কালীগঞ্জ: ঠিক কী ঘটেছিল ভোটগণনার দিন?
Kaliganj: তামান্নার মায়ের অভিযোগ, ঝুনু ওরফে কালিগঞ্জ তৃনমূল ব্লক সভাপতি দেবব্রত মুখার্জি ও নাসিরুদ্দিন আহমেদের মেয়ে (তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদ)-র নির্দেশে বোমা ছুঁড়েছে দুষ্কৃতীরা।
পলাশী স্টেশনের গায়েই টোটোস্ট্যান্ড। ১৫ মিনিট এগোলেই তামান্নার বাড়ি। কোনো এলাকার হাঁড়ির খবর জানতে চায়ের ঠেকের থেকে ভালো জায়গা আর হয় না। কিন্তু সেই চায়ের দোকান আজ নিস্তব্ধ। তামান্নার মৃত্যুর ৪৮ ঘণ্টা পার। সকলেই চুপ, ডুব দিয়ে রয়েছেন চায়ে। কেউ কোনো কথা বাড়াতে রাজি নন। অগত্যা টোটো ধরে মৌলান্দির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া।
সকাল সাড়ে সাতটায় সেখানে ঘুরছে উর্দিধারী পুলিশ। গ্রামের মূল রাস্তা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার হাঁটাপথ তামান্না খাতুনের বাড়ি। সামনে বড় পুকুর। ঢোকার মুখেই বসে রয়েছেন কিছু সিভিক পুলিশ। কাদামাখা রাস্তা পেরিয়ে বাড়ি, উঠোনের সামনে কিছুটা জায়গা কালো ত্রিপলে ঢাকা। বাড়ির দুয়ারে নিহত নাবালিকার মা বসে রয়েছেন মাথায় হাত দিয়ে, নির্বাক হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন বেশ কিছু আত্মীয়।
সোমবার ঠিক কী ঘটেছিল? বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তামান্নার বাবা বলছিলেন, পেশার খাতিরে তিনি পরিযায়ী, ওড়িশায় থাকেন বেশিরভাগ সময়ই। সোমবার হঠাৎ তাঁর কাছে ফোন যায় বাড়ির থেকে। ফোনের ওপার থেকে আর্তনাদ ভেসে আসে তামান্নার মায়ের, “তোমার তামান্নাকে বোমায় উড়িয়ে দিয়েছে” বলতে থাকেন তামান্নার মা। হতভম্ব হোসেন শেখ ভাবতে পারছিলেন না, ছোট্ট মেয়েটাকে টার্গেট করা হলো কেন? সেদিনের ঘটনা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। বললেন, ৩ সন্তানের মৃত্যুর পর তামান্নাকে অনেক কষ্টে বড় করছিলেন। যেখানেই যেতেন মেয়েকে কোলে করে নিয়ে যেতেন। খুব ভয় পেত তাঁর মেয়ে। তাঁরাও আগে তৃণমূল করতেন বলে জানান তামান্নার বাবা। “কিন্তু এই কালু, আদরদের লুটে পুটে খাওয়ার রাজনীতিতে বিরক্ত হয়ে সিপিএম-কে ভোট দিতে শুরু করি”। যার শাস্তি পেতে হল নিরীহ নিরপরাধ একটি শিশুকে? তামান্না হত্যাকারীদের ফাঁসি চান বাবা হোসেন শেখ।
আরও পড়ুন-শাসকের উল্লাসের বলি! ৯ বছরের তামান্নার মৃত্যু ভুলতে কতক্ষণ নেবে পশ্চিমবাংলা?
উঠোনের সামনে নানারকমের ফুলগাছ। তামান্না ফুল ভালোবাসত। ঘটনার দিন মায়ের সঙ্গে ফুলগাছেরই পরিচর্যা করছিল সে। পুকুরে সাঁতার কাটার বায়না ধরে তামান্না। তাই মেয়েকে নিয়ে পুকুরের দিকেই যাচ্ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন। এমন সময় আদর, কালুদের দেখতে পান। হঠাৎ চারিদিকে কালো ধোঁয়া। পিঠ জ্বলছে সাবিনার। মেয়েকে ডাক দিয়ে বলেন, দেখতো মা তামান্না পিঠটা জ্বলছে, কী হল? কিন্তু কোথায় তামান্না? হাতছাড়া হয়ে গেছে মেয়ে। সাবিনা পরক্ষণেই দেখতে পান, রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে তামান্নার নিথর দেহ। মুখ থেকে বুক পর্যন্ত ঝাঁঝরা হয়ে গেছে বোমার আঘাতে। সেই দৃশ্য সাবিনাকে যে কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছে, তাঁর সঙ্গে কথা বলেই বোঝা যাচ্ছিল।
তামান্নার বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় হঠাৎ আর্তনাদ শোনা যায়। সাবিনা ইয়াসমিন কাঁদছেন আর বলছেন, “কোথায় গেলে তোকে পাবো রে মা”। ধরে রাখা যাচ্ছে না তাঁকে। উঠোনের সামনে যে জায়গায় তামান্নার রক্তাক্ত দেহ পড়েছিল, অর্থাৎ ত্রিপল দিয়ে ঘিরে রাখা ক্রাইম স্পটের সামনে বারবার চলে যাচ্ছেন তিনি। তাঁকে ঘরে নিয়ে গেলেও মেয়ের রেখে যাওয়া বই-খাতা-পেনসিল জড়িয়ে লুটিয়ে পড়ছিলেন মেঝেতে। ঘরে ঢোকার মুখে দেওয়ালে ইংরেজিতে বড় করে লেখা তামান্না খাতুন, সঙ্গে কিছু ফুল আঁকা। তামান্নার মা জানালেন মেয়ে ছবি আঁকত। ঘর জুড়ে এখন সেগুলোই স্মৃতি। ঘরের দেওয়ালে আঁকা পুলিশ এবং ডাক্তারের ছবি। তামান্নার হাতে সাজানো প্রজাপতি, ফুল আরও কত কী! শো-কেসে সাজানো তামান্নার সাজগোজের চুড়ি, টিপ। খেলনা পুতুল সাজানো শো-কেসের মাথায়। সবটাই যেমন ছিল আছে, শুধু নেই তামান্না! কানে বারবার আসছে আর্তনাদ, “কোথায় গেলে তোকে পাবো রে মা!”
