কাঁদালে তুমি মোরে...
গানের বাণীতে, সুরে যে বেদনা আছে, সেই বেদনা তখন আমার। যে পুলক আছে তাও আমার। যে দুঃখ আমার নেই, তা আমার হলো।
একেকদিন একেকটা গানের কথা মাথায় উঠে নাচে। যাতায়াতের পