আত্মগোপনের সময়ও ব্যাগে ভালো চা নিয়ে ঘুরতেন জ্যোতিদা
Jyotirmoy Datta: জ্যোতিদা খুব চা-ভক্ত ছিলেন। মানে খুব ভালো চা। জ্যোতিদা যখন আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, জ্যোতিদাকে পুলিশ খুঁজছে, তখন জ্যোতিদা ব্যাগের মধ্যে ভালো চা নিয়ে ঘুরতেন।
জ্যোতিদার সঙ্গে, মানে জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বলা যেতে পারে ষাটের দশক থেকে। 'মুক্তমেলা' নামে একটা মেলা হতো গড়ের মাঠে। জ্যোতিদা সেই মেলায় আসতেন। জ্যোতিদা তখন গান্ধীবাদী ছিলেন, খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করতেন। ওই মুক্তমেলাতে অনেক কিছু ঘটত। যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায় ওখানে কবিতা পড়েছেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, তারপর আমাদের ব্র্যান্ড মাস্টার তুষার রায় ওখানে কবিতা পড়েছেন, প্রকাশ কর্মকার ওখানে ছবি নিয়ে আসতেন, গান হতো, কবিতা পড়া হতো। তখন আমি ছাত্র।
সত্তরের দশকে জ্যোতিদা একটা 'কন্টিকি' বলে একটা ভাসমান রেস্তোরাঁ তৈরি করেন গঙ্গাবক্ষে। পরে সেটাকে উনি ডুবিয়েও দেন—সেটা অন্য কাহিনি। আমরা অনেক কাণ্ডকারখানা করেছি একসঙ্গে, যেমন 'কন্টিকি' যখন ডুবিয়ে দিলেন ডুবিয়ে দেওয়ার পরে আবার মেদিনীপুর থেকে ডুবুরি এল, ডুবুরি এসে সেখান থেকে ফ্রিজ-ট্রিজগুলো উদ্ধার করল। ইন্স্যুরেন্সের ঝামেলা ছিল। তো জ্যোতিদার কন্টিকি ডুবিয়ে দেওয়া এবং কন্টিকি থেকে জিনিসগুলো উদ্ধার করা—সেসব লম্বা কাহিনী ছিল জ্যোতিদার। অনেক গালগল্প ছিল জ্যোতিদাকে ঘিরে, রাজনৈতিক অনেক গালগল্প ছিল। সেটা কতটা সত্যি কতটা মিথ্যে কেউ জানে না। জ্যোতিদাও খোলসা করে এসব বলতেন না কখনও।
এই কন্টিকিতে আমাদের খুব যাতায়াত ছিল। কন্টিকিতে লাইব্রেরি ছিল, গান-বাজনা হতো, আড্ডা হতো, খাওয়া-দাওয়া হতো। ওখানে লাঞ্চের খুব ভালো ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশের একজন শেফ ছিলেন, তিনি ইলিশ মাছের বিরিয়ানি বানাতেন। আর কন্টিকিতে একটা 'লাভার্স কর্নার' ছিল, যেখানে ১০ টাকা—সেই সময় ১০ টাকায় চা বিক্রি করতেন।
জ্যোতিদা খুব চা-ভক্ত ছিলেন। অর্থাৎ খুব ভালো মানের চায়ের। জ্যোতিদা যখন আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, জ্যোতিদাকে পুলিশ খুঁজছে, তখনও জ্যোতিদা ব্যাগের মধ্যে ভালো চা নিয়ে ঘুরতেন। চায়ের ব্যাপারে খুব রসিক ছিলেন এবং খুবই সিলেক্টিভ ছিলেন।
আরও পড়ুন- জ্যোতির্ময় দত্ত: লেখালেখির বাইরে এক খ্যাপাটে মানবতাবাদী
আমি বুদ্ধদেব বসুকে অতটা পাইনি, প্রতিভা বসুকে একদম মৃত্যু পর্যন্ত পেয়েছি। জ্যোতিদা আর মিমিদি অর্থাৎ জ্যোতিদার স্ত্রী মীনাক্ষী দত্তর সঙ্গে আমাদের সখ্য ছিল খুব। জ্যোতিদা আমার বাড়িতে পালিয়ে আসতেন মাঝে মাঝে। অনেক পরে অবশ্য, যখন আমেরিকায় থাকতেন তখন, এসে ছবি দেখতেন, ছবি নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। সেগুলোর মধ্যে অনেক ছোট ছোট গল্প লুকিয়ে আছে।
জ্যোতিদার আমার প্রতি একটা অসম্ভব স্নেহ ছিল এবং ভালোবাসা ছিল, এক ধরনের দুর্বলতাও ছিল। কল্যাণ, তিতিরের (কঙ্কাবতী দত্ত, জ্যোতির্ময় দত্তের মেয়ে) প্রথম স্বামী, জ্যোতিদার জামাই, তার সঙ্গেও খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই সুবাদেও জ্যোতিদার সঙ্গে আমার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয় কাজের দিক থেকে, ছবির দিক থেকে। শেষের দিকে, জ্যোতিদা যখন সাউথ সিটির ওখানে ছাদের ঘরের বর্ষাতিতে থাকতে শুরু করলেন। ওখানে আমি বড় বড় ক্যানভাস রোল করে নিয়ে গিয়ে ওখানে ডিসপ্লে করতাম। আমাদের একটা প্রদর্শনী করারও প্ল্যান হয়েছিল সেখানে, সেই পরিকল্পনাটা আর বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু কাজ দেখেছেন, নিয়মিত কাজ দেখাতাম। জ্যোতিদা খুব ভালো হাতের কাজ, অর্থাৎ মূর্তি গড়তেন খুব ভালো। মূর্তি গড়ার দিকে ওঁর খুব ঝোঁক ছিল। ওঁর কাজও আছে।
জ্যোতিদার একটা চোখের অপারেশন হয় আমেরিকায়, সেটা সফল হয়নি। তাই, তারপর থেকে ওঁর দৃষ্টিশক্তিটা খুব ক্ষীণ হয়ে গেছিল। কিন্তু যেহেতু আমার খুব বড় বড় কাজ, আট ফুটের কাজ আমি নিয়ে যেতাম রোল করে, তাই সেটা দেখতে কোনো অসুবিধা হতো না। তাছাড়া আমার কাজের খুব ভক্ত ছিলেন উনি, আমার স্টুডিওতেও আসতেন। জ্যোতিদার ছবিও এঁকেছি অনেক। আমরা অনেক আড্ডাও দিয়েছি। তবে জ্যোতিদার অনেক রকম রেস্ট্রিকশন ছিল পরের দিকে, অনেক নিয়ম কানুন ছিল। কিন্তু উনি মানতে চাইতেন না। আমি গেলে উনি একটু বিদ্রোহী হয়ে উঠতেন, হয়ে উঠতেন। রেগে উঠতেন দুঃখে "হিরণ এসেছে, হিরণকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হচ্ছে না"—আমাদের সান্ধ্যকালীন আসর থেকে ওঁকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা হতো, সেটা উনি মেনে নিতে পারতেন না। তাই, দেখা সাক্ষাৎ কম হতো।
আরও পড়ুন- বাড়িতে পোষেন ডাইনোসর! জ্যোতির্ময় দত্তকে নিয়ে এমনই বিশ্বাস অনেকের
শেষবার যখন আমি যাচ্ছিলাম দেখা করতে, সাতটা নাগাদ মিমিদি আমাকে ফোন করে বললেন, "জ্যোতির শরীর ভালো নেই, তুমি আজকে এসো না"। মিমিদির সঙ্গেও আর দেখা হয়নি, জ্যোতিদার সঙ্গেও আর দেখা হলো না। একটা দুঃখ রয়ে গেল। এই আগের প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের যে ঘনিষ্ঠতা, সেটা ছিন্ন হয়ে গেল জ্যোতিদা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে শঙ্খ ঘোষ ছিলেন, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শরৎ মুখোপাধ্যায়, পার্বতী মুখোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, উৎপল বসু, প্রবীর গুহ এরা যেমন ছিলেন, জ্যোতিদাও সেরকম ছিলেন। আমাদের শেষ সেতু হিসেবে ছিলেন, বলা যেতে পারে। সেই সেতুটা ভেঙে গেল। জ্যোতিদার শেষদিকের এই শারীরিক অবস্থা আমি সহ্য করতে পারতাম না। আমি গেলেই খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন, সেই দিক থেকে আমার একটা কুণ্ঠাবোধ হতো, অস্বস্তি হতো। তাই, আমি আর যেতে পারিনি। এটা একটা না পাওয়া, আমাদের একটা অংশ চলে যাওয়া। জীবনের কোনো খালি অংশ চলে যাওয়া না, ইনটেলেকচুয়াল অংশ চলে যাওয়া। বুদ্ধির যে কর্ষণ, সেই কর্ষণটাও থেমে যাওয়া।
জ্যোতিদাকে নিয়ে আমার লেখাও আছে এবং আঁকা তো আছেই। কিন্তু সেগুলো দেখানোর লোক নেই। জ্যোতিদার 'কলকাতা পত্রিকা' যখন নতুন করে শুরু হয়, তখন প্রথম সংখ্যা থেকেই আমি ছিলাম— লেখালেখি, আঁকাআঁকি, যে তিনটি সংখ্যা বেরিয়েছে, তিনটি সংখ্যারই প্রচ্ছদ আমার করা। ২ টো শারদীয়া, একটা বইমেলার জন্য।

বইমেলার জন্য 'কলকাতা পত্রিকা'র প্রচ্ছদ
তারপরে উনি অনেকরকম পত্রপত্রিকা করার প্ল্যান করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যেও আমি যুক্ত ছিলাম একটা সময়। তিতির এসব করত, তিতিরকে তো আমি খুব ছোটবেলা থেকেই চিনি।
তারপর জ্যোতিদার আমেরিকা চলে যাওয়া, আমেরিকায় থাকা, আবার আমেরিকা থেকে ফিরে আসা। ওঁর ফিরে যাওয়ার খুব ইচ্ছেও ছিল, দুজনেরই খুব ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। এখানে থাকাটা বোধ হয় ওদের পছন্দ হয়নি। কারণ- জ্যোতিদা যখন ফিরে আসেন, তখন জ্যোতিদার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেকেই মারা গেছেন— তারাপদ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার—সবাই চলে গেছেন তখন। এই বন্ধুহীন একটা শ্মশানের মতো শহরে উনি আর থাকতে পারতেন না। দম বন্ধ হয়ে আসত। দীপক মজুমদার ওঁর বাড়িতে খুব ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন। ইন্দ্রজিৎ, কণিকা এরা খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। অমিয় দেব খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। অমিয় দেব এখনও আছেন।
জ্যোতিদা খুব নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন মিমিদি চলে যাওয়ার পরে। মিমিদি যতদিন ছিলেন ততদিন জ্যোতিদা একটা সঙ্গ এবং সহায় পেতেন। মিমিদি হঠাৎ করেই চলে গেলেন। তারপর জ্যোতিদার বেঁচে থাকাটা খুবই কষ্টকর ছিল। জ্যোতিদার জন্যই 'কলকাতা পত্রিকা'কে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এবং শঙ্করলাল ভট্টাচার্য তার দায়িত্ব নেন।
এসব কথা আজ মনে পড়ছে, আমাদের আরও একা করে দিয়ে জ্যোতিদা চলে গেলেন।
Whatsapp