ভোটগণনার দিন কাদের নির্দেশে বোমাবাজি করেছিল কালু, আদর, মনোয়ার ও আনোয়াররা? তামান্নার মায়ের অভিযোগ, ঝুনু ওরফে কালিগঞ্জ তৃনমূল ব্লক সভাপতি দেবব্রত মুখার্জি ও নাসিরুদ্দিন আহমেদের মেয়ে (তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদ)-র নির্দেশে বোমা ছুঁড়েছে দুষ্কৃতীরা। তিনি আরও বলেন যে, আসলে ওদের টার্গেট করে রাখা হয়েছিল। ভোটের আগেই মিটিংয়ে ঝুনু বলেছিল, যারা সিপিএমকে ভোট দেবে তাঁদেরকে মেরে দেবে। তামান্নার মায়ের প্রশ্ন, পুলিশের বড়বাবু জানে মৌলান্দিতে ঝামেলা হয়। তাহলে তাঁরা কেন ছিল না সেদিন? পুলিশ থাকলে তামান্না আজ বেঁচে থাকত। কিন্তু বোমাবাজির আধ ঘন্টা পর পুলিশ এসেছিল বলে অভিযোগ তামান্নার মায়ের।
২৩ জুন কালীগঞ্জে ভোটগণনার দিন গণনা শুরু হওয়ার পরই মৌলান্দিতে বোমাবাজি শুরু হয়ে যায় বলে অভিযোগ। তামান্নার মা এবং অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, কোনো বিজয় মিছিল হচ্ছিল না। তখন তো সবে গণনা শুরু। তখনও তো ভোটে জেতেনি ওরা। টার্গেট করেই এই কাণ্ড ঘটানো হয়েছে- যাঁরা সিপিএম করে, যাঁরা জোট প্রার্থীর মিছিলে হেঁটেছিল তাঁদের বাড়িতেই সকেট বোমা ছোঁড়া হয়েছে। পূর্ববেলেপাড়ার প্রায় প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে এখনও বোমার আঘাত স্পষ্ট।
আরও পড়ুন-মীরা নায়ারের পুত্র, মোদি সমালোচক— নিউ ইয়র্ককে দিশা দেখাবেন ভাবী মেয়র মামদানি?
বোমার আঘাতে জখম হয়েছেন আরও এক ব্যক্তি। সম্পর্কে তিনি তামান্না খাতুনের দাদু। তিনি এখন বহরমপুর হাসপাতালে ভর্তি। বাড়ির মেঝেতে রক্তের দাগ স্পষ্ট। আরও একটি বাড়িতে ৮-১০টি বোমা ছোড়ার অভিযোগ। কলসি, বাটি তুবড়ে গিয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সকেট বোমার ভগ্নাংশ। কারোর আবার রান্নাঘরে এসে পড়েছে বোমা। মাটির মেঝে, বাঁশের বেড়ায় থাকা বস্তায় লেগে যায় আগুন, পাশেই ছিল রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার। অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও এখনও আতঙ্কে রয়েছে গোটা পাড়া।
তামান্নার বাড়ির আগেই আজিমুদ্দিন শেখের বাড়ি, দেওয়ালে বোমার আঘাত আর উঠোনে সিপিএমের পতাকা। তাঁর অভিযোগ, ভোটগণনা শেষ হওয়ার আগেই কয়েকজন এসে তাঁদের বাড়িতে বোমা ছোড়া শুরু করে। আজিমুদ্দিনের বাড়িতে ৩টি বোমা ছোড়ে আদর শেখের ছেলে কালু। আর এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, কোনো বিজয় মিছিল হচ্ছিল না। মিছিল হলে মূল রাস্তা দিয়ে যাবে। ভিতরের গলিতে কেন আসবে?
তামান্নার থেকে কিছুটা দূরেই এক চায়ের দোকান (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। হাতে হাতে চা দিয়ে চা দোকানদার বলে উঠলেন ২০১৯-এর ভোটের সময় তাঁকে দোকান থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে রাস্তার উপর ফেলে মারা হয়েছিল। বুকের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। পুলিশ এফআইআর নিতে রাজি হয়নি, বরং তাঁর বিরুদ্ধেই এফআইআর হয়েছিল বলে জানান তিনি। তাই এখন আর কোনো কথা বলেন না।
প্রতিবেদনের লিখনের শর্ত সব পক্ষের মতামত নেওয়া। কিন্তু এই প্রতিবেদন পরিপূর্ণ করার জন্য তৃণমূলের বিজয়ী প্রার্থী আলিফা আহমেদকে পাওয়া গেল না। তাঁর নিরাপত্তারক্ষী জানান দিলেন, ইতমধ্যেই তিনি কলকাতা চলে গিয়েছেন। খুব সম্ভবত শপথ গ্রহণ করেই ফিরবেন। আর তাঁর টেলিফোন, এখনও বেজে চলেছে।