চাকদহ থেকে মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক, ঝুলন গোস্বামী অনুপ্রেরণার অন্য নাম

১৯৯৭ মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল, ইডেন গার্ডেনে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া। বেলিন্ডা ক্লার্কের ব্যাটের উপর ভর করে সেদিন নিউজিল্যান্ডকে ৫ উইকেটে পরাস্ত করে বিশ্বকাপ গড়ে তুলেছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু, সেদিনের সেই ফাইনালেই ক্রিকেটের হবার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাউন্ডারির বাইরে দাঁড়িয়েছিল এক তরুণী। ১৯৯৭ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের ওই বল গার্ল মেয়েটিই আজ পরিচিত চাকদা এক্সপ্রেস নামে। তার বিষাক্ত পেসের আঘাতে ছত্রখান হয়ে যায় বিপক্ষের রক্ষণ। তার পারফরম্যান্সকে কুর্ণিশ জানাতে বাধ্য হয় তাবড় তাবড় পুরুষ ক্রিকেটাররাও। তিনি হলেন ভারতীয় মহিলা দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ঝুলন গোস্বামী। 

শুধুমাত্র একজন ভাল বোলার কিংবা একজন ভালো অলরাউন্ডার নয়, একজন দুর্দান্ত ক্রীড়াবিদ হিসেবেও তার জনপ্রিয়তা রয়েছে সারা বিশ্বে। ভারতের মহিলা ক্রিকেটের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক। উদীয়মান মহিলা ক্রিকেটারদের জন্য তিনি একজন অনুপ্রেরণা। তার অসাধারণ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে দীর্ঘ বহু বছর ধরে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছেন ঝুলন গোস্বামী। স্মৃতি মান্ধানা, হারলিন দেওলের মত ক্রিকেটাররাও তৈরি হয়েছেন তাঁর হাতেই। 

ঝুলন ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন ক্রিকেট খুব একটা লাভজনক ছিল না। তেমন কোনো বিজ্ঞাপন কিংবা সোশ্যাল মিডিয়া পোষ্টের বালাই ছিল না সেই সময়। কোন ডোমেস্টিক লিগেও পাওয়া যেত না যথেষ্ট পরিমাণ টাকা। উপরন্তু, লিঙ্গ বৈষম্য তো ছিলই। কিন্তু, কোন কিছুই ঝুলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রশিক্ষণের অভাব হোক কিংবা বৈষম্য, সবকিছুকে অতিক্রম করেই আজ বিশ্ব ক্রিকেটে একজন অন্যতম তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন ঝুলন গোস্বামী। তবে, তার এই সাফল্যের শিখরে ওঠার জার্নিতে রয়েছে একাধিক ওঠা পড়া। নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আজ তিনি এই জায়গায় পৌঁছেছেন। তাঁর জীবনের এই গল্পের কাছে বলিউডের সিনেমাও কিছুটা ফিকে। 

নদিয়া জেলার চাকদা শহরে জন্ম ঝুলন গোস্বামীর। মফস্বলের সাধারণ একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হলেও ছোট থেকেই তার শখ ছিল ফুটবল এবং ক্রিকেট খেলার। ছোটবেলায়, বন্ধু এবং ভাই বন্ধুদের সঙ্গে টেনিস বলের ক্রিকেট খেলেই কেটেছে তার শৈশবটা। কিন্তু, ১৯৯৭ সালের অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপ ফাইনালের ঐ ম্যাচটা যেন জীবন ঘুরিয়ে দিল। তৎকালীন অজি মহিলা দলের অধিনায়ক বেলিন্ডা ক্লার্কের পারফরম্যান্সে তিনি এতটাই উদ্বুদ্ধ হলেন যে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ক্রিকেটার হতেই হবে। তারপরেই শুরু হলো, তাঁর ক্রিকেটার হওয়ার জার্নি। সপ্তাহে তিন দিন করে ভোর সাড়ে চারটের সময় উঠে চাকদা থেকে কলকাতার ট্রেন ধরতেন ঝুলন। তারপর শিয়ালদা স্টেশনে নেমে, সেখান থেকে দক্ষিণ কলকাতায় বিবেকানন্দ পার্কে অনুশীলন করতে যেতেন তিনি। সাড়ে ৯ টা পর্যন্ত চলত অনুশীলন। ফের একই সময় যাত্রা করে বাড়ি গিয়ে স্কুল। এভাবেই চলছিল বেশ কয়েক বছর।

কিন্তু স্কুলের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছিল এই ক্রিকেটের কারণে। পরিবারের তরফ থেকেও পড়াশোনার জন্য চাপ দেওয়া শুরু হলো। কিন্তু সেই সময়ে ঝুলনকে সাহায্য করতে তার বাড়িতে হাজির হলেন তার প্রশিক্ষক স্বপন সাধু। তারপর থেকে তাকে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হল না। কলকাতায় ট্রেনিং শেষ করার পরেই পশ্চিমবঙ্গের মহিলা ক্রিকেট দলে খেলার ডাক পেলেন ঝুলন। এই ছোট বয়সেই তার মধ্যে একজন বড় ক্রিকেটারকে লক্ষ্য করে নিয়েছিলেন তাঁর প্রশিক্ষক। সাধারণ প্রাক্টিস সেশন শেষ হয়ে গেলে, ঝুলন আরো ৫ থেকে ৬ ওভার অতিরিক্ত বল করতেন, আরো ভালো করার তাগিদেই।

১২০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে বল করে প্রথম ম্যাচেই সকলকে চমকে দিয়েছিলেন ঝুলন। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগটাও তিনি পেয়েছিলেন খুব কম বয়সেই। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চেন্নাইয়ে অভিষেক হয় ঝুলনের। ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে খুব একটা ভালো পারফরমেন্স না করলেও, পরবর্তীতে নিজেকে আরো ভালোভাবে তৈরি করেন ঝুলন। তবে তার ক্রিকেট জীবনের সবথেকে সেরা সময়টা শুরু হয় ২০০৫ থেকে। এই বছরেই বিশ্বকাপে যায় ভারতীয় মহিলা দল। ২০০৬-০৭ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাদের হোম গ্রাউন্ডে প্রথম টেস্ট জয় ভারতীয় মহিলা দলের। আর সেখানেই নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করে ফেলেন ঝুলন। ২০০৭ সালে নির্বাচিত হন আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে। সেই বছর ভারতের সমস্ত পুরুষ ক্রিকেটারদেরও পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন চাকদা এক্সপ্রেস। 

২০০৮ সালে তার কাঁধে আসে অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব। ২০১১ পর্যন্ত ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। ২০১৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে যাওয়া ভারতীয় দলে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল ঝুলন গোস্বামীকে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দল খারাপ ফলাফল করলেও তিনি তার বোলিং এর মাধ্যমে সকলের মন জয় করেছিলেন। একটা সময় তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহিলা বোলার। ২০১৮ সালে এক দিবসীয় ক্রিকেটে ২০০ উইকেট এর অধিকারী প্রথম মহিলা ক্রিকেটার হয়েছিলেন ঝুলন। 

একটা সময় তিনি যখন তার সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে টেনিস বল ক্রিকেট খেলতেন সেই সময় তাঁকে সবাই তাঁর গতির জন্য উপহাস করত। সেই গতিকেই কাজে লাগিয়ে আজ তিনি হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। ২০০০ এর সময়টায় মহিলাদের জন্য কোন খেলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা কার্যত অভাবনীয় ছিল। কিন্তু সেই সময় নিজের প্রতিভার উপর সাহস রেখে ক্রিকেটকে আপন করে নিয়েছিলেন ঝুলন।

খেলার ময়দানে লিঙ্গ বৈষম্যকে একেবারে ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি এবং তার মত কিছু মহিলা ক্রীড়াবিদ। ঝুলন যখন খেলা শুরু করেন সেই সময় ভারতীয় মহিলা দলের আলাদা করে কোন জার্সি হতো না। তখন মনে করা হতো, ভারতীয় মহিলা দল কিছুই করতে পারবেনা, যা করতে পারবে সেটা হল শুধুমাত্র পুরুষ দল। এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছিলেন ঝুলন। ২০০৬ সালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের সব থেকে দ্রুততম মহিলা পেসার। ২০০৭ সালে যেই বছর তিনি আইসিসি বর্ষসেরা ক্রিকেটার হয়েছিলেন, সেই বছর ভারতীয় পুরুষ দলের কোনো সদস্য আইসিসির একটা পুরষ্কারও জিততে পারেনি। 

অধিনায়ক হিসেবেও তার কৃতিত্ব আকর্ষণীয়। তার অভিনয় করতে ভারতীয় ক্রিকেট দল ২৫টি এক দিবসীয় ম্যাচের মধ্যে ১২ টিতে জয় লাভ করতে পেরেছিল। স্মল টাউন থেকে উঠে এসে তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে শাসন করেছেন ক্রিকেট বিশ্বকে। আজকেও ৩৯ বছর বয়সে ভারতের উঠতি মহিলা ক্রিকেটারদের জন্য ঝুলন গোস্বামী একজন অনুপ্রেরণা। ২০০ উইকেট এর চূড়ায় পৌঁছলেও অহং তাঁকে গ্রাস করেনি। বরং তিনি এই কৃতিত্বটা উৎসর্গ করেছেন তাঁর সতীর্থদের উদ্দেশ্যে। 

ফ্রেন্ডস ক্লাব, নবারুণ সমিতিতে ক্রিকেট জীবন শুরু করে একে একে বেঙ্গল উমেন্স, ইস্ট জোন উমেনস, এবং ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করে অনন্য নজির স্থাপন করেছেন ঝুলন। জীবন যুদ্ধে হেরে গিয়ে যেখানে অনেক মানুষ হতাশ হয়ে পড়েন, সেখানে কিছু মানুষ এমনও থাকেন যারা নিজেদের অদম্য সাহস এবং লড়াকু মানসিকতা নিয়ে ফিরে এসে জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছন। তাঁদের সাফল্যের কাহিনি অনুপ্রাণিত করে এরকমই লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে, যারা প্রতিনিয়ত ভাগ্যের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে চলেছেন। ঝুলন গোস্বামীর জীবন নতুন করে লড়াই করার, শূন্য থেকে শুরু করার সাহস দেয়।

More Articles