বামেদের স্বার্থপর আকচা-আকচিতেই জেএনইউতে জমি পাচ্ছে এবিভিপি?

JNUSU Election Results 2025: জেএনইউ-তে রাজনীতি করা সহজ না। প্রশাসন ও আরএসএস বহুভাবে চেষ্টা চালিয়েছে রাজনীতি বন্ধ করার।

সদ্য সমাপ্ত হলো জেএনইউ-এর ছাত্র সংসদ নির্বাচন। কেন্দ্রীয় প্যানেলের তিনটি আসনে জয়ী হয়েছে আইসা-ডিএসএফ-এর বামপন্থী জোট। আর ঠিক দশ বছর পর চতুর্থ সেন্ট্রাল প্যানেলটি জিতেছে আরএসএস-এর ছাত্রদল এবিভিপি! দশ বছর আগে, ২০১৫ সালে যখন এবিভিপি একটি পদ জিতেছিল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে, তারপরেই রাষ্ট্রের মদতে হামলা নেমে আসে জেএনইউ-এর ছাত্র সমাজের উপর। রাষ্ট্রদ্রোহিতার নামে ছাত্রদের গ্রেফতারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে গোদি মিডিয়ার সঞ্চালকদের রণহুঙ্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ে আরএসএস গুন্ডাবাহিনীর সরাসরি হামলা— এসব কিছুই শুরু হয় জেএনইউ থেকেই! পরবর্তী ১০ বছরে নানা বিশ্ববিদ্যালয়েই এই আক্রমণ চলেছে।

২০১৬ সালের ওই আক্রমণ একজোট হয়ে প্রতিহত করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মচারী এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা জেএনইউ-এর প্রাক্তনীরা। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশ বিদেশের অসংখ্য প্রগতিশীল মানুষই জেএনইউ-এর পাশে দাঁড়ান। সবাই বুঝেছিল, এই আক্রমণ শুধু একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর না বরং দেশের উচ্চশিক্ষা, মুক্তচিন্তা এবং শিক্ষাখাতে সরকারি খরচের উপর সরাসরি আক্রমণ।

আরও পড়ুন- আমরা কাশ্মীরের ‘আপনা আদমি’ হতে পারি না?

জেএনইউ-তে ছাত্রদের মধ্যে চিরকালই বামপন্থী ছাত্রদের প্রভাব সুস্পষ্ট। ১৯৯৮-৯৯ সালে এবিভিপি জিতলেও প্রথমে এসএফআই এবং পরবর্তীকালে আইসা ছাত্রসংসদে তাদের আধিক্য জারি রেখেছে। দিল্লি বা দেশের অন্যত্র যেভাবে বিপুল টাকার মাধ্যমে বা গায়ের জোরে গুন্ডামি করে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় তার থেকে একদমই আলাদা এবং প্রায় ব্যতিক্রমী হয় জেএনইউ-এর ছাত্র নির্বাচন। খুবই অল্প খরচে, শান্তিপূর্ণ ভোট হয় এবং রাজনীতি আর আদর্শগত লড়াই প্রাধান্য পায়। জাত-ধর্ম-অন্যান্য পরিচিতির কোনও প্রভাব থাকে না তা নয়, অবশ্যই থাকে কিন্তু রাজনীতি বা বৈচারিক লড়াইও পাশাপাশি চলে প্রবলভাবে এবং তার ফলেই আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ত এবিভিপি।

২০১৬-তে রাষ্ট্রীয় মদতে নেমে আসা আক্রমণের পর এবং তাকে একজোট হয়ে প্রতিহত করার পর, জেএনইউ-এর ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। ফ্যাসিবাদী বিজেপির বিরুদ্ধে সমস্ত প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্র সংগঠন একত্রে নির্বাচন লড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশের মূলস্রোতের বিপক্ষের দলেরা জোট বাঁধার অনেক আগেই, ছাত্ররা জোট তৈরির দূরদর্শিতা এবং পরিপক্বতা দেখায়। ফলস্বরূপ, পরবর্তী সব নির্বাচনেই এবিভিপি পর্যুদস্ত হয়।

এরপর করোনার সময় এবং তারপর তিন বছর নির্বাচন বন্ধ রাখে প্রশাসন. গত বছর দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলনের পর আবার চালু হয় নির্বাচন এবং আবারও বাম ছাত্র ঐক্য সব পদে জয়ী হয়।

