আজও বিলিতি খড়্গে বলি হয় তিনশো বছর পুরনো হালদারবাড়ির কালীপুজোয়

Kali Puja 2022: তিনশো বছরের ঐতিহ্যবাহী হালদারবাড়ির কালীপুজোয় বিলিতি খড়্গ দিয়ে হয় বলি।

বাঙালির জীবনে উৎসবের উজ্জ্বল উপস্থিতি শুধু শারদ উৎসব নয়, শ্যামাপুজোর হাত ধরেও সারা বছর পার্বণের রেশ চলতেই থাকে। কালীপুজো আসছে। আর কালীপুজো মানেই চারদিকে আলোর রোশনাই। অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে আলোর খেলা। বাংলাজুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছে কালীর আরাধনার প্রস্তুতি। থিমপুজোর জন্য যেমন সেজে উঠছে মণ্ডপ। বনেদিবাড়ির দুর্গাপুজো নিয়ে মাতামাতি থাকলেও, বনেদিবাড়ির কালীপুজো নিয়ে তেমন একটা মাতামাতি হয় না বললেই চলে। কিন্তু যেসব বনেদিবাড়িতে মা কালীর আরাধনা হয়, সেই সমস্ত বাড়িতে চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছে প্রস্তুতি। প্রত্যেক বনেদিবাড়ির পুজোরই কোনও না কোনও আলাদা মাহাত্ম্য থাকে। তেমনই রয়েছে বউবাজারের হালদারবাড়িতে। তিনশো বছরের ঐতিহ্যবাহী হালদারবাড়ির কালীপুজোয় বিলিতি খড়্গ দিয়ে হয় বলি। আর এই খড়্গ ইংল্যান্ডের শেফিল্ড কোম্পানির তৈরি।

ইতিহাস
বউবাজারে হালদারবাড়ির কালীপুজো ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। বাড়িতে থাকা কিছু কাগজপত্রের মধ্যে ১৭৫০ সালের পুজোর হিসেবনিকেশের ফর্দ পাওয়া গিয়েছিল। মনে করা হয়, পুজো সেই বছর বা তার কিছু বছর আগে থেকে শুরু হয়েছিল। তবে হালদারবাড়িতে দুর্গাপুজোরও আগে কালীপুজো শুরু হয়েছিল। মধ্য কলকাতার অলিগলি পেরিয়ে এই বাড়িতে পা দিলে মনে হবে যেন সময় থমকে গেছে। প্রাচীন আর আধুনিকতার মিশেল এই বাড়ির আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছে। বউবাজারের রমানাথ কবিরাজ লেনের এই বাড়ির স্থাপত্য আর দশটা বনেদিবাড়ির থেকে কোথাও যেন একটু আলাদা। বাড়ির একখিলানের ঠাকুরদালান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু হলেও আধুনিকতার ছাপ মেখেছে। উঠোনের দেওয়ালজুড়ে দশমহাবিদ্যার বহু প্রাচীন অয়েল পেন্টিং।

আরও পড়ুন: দিনে রাজা, রাতে লুটেরা! পশ্চিমবঙ্গের ডাকাত-কালীর সঙ্গে জড়িয়ে গা ছমছমে ইতিহাস

ইতিহাস অনুযায়ী, লক্ষ্মীনারায়ণ হালদারের হাত ধরে এই কালীপুজোর শুরু। হুগলি এবং বর্ধমানের মধ্যবর্তী বাদলা গ্রামের জমিদার ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ হালদার। পরে কলকাতায় এসে তাঁর পরিবারের লোকজন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এই পরিবারেরই সদস্য রাখালদাস হালদার আবার জন ইয়েটস অ্যান্ড কোম্পানির কলকাতার এজেন্ট ছিলেন। শোনা যায়, ইস্পাত থেকে শুরু করে জাহাজের ব্যবসা- সবেতেই সোনা ফলাতেন তিনি। তাঁর অর্থ এবং খ্যাতি এতটাই ছিল যে, তিনি সেই সময় ক্যালকাটা ক্লাব এবং বেঙ্গল ক্লাবের সদস্য ছিলেন। কলকাতার প্রথম পঞ্চাশটি ল্যান্ডলাইনের একটি ছিল তাঁর। ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকায় ইংল্যান্ড থেকে সরাসরি জিনিসপত্র আমদানি করতেন তিনি। ব্যবসা ভালো হওয়ায় হালদাররা হয়ে ওঠেন কলকাতার সবথেকে বড় ব্যবসায়ীরদের অন্যতম। আর এহেন ধনী পরিবারে কালীপুজো যে জমিয়ে হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লক্ষ্মীনারায়ণের হাতে পুজো শুরু হলেও রাখালদাসের সময়ে এই পুজোর মহিমা আলাদা মাত্রা পায়।

পুজোর বিশেষত্ব
হালদারবাড়িতে দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন থেকেই কালীর কাঠামোপুজো শুরু হয়। লক্ষ্মীপুজোর দিন থেকে ঠাকুর তৈরির কাজ শুরু হয়। কুমোরটুলি থেকে মৃৎশিল্পী এসে হালদারবাড়িতে প্রতিমা নির্মাণ করেন। শিল্পী কাশী পাল বংশপরম্পরায় প্রতিমা বানিয়ে চলেছেন এই বাড়িতে। এরপর মূর্তি তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হলে কৃষ্ণনগর থেকে লোক আসে দেবীকে ডাকের সাজে সাজিয়ে তুলতে।

