ইরফানের উত্তরসূরি! সেনার পরীক্ষায় বারেবারে ব্যর্থ, অভিনয়ে জিতেছেন জয়দীপ আহলাওয়াত

Jaideep Ahlawat: কম্বাইন্ড ডিফেন্স সার্ভিসেসে বারেবারেই ব্যর্থ হয়ে জয়দীপ প্রচণ্ড রেগেছিলেন নিজের উপর। সেই সময়ই থিয়েটারে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পান তিনি।

শাহিদ খানকে মনে আছে? কোলিয়ারিতে কাজ করা পেটানো চেহারার শ্রমিক। সিনেমার পর্দায় কালো মুখ, রক্তে ভেসে যাওয়া ঠোঁট, দাঁত আর তীক্ষ্ণ চোখ মনে করিয়ে দেয় শাহিদ খানের চরিত্রকে। সর্দার খানের বাবা, ফয়জল খানের দাদা। "বাপ কা, দাদা কা, ভাই কা, সবকা বদলা" নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ফয়জল বুড়িয়ে যাওয়া মা নাগমাকে। নাগমা হয়েছিলেন অভিনেত্রী রিচা চাড্ডা। অঙ্কের মাস্টার নরেন ভ্যাসকে মনে আছে? প্রতিবেশী মা-মেয়েকে বাঁচিয়ে ঠান্ডা মাথায় লাশ লোপাট করতে পেরেছিলেন যে শিক্ষক! সর্দার খান, নরেন ভ্যাসকে মনে না পড়লে পাতাললোকের ইন্সপেক্টর হাতিরাম চৌধুরীকে নিশ্চয়ই মনে আছে? সিজন ২-এ যে চরিত্রটির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেননি ভক্তরা! সমস্ত চরিত্রের অভিনেত জয়দীপ আহলাওয়াত। যত বয়স বেড়েছে, কাজ বেড়েছে ততই সূক্ষ্ম হয়েছে তাঁর অভিনয়। চোখ, শরীর, আঙুল, অমসৃণ গাল সবই অভিনেতার কথা শুনে চলে। ওটিটি-র সৌজন্যে যে অনাবিষ্কৃত তারকাদের আমরা পেয়েছি, জয়দীপ তাঁদেরই একজন।

সিনেমা, সিরিজে এই মুহূর্তে অনেকেই জয়দীপকে তুলনা করছেন প্রয়াত আরেক অসামান্য অভিনেতা ইরফান খানের সঙ্গে। জয়দীপ আহলাওয়াতের বলিউডে প্রবেশের নেপথ্যের গল্প নিয়ে অবশ্য খুব কমই চর্চা হয়েছে। সামাজিক সাফল্যের মধ্যবিত্ত মাপকাঠিতে কিন্তু অনেকের মতোই জয়দীপও একজন 'ব্যর্থ' মানুষ। নানা সাক্ষাত্কারে জয়দীপ জানিয়েছিলেন, সার্ভিস সিলেকশন বোর্ডের পরীক্ষা দিয়ে সেনাবাহিনীতে কাজ করবেন ভেবেছিলেন অভিনেতা। তবে একাধিক চেষ্টার পরেও উত্তীর্ণ হননি, ব্যর্থ হয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন।

আরও পড়ুন- দিনে ২৫০ টাকার কাজ থেকে অস্কার! অবাক করবে লাপাতা লেডিজ-এর মঞ্জু মাইয়ের কাহিনি

হরিয়ানার রোহতকে বড় হয়ে উঠেছেন জয়দীপ। সিনেমা জগতের বাইরের মানুষ। ইংরাজিতে স্নাতকোত্তর পাশ করে পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তিনি। তাঁর ব্যাচমেটদের অনেকেই- রাজকুমার রাও, বিজয় ভার্মা আজ তাঁরই মতো বিশেষ নজর কাড়ছেন অভিনয়ে। জয়দীপ বারেবারেই নিজের প্রয়াত বাবার অদম্য সমর্থনের কথা স্বীকার করেছেন। অন্য সব কাজে ব্যর্থ হওয়ার পরে অভিনয় নিয়ে এগিয়ে যেতে সাহস দিয়েছিলেন বাবাই। বলেছিলেন, "এখানেও ফেল করলে চাষবাস করবি।" জয়দীপের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল পঞ্জাবে নাটক এবং মঞ্চাভিনয় দিয়েই। পরে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়াতে (এফটিআইআই) যোগ দেন, মুম্বইয়ে চলে যান।

শুরুর দিকে সবার যাত্রাই কঠিন থাকে। তবে জয়দীপ আহলাওয়াতের দৃঢ় সংকল্প তাঁকে ক্রমেই সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর (২০১২), কমান্ডো (২০১৩), রাজি (২০১৮), পাতাল লোক (২০২০) এবং জানে জান (২০২৩) সিনেমা ও সিরিজে তাঁর অভিনয় দক্ষতা দেখে হাঁ হয়ে যেতে হয়। জয়দীপ বরাবরই অন্তর্মুখী মানুষ। বরাবরই রাগ ছিল বেশি। নিজেই স্বীকার করেছেন, “অভিনয় আমার মধ্যে দু'টি জিনিস পরিবর্তন করেছে। আমি এখনও অল্পে মেজাজ হারাই কিন্তু আমি অনেক শান্ত হয়েছি এবং আমি আর জাজমেন্টাল নই।"

কম্বাইন্ড ডিফেন্স সার্ভিসেসে বারেবারেই ব্যর্থ হয়ে জয়দীপ প্রচণ্ড রেগেছিলেন নিজের উপর। সেই সময়ই থিয়েটারে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পান তিনি। বাবা-মা কৃষক হওয়ার পাশাপাশি স্কুল শিক্ষকও ছিলেন। তাই, ছেলের মধ্যে সাহিত্যের প্রতি ভালো লাগা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ জয়দীপকে থিয়েটারের সূক্ষ্ম গলিঘুঁজি আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করেছিল। নাট্য পরিচালক সুনীল চিতকারার পরামর্শেই, এফটিআইআই-তে যান জয়দীপ।

আরও পড়ুন- মাত্র ১০ হাজারের বিনিময়ে এক দিনের রোল! যে ভাবে ‘বনরাকস’ হয়ে উঠেছিলেন দুর্গেশ কুমার

প্রিয়দর্শনের দু'টি চলচ্চিত্র দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন জয়দীপ- অ্যাকশন থ্রিলার আক্রোশ (২০১০) এবং কমেডি খাট্টা মিঠা (২০১০)। এছাড়াও রণবীর কাপুর-অভিনীত রকস্টার (২০১১), এবং বেদব্রত পাইনের চিটাগং (২০১২) সিনেমাতেও ছোট ভূমিকায় অভিনয় করেন জয়দীপ।

তারপর ২০১২ সালেই অনুরাগ কাশ্যপের কাল্ট সিনেমা গ্যাংস অফ ওয়াসেপুরে শাহিদ খানের ভূমিকায় জয়দীপ আহলাওয়াতের অভিনয় চলচ্চিত্র সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন তো করেই, তাঁর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। অবিনাশ অরুণ ধাওয়ারে এবং প্রসিত রায়ের ক্রাইম থ্রিলার ওয়েব সিরিজ পাতাল লোক (২০২০)-এ হাতিরাম চৌধুরীর ভূমিকায় অভিনয় করে জয়দীপ আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সেনাবাহিনীর পরীক্ষায় ব্যর্থ না হলে, অভিনয়ে এমন সহজ সুন্দর রত্নকে পেতই না দেশ। যে রত্ন অমন তাগড়াই চেহারা নিয়েও কুঁকড়ে থাকা পুলিশ সাজতে পারেন, নির্লিপ্ত মাস্টারমশাই সাজতে পারেন, ডাকাবুকো শ্রমিক সাজতে পারেন। আসলে সাজেন না, নিজের ভেতর থেকে খুঁড়ে আনেন সেই সব সূক্ষ্ম চেতনাগুলি, যা সম্ভবত সামাজিক 'ব্যর্থতাই' তাঁকে উপহার দিয়ে গেছে।

More Articles