বিগত দশ বছরে প্রশাসন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেছে জেএনইউ-এর গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো এবং তার মুক্তচিন্তা, স্বাধীন শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ভেঙে দেওয়ার। জেএনইউ-তে নিয়মিত শিক্ষাগত সংরক্ষণ লাগু হতো এবং বিশ্ববিদ্যালয়টির নিজস্ব কিছু স্বীকৃতিসূচক পদক্ষেপ ছিল। যেমন, ছাত্রীরা এবং দেশের প্রান্তিক জায়গা থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা প্রবেশিকা পরীক্ষায় বাড়তি নম্বর পেত। বিশ্ববিদ্যালয় এবং হস্টেলের ফি ছিল নামমাত্র। প্রবেশিকা পরীক্ষার সেন্টার দেশের বহু জায়গায় হতো যাতে দূর দূরান্তের ছাত্র ছাত্রীরাও সহজে পরীক্ষা দিতে পারে। এর ফলে ঐতিহাসিকভাবে খুবই প্রান্তিক সমাজ ও জায়গার ছাত্রছাত্রীরাও তাদের উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন সফল করতে পেরেছে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অনেক গরিব ঘরের ছাত্রছাত্রী জেএনইউ-তে পড়ে পরবর্তীতে সিভিল সার্ভিস বা বিদেশে পিএইচডি করার সুযোগ, বা অন্যান্য বহু আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পেরেছে।

গত দশ বছরে, তিল তিল করে গড়ে তোলা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আস্তে আস্তে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে প্রশাসন ও সরকার। অবশ্য একা জেএনইউ না, সমস্ত সরকারি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরই নেমে আসছে প্রশাসনিক খাঁড়া। মুক্তচিন্তা আর সহজলভ্য শিক্ষা এই দুই-ই যে আরএসএস-এর রাজনীতির পথে বিশাল বাধা! তবে চিরকাল মুক্তচিন্তার পরিপোষক বিশ্ববিদ্যালয়গুলি, যেমন জেএনইউ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বা হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষভাবে আরএসএস-এর চক্ষুশূল। তাদের বিরুদ্ধে তাই লাগাতার প্ররোচনা চলে পেটোয়া গণমাধ্যমে। সাধারণ মানুষের চোখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ভিলেন বানানোর ঘৃণ্য খেলা, উচ্চশিক্ষার প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও ঘৃণা চাগিয়ে দেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চলতেই থাকে।

জেএনইউ-তে রাজনীতি করা তাই সহজ না। প্রশাসন ও আরএসএস বহুভাবে চেষ্টা চালিয়েছে রাজনীতি বন্ধ করার। জেএনইউ-তে আগে বিভিন্ন হস্টেলের মেস হলে রাতের খাবারের পরে প্রকাশ্য মিটিং হতো। রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে, বা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে বহু বিষয়ে আলোচনা সভা সংগঠিত হতো, তর্ক বিতর্কে রাত গড়াত। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বহুমুখী বিষয়ে সচেতন করে তুলত এই আলোচনা সভাগুলি এবং সাধারণত, কোনওভাবেই প্রশাসন হস্তক্ষেপ করত না, করলে তুমুল প্রতিবাদ হতো। এছাড়া হস্টেলে জলের অভাব থেকে প্যালেস্টাইনে মানবাধিকার হনন, হেন বিষয় ছিল না যা নিয়ে জেএনইউ-তে প্রতিবাদ হতো না। আগেকার প্রশাসনও মেনে নিত ছাত্রদের প্রতিবাদ করার মৌলিক অধিকারকে।

আরও পড়ুন- ১০ বছরের খরা কাটিয়ে দাপট এবিভিপির! জেএনইউ দখলে রেখেও কেন চিন্তায় বামেরা?

বিগত দশ বছরে ধীরে ধীরে প্রশাসন এই সব আলোচনা সভার জায়গাগুলি বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিবাদ করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের উপর হাজার হাজার টাকা জরিমানা করেছে, তাদের বহিষ্কার করেছে, এমনকী বহুবার বহু ছাত্রের উপর পুলিশি মামলা পর্যন্ত করা হয়েছে। ছাত্রদের ভবিষ্যৎ বা কর্মজীবন নিয়ে আর বিন্দুমাত্র সংবেদনশীল নয় এই প্রশাসন। রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়ার এই নিরন্তর প্রশাসনিক প্রয়াসের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করে চলেছে জেএনইউ-এর ছাত্রসমাজ। এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাম ঐক্য বজায় রাখা বড্ড প্রয়োজন ছিল কিন্তু সেটাই হলো না। এসএফআই এবং আইসা-র নেতৃত্বে দুটো আলাদা আলাদা জোট হওয়ার ফলে ভাগ হয়ে গেল বাম ভোট। ফলস্বরূপ তিনটে কেন্দ্রীয় প্যানেল পদে আইসা-ডিএসএফ প্রার্থীরা জিতলেও, চতুর্থ পদে দশ বছর পর জিতল এবিভিপি।

