াচে রোগের অন্যতম নিদান হল নিভৃতবাস বা কোয়ারেন্টাইন। অতিমারীর কালে ‘সেলফ-কোয়ারেন্টাইন’ বা ‘হোম আইসোলেশন’- ইত্যাদি নানাবিধ টার্ম আমরা শুনলাম। অতিমারীর ছোঁয়া বাঁচাতে লকডাউন হয়েছে বারবারে। উপসর্গ দেখা দিলেই হপ্তাদুয়েকের জন্য একান্তবাস। মোটামুটি মিডিয়া এবং আশেপাশের করোনায় ভুগে ওঠা মানুষদের কাছে শুনে শুনে পদ্ধতিটিও আমরা বেশ জেনে গিয়েছি এখন। কিন্তু এই কোয়ারেন্টাইনের ধারণা কি নতুন? না, ভারতে এর ইতিহাস অনেক অনেকদিনের পুরনো। এমনকী, পুরীর জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রাকে পর্যন্ত প্রতি বছর ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। আজ সেই ইতিহাসের গল্প করি চলুন।
পুরী তখন মালবরাজ্য। জগন্নাথের স্বপ্ন পেয়ে নিমকাঠের অপেক্ষা করছিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। অবশেষে তা ভেসে এল সাগরের জলে। দারুব্রহ্ম পেয়ে রাজা সেই কাঠ দিয়ে জগন্নাথ বিগ্রহ বানানোর দিকে মন দিলেন। দিক দিক থেকে শ্রেষ্ঠ সব ছুতোর ও কারিগরদের ডেকে আনা হলো। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। দারুব্রহ্মের গায়ে ছেনি পড়েছে কি পড়েনি ছেনির মাথা যায় গুঁড়ো হয়ে। তখন জগন্নাথ নিজে ছুতোর হয়ে এলেন।
রাজাকে বললেন, 'আমার নাম অনন্ত মহারাণা। এ কাজ আমি ছাড়া কেউ করতে পারবে না, কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। আমাকে একটা বড় ঘর দিতে হবে বিগ্রহ নির্মাণের জন্য। একুশ দিন সময় দিতে হবে। এই একুশ দিন সে ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি কাজ করব। সেসময় এই ঘরে যেন কেউ না আসে। দরজা খোলা যাবে না।' যেসব ছুতোররা দূর-দূরান্ত থেকে এসেছিল, তাদেরও নিরাশ করলেন না অনন্ত। রাজাকে বললেন, 'আমার আগে যাঁরা এসেছিল, তাঁদের বলুন তিনটি বিগ্রহের জন্য তিনটি রথ তৈরি করতে করতে।'
আরও পড়ুন: কোন তিন রথে চেপে মাসির বাড়ি যাবেন জগন্নাথ?
রাজা রাজি হলেন। একটি বড় ঘর তাঁকে দেওয়া হল। দারুব্রহ্ম এনে রাখা হল সেই ঘরে। ঘরে ঢুকে একুশদিনের জন্য দরজা বন্ধ করে দিলেন অনন্ত। বাইরে বসানো হল কড়া পাহারা, যাতে কেউ না ঢুকতে পারে। কাজ চলতে লাগল। এদিকে রানি গুন্ডিচার মন উচাটন। তার কৌতূহল এই গোপনীয়তায় মাত্রাছাড়া হয়ে উঠল। কিছুতেই তাকে দমানো যায় না। একবার দেখলে কি কারিগর রাগ করবেন? একবারটি দেখব! আচ্ছা বাইরে থেকে ছেনি-হাতুড়ির শব্দটুকুই শুনব না হয়! এই ভেবে চোদ্দো দিনের মাথায় আর থাকতে না পেরে সেই ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন গুণ্ডিচা। দরজায় কান পাতলেন। এ কী! ভেতরে তো আওয়াজ নেই কোনও। থাকতে না পেরে দরজা খুলে দৌড়ে ভেতরে ঢুকলেন রানি। তাঁর চোখের সামনে থেকে অনন্ত মহারাণা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। বিগ্রহ যতটুকু হয়েছিল, পড়ে থাকল সেটুকু হয়েই। সেই অর্ধসমাপ্ত তিনটি বিগ্রহ দেখে রানি উঠলেন আঁতকে। এ কেমন বিগ্রহ! জগন্নাথের অমন শ্যাম চেহারার সঙ্গে কুচকুচে কালো রঙ, গোল গোল চোখ, হাত-পা নেই– এমন এক বিগ্রহকে মেলাতে পারছিলেন না তিনি কিছুতেই। খবর শুনে রাজা ছুটে এলেন। বিগ্রহ দেখে তিনিও স্তম্ভিত। রানিকে বহু তিরস্কার করলেন শর্তভঙ্গের জন্য। তবে ব্যাপার শুনে বিচক্ষণ মন্ত্রী বলল, এ কারিগর মানুষ নয়, নিশ্চয় কোনও দেবতা। সেই রাতে জগন্নাথ ফের দেখা দিলেন ইন্দ্রদ্যুম্নকে। বললেন, 'তোমার শর্তভঙ্গেই বিগ্রহ এমন হয়েছে। এ মূর্তিতেই পুজো নেব আমি।' প্রতিষ্ঠিত হলো বলরাম সুভদ্রা ও জগন্নাথের অসমাপ্ত বিগ্রহ। কিন্তু যেহেতু রানির কৌতূহলে বিগ্রহ সম্পূর্ণ হয়নি, তাই রথের হপ্তাদুয়েক আগেই ভালো করে স্নান করিয়ে বিগ্রহ শুদ্ধি করার নিদান দিলেন জগন্নাথ।
এই স্নান করার ঘটনাকেই বলা হয় স্নানযাত্রা। উড়িষ্যাতে এটি আনসারা নামে পরিচিত। অনেকের মতে গরমের হাত থেকে ঠাকুরকে বাঁচাতেই স্নান করানো হয়ে থাকে। প্রতি বছর জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম পূর্ণিমাতেই জগন্নাথের স্নানযাত্রায় আয়োজন হয় মহাসমারোহে। মন্দিরের ভেতর থেকে বিগ্রহ নিয়ে আসা হয় স্নান-মণ্ডপে। তারপরে সুগন্ধি জলে স্নান করেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। যে কুয়োর জলে বিগ্রহ স্নান করানো হয়, তা বছরে খোলা হয় এই একটি বারই। জল বের করে আবার ঢেকে দেওয়া হয় কুয়োর মুখ। স্নানের সঙ্গে সঙ্গে সাজিয়ে তোলা হয় বিগ্রহকে। ১০৮ ঘড়া জলে স্নানের পর বিশ্রাম। এরপরই সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হন তিন ভাই-বোন। তখন তাঁদের পাঠানো হয় একান্তবাসে তথা কোয়ারেন্টাইনে। ভক্তরা ঠাকুরের দেখা পান না এই ক'দিন একেবারেই। যে কক্ষে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে রাখা হয় তার নাম আনসারা কক্ষ। ছাপ্পান্ন ভোগের বদলে এসময় অসুখের উপযোগী সহজপাচ্য খাবার ফল, ফলের রস, তরল পদার্থ ইত্যাদি দেওয়া হয় তাঁদের।
আয়ুর্বেদ মতে চিকিৎসাও চলে সঙ্গে সঙ্গে। রত্নজড়িত বস্ত্রের বদলে সুতির কাপড় পরানো হয়। গয়নাগাটিও খুলে রাখা হয় এই সময়। অসুখের পঞ্চম দিন বড় ওড়িয়া মঠ থেকে ফুলেরি তেল আসে, যা দিয়ে হালকা মালিশ করা হয়। এরপর রক্তচন্দন ও কস্তুরির প্রলেপ লাগানো হয়। এ সময়ও খাবার দেওয়া হয় একদমই হালকা– দুধ, ফলের রস এবং কিছু আয়ুর্বেদিক ওষুধপত্র। দশম দিনে দশমুলারিষ্ঠে নিম, হলুদ, বহেড়া, লং ইত্যাদি জড়িবুটির জল দিয়ে নরম মোদক বানিয়ে খেতে দেওয়া হয়। একে জগন্নাথের ‘জ্বরলীলা’ বলে থাকেন ভক্তেরা। যেমন কোনও বাচ্চা ছেলে অতিরিক্ত জলে চান করলে জ্বরে পড়ে, তার বিশেষ খেয়াল রাখা হয়, এসময় একেবারে সেভাবেই দেখা হয় ভগবানকে। জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা অবধি সেবা পেয়ে রথযাত্রার একদিন আগে মন্দিরের গর্ভগৃহে ফেরেন ভগবান। এরপর তিন ভাই-বোন রথে চেপে মাসির সঙ্গে দেখা করতে যান। নদিন মাসির বাড়িতে থেকে ফের পুরীর মন্দিরে ফিরে আসেন তাঁরা।