চোদ্দ ফুটের প্রতিমা! 'জাগ্রত বড়মা'-কে দেখতে আজও ভিড় জমে নৈহাটির কালীপুজোয়
Kali Puja 2022: প্রতি বছর রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ নৈহাটির কিছু বিখ্যাত প্রতিমা দর্শন করতে ভিড় জমান।
মা দুর্গার কৈলাসে ফিরে যাওয়ার দুঃখ বাঙালির মন থেকে কিছুটা লাঘব করে কালীপুজো। বাংলায় কালীপুজো মানেই বিভিন্ন ধরনের আতসবাজি এবং আলোর রোশনাই। বর্তমানে কলকাতায় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে কালীপুজোর প্রতিমা দর্শনের চল খুবই কমে গিয়েছে। কলকাতা থেকে কিছু দূরেই নৈহাটিতে এর বিপরীত ছবি দেখা যায়। প্রতি বছর রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ নৈহাটির কিছু বিখ্যাত প্রতিমা দর্শন করতে ভিড় জমান। মণ্ডপের চাকচিক্য খুব কম, কোথাও আবার মণ্ডপ হিসেবে আয়োজন খুবই সামান্য। যদিও সেই সব কিছুর তোয়াক্কা না করেই নৈহাটি এবং তার আশপাশের কিছু জনপ্রিয় প্রতিমা দর্শন করার মানুষের সংখ্যা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।
নৈহাটির কালীপুজোর কথা উঠলে প্রথমেই বড়মা-র নাম উঠে আসে। নৈহাটি স্টেশন থেকে হাঁটা পথে ঋষি অরবিন্দ রোড ধরে গঙ্গার দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই বড়মাকে দেখতে পাওয়া যায়। এই এলাকা এবং অন্যান্য বিভিন্ন এলাকার অগণিত মানুষের বিশ্বাস, বড়মা খুবই জাগ্রত। বড়মা নামে মা কালী-র যে রূপকে পুজো করা হয়, সেই রূপ সাধারণ মানুষের কাছে রক্ষাকালী নামেই পরিচিত। "ধর্ম যার যার, বড়মা সবার", এই নীতি মেনেই প্রতি বছর পুজোর আয়োজন করা হয়। প্রায় শতবর্ষ পূর্ণ করে ফেলা এবং বহু মানুষের কাছে পরিচিত এই পুজোর একটি ইতিহাস রয়েছে, এবং তার সঙ্গেই বড়মার নামকরণ জুড়ে রয়েছে।
আরও পড়ুন: আজও বিলিতি খড়্গে বলি হয় তিনশো বছর পুরনো হালদারবাড়ির কালীপুজোয়
নৈহাটির জনৈক ভবেশ চক্রবর্তী একবার তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নবদ্বীপের ভাঙা রাস দেখতে গিয়েছিলেন। সেই এলাকার প্রতিমার আকার দেখে তিনি ঠিক করেছিলেন, তাঁর নিজের বাড়িতে সেই একই আকারের কালীমূর্তি তৈরি করে পুজো শুরু করবেন। বাড়িতে পুজো শুরু হলেও প্রতিমার আকার প্রতি বছর বৃদ্ধি করার কারণে বর্তমানে সেই পুজোর আয়োজন বাড়ির ভেতরে করা সম্ভব নয়। তাই ঋষি অরবিন্দ রোডের একপাশে প্রতিমা নির্মাণ করে পুজো করা হয়। লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে প্রতিমা নির্মাণ শুরু হয়। এলাকার প্রবীণ মানুষদের মতে, এই প্রতিমার উচ্চতা প্রায় চোদ্দ হাত। প্রকৃতপক্ষে, বড়মা-র প্রতিমার উচ্চতা হয় প্রায় একুশ থেকে বাইশ ফুট। শুরুতে এই পুজো ভবেশ-কালী অথবা ভবেশের কালীপুজো নামে পরিচিত হলেও ক্রমে প্রতিমার আকার এবং মাহাত্ম্যের কারণে এই প্রতিমা বড়মা নামে পরিচিতি লাভ করে। আজও মা কালীর ভোগের আয়োজন চক্রবর্তী পরিবারের বাড়িতেই করা হয়। পুজোর সেবকরা পুজোর খরচ বহন করে। নৈহাটিতে বড়মা-র একটি মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরে বছরের বাকি দিনগুলোতে পুজোর আয়োজন করা হয়। পুজোর দিনগুলোতে বহু ভক্তদের দেওয়া গয়নায় বড়মা সেজে ওঠেন। বড়মা-র প্রতি শ্রদ্ধার কারণেই বিসর্জনের সময়ে সাধারণত বড়মার মূর্তি প্রথমে বিসর্জন দেওয়া হয় এবং তার পরে এলাকার বাকি প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। ১৯৭০ সাল অবধি এলাকার শক্তিশালী মানুষরা কাঁধে করে বড়মার প্রতিমাকে বিসর্জনের জন্য নিয়ে যেত। যদিও বর্তমানে সেই প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।
নৈহাটির কালীপুজো শুনলেই প্রথমেই বড়মা-র নাম মাথায় আসলেও এই এলাকায় আরও বহু জনপ্রিয় পুজো রয়েছে। ঋষি অরবিন্দ রোডে বড়মা ছাড়াও আরও অনেক পুজো হয়। তার মধ্যে হকার্স কালী অন্যতম। হকার্স সমিতি এই পুজোর আয়োজন করে বলেই এই পুজোর নাম সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে গিয়েছে হকার্স কালী। নৈহাটি স্টেশন থেকে কিছুটা হাঁটা পথে বরোদা ব্রিজ পৌঁছনোর আগেই পৌঁছে যাওয়া যায় গোপাল স্মৃতি সংঘ-র পুজোয়। এই পুজো স্থানীয় মানুষের কাছে দেবু ঘোষের কালীপুজো নামেই পরিচিত। নৈহাটি এলাকার এক জনপ্রিয় প্রতিমা স্থানীয় মানুষের কাছে উনত্রিশ হাত কালী নামেই পরিচিত। প্রতিমার উচ্চতা প্রায় উনত্রিশ হাত হওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষের মুখে মুখে এই নাম ছড়িয়ে পড়েছে। বরোদা ব্রিজ পেরিয়ে কিছুটা হাঁটা পথে এগোলে উনত্রিশ হাত কালীপ্রতিমা দর্শন করা যায়। এছাড়া লোহাঘাটের কালীপুজো, 'আমরা কজন' ক্লাব এই এলাকার জনপ্রিয় পুজোর তালিকায় পড়ে।
নৈহাটির কালীপুজো-পরিক্রমার মাঝে পেটপুজোর জন্য নতুন এবং পুরনো বিভিন্ন খাবারের প্রতিষ্ঠানে ঢুঁ মারা যেতে পারে। স্বল্প দামে বিভিন্ন রকমের খাবার পরিবেশন করার জন্য নৈহাটি স্টেশন থেকে ঢিল ছোড়া দুরত্বে থাকা 'রাজ কেবিন' যথেষ্ঠ সুনাম অর্জন করেছে। স্টেশন থেকে অল্প দূরত্বের মধ্যেই রয়েছে 'রয়্যালস'-এর মতো আধুনিক ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁ এবং ব্ল্যাক হারবার-এর মতো খুবই স্বল্প পরিসরে তৈরি হওয়া ছিমছাম রেস্তোরাঁ। প্রতিমা দর্শন এবং পেটপুজোর মতো দুটো আকর্ষণীয় বিষয়ের টানে কালীপুজোর দিন নৈহাটিতে বহু মানুষের সমাগম হয়।