সারা দেশেই এই মুহূর্তে জোটের রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন একটি সম্পূর্ণ ফ্যাসিবাদী দল, গোটা গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোটাকেই ক্ষয়িষ্ণু করে দিচ্ছে  এবং ধীরে ধীরে গণতন্ত্র বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করাটাই চরম গণতান্ত্রিক দায়িত্ব এবং তার জন্য সকল বিরোধী শক্তির এককাট্টা হওয়াটাও সময়েরই দাবি। INDIA জোটও এই ভাবনা থেকেই তৈরি হয়েছিল। সবই বলা সহজ, করা সহজ কি? যে কোনও 'ট্যাকটিক্যাল অ্যালায়েন্স'-এর ন্যূনতম প্রয়োজন হচ্ছে স্বার্থত্যাগ। নিজের দাবি-দাওয়া ও স্বার্থত্যাগ করে ধসে পড়া গণতন্ত্রকে বাঁচাতে বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ ও মরিয়া লড়াই কি আমরা রাষ্ট্রীয় স্তরে এখনও দেখতে পাচ্ছি? সেখানেও ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ফলে, কোনও ঐক্যবদ্ধ লড়াই দানা বাঁধতে পারছে না এবং তার ফলস্বরূপ মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা বা দিল্লির মতো রাজ্যের নির্বাচনে লাভবান হয়েছে বিজেপি। জেএনইউ-তেও এই স্বার্থপর লড়াই এবং কে সভাপতি পোস্ট পাবে তার আকচা-আকচিতে ভেঙে গেল দশ বছর ধরে চলা ঐক্যজোট রাজনীতি এবং লাভবান হলো এবিভিপি, ক্ষতিগ্রস্ত হলো গোটা জেএনইউ-এর প্রগতিশীল সমাজ।

চুলচেরা ভোটের হিসেবে করলে দেখা যাবে এখনও অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী প্রগতিশীল রাজনীতিরই পক্ষে। যদিও এবিভিপির প্রভাব নিঃসন্দেহে বেড়েছে অনেকগুণ। আসলে এই মুহূর্তে যে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছে, তারা সবাই মোদি জমানায় বেড়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের সমাজে যে সাম্প্রদায়িক ও জাতিবাদী বিষাক্ত পরিবেশ খুব সচেতনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা তার থেকে মুক্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিসর এবং উচ্চশিক্ষা একইসঙ্গে 'লার্নিং' এবং 'আনলার্নিং'-এর জায়গা। ছাত্রছাত্রীরা এখানে শিক্ষালাভের পাশাপাশি নিজেদের সমাজ থেকে পাওয়া গোঁড়ামি, দ্বিধা, ও দ্বন্দ্বকে প্রশ্ন করতে, চ্যালেঞ্জ করতে এবং শেষমেশ পরিবর্তন করার সুযোগ ও সাহস পায়। সেই সুযোগ এবং সাহসটাই আরএসএস কেড়ে নিতে চায়। আগামীদিনে এই লড়াই আরও তীব্র হবে। জেএনইউ-এর ছাত্রসমাজ যখন জোট রাজনীতির সাহস ও দিশা দেখিয়েছিল, তখন দেশের মূলস্রোতের রাজনীতিতেও জোটের জন্য প্রস্তুতি বা পরিপক্বতা তা কোনওটাই ছিল না। সেদিক থেকে জেএনইউ-এর বামপন্থী ছাত্ররা সুদূর প্রসারী এক পদক্ষেপ করে আজ থেকে দশ বছর আগে। আগামী দিনেও তারা আরও একবার ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা সরিয়ে রেখে ঐক্যবদ্ধ লড়াই লড়বে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে, এই আশাই করব। কারণ মুখোমুখি দাঁড়ানো দু'টি দলের এই লড়াই আজ গণতন্ত্র এবং সংবিধান বাঁচানোর মরিয়া যুদ্ধ, সেখানে আর স্বার্থচিন্তার বিলাসিতা করার অবকাশ নেই।

More Articles