তারপর একাদশী তিথিতে ঠাকুরদালানে পাঁচকলাই আর পঞ্চশস্য দিয়ে গঙ্গামাটির বেদি তৈরি করা হয়। তার ওপর পাতা হয় চৌকি৷ পুজোর দু'-তিন দিন আগে মায়ের মূর্তিকে চৌকিতে তোলা হয়। অমাবস্যা পড়ার পর তিথি দেখে মায়ের সামনে ঘট পাতা হয়। কালীপুজো শুরুর আগে প্রথমে অলক্ষ্মী বিদায় করা হয়। গোবর দিয়ে অলক্ষ্মীর এবং চালের পিটুলি দিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ আর কুবেরের মূর্তি তৈরি করা হয়। অলক্ষ্মীপুজোর পর কুলো বাজিয়ে প্যাঁকাটি জ্বালিয়ে তিন মাথার মোড়ে গিয়ে অলক্ষ্মী বিদায়ের পর বাড়ি এসে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো করা হয়। সেই সময় ঠাকুর ঘর থেকে মঙ্গলচণ্ডীর ঘট, লক্ষ্মী-নারায়ণ এবং মহাদেবের মূর্তি নামিয়ে আনা হয়। তারপর শুরু হয় কালীপুজো।

পুজো শুরু হলে বাড়ির সমস্ত বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। পুরো বাড়ি আর ঠাকুরদালানজুড়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় মোমবাতি আর প্রদীপ। এটাই নাকি প্রথা। দৃশ্যটা কল্পনা করুন একবার! অমাবস্যার অন্ধকার চারদিকে, এরই মাঝে সেই অন্ধকার চিরে জ্বলে উঠছে অজস্র মোমবাতির শিখা। আর সেই মোমবাতির আলো গিয়ে পড়ছে ডাকের সাজে সজ্জিত শ্যামা-মুখের ওপর। যেন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! অজস্র মোমবাতির আলোয় আলোকিত হয় ঠাকুরদালানও। ভক্তি আর ভয়ের মাঝের অনুভূতি। এইভাবেই বিগত ৩০০ বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে।

বলিপ্রথা ও কাহিনি
হালদারবাড়িতে আগে কালীপুজোয় পাঁঠাবলির প্রচলন ছিল। কিংবদন্তি অনুযায়ী, ১৯২০ নাগাদ হালদারবাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে আসেন শেফিল্ড স্টিল কোম্পানির মালিক জন ইয়েটস। তিনি মায়ের পুজো দেখে এতটাই মুগ্ধ হন যে, কলকাতা থেকে দেশে ফেরার সময় বলির খাঁড়ার নকশা এঁকে নিয়ে যান। কিছুদিনের মধ্যেই দেশ থেকে রূপোর মতো ঝকঝকে একটি খড়্গ জাহাজে করে পাঠান তিনি। তাতে বাংলা সাল-তারিখসহ লেখা ছিল ‘শ্রী শ্রী দুর্গা’। কিন্তু সেই খাঁড়া এত ভারী ছিল যে, তা দিয়ে বলি দিতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠত লোকজন। সেই কথা জানতে পেরে ফের একটি খাঁড়া পাঠান ইয়েটস সাহেব। এই বাড়িতে যেহেতু কালীপুজোর মাহাত্ম্য ছিল বেশি, তাই রাখালদাস হালদার ঠিক করেন, এই খাঁড়া দিয়েই কালীপুজোর সময় পাঁঠাবলি দেওয়া হবে। কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে সেই প্রথাই চলে এসেছে।

কিন্তু ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার ভয়াবহতা, রক্তপাত হালদারবাড়ির সদস্যদের মনে এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সেই কারণেই ১৯৪৬ সালের পর থেকে পাঁঠাবলি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বলি প্রথা আজও অব্যহত, তবে তা সবজির বলি। এখন শেফিল্ড কোম্পানির পাঠানো খাঁড়া দিয়েই পুজোর সময় আখ, চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। বলির সময় মশাল জ্বালানো হয়। মোমবাতির স্নিগ্ধ আলোর সঙ্গে মশালের তীব্র আলো মিলেমিশে এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করে। কিছুদিন আগে পর্যন্তও দু'টি নৌকায় করে প্রতিমা বিসর্জন হতো মাঝগঙ্গায়। কিন্তু এখন আইনগত কারণে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পরিবারের সব সদস্য এখন একযোগে মিলিত হয়ে গঙ্গাতেই প্রতিমা বিসর্জন করেন।

হালদারবাড়িতে এখন অষ্টম প্রজন্ম চলছে। এই প্রজন্মের বরুণকুমার হালদারের কথায়, হালদারবাড়ি শুধু পুজো নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গেও জড়িত ছিল। অনেক বিপ্লবী কার্যকলাপ এবং বিপ্লবীদের লুকিয়ে থাকার আশ্রয় ছিল এই হালদারবাড়ি। উৎসবের আলোতে, উজ্জ্বল নগরীর বুকে বাঙালিরা মাতৃ-আরাধনার সঙ্গে আচার-আয়োজনকে কখনও ভুলে যেতে দেয়নি। এইভাবেই বছরের পর বছর ধরে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে আসছে হালদারবাড়ির কালীপুজো।

More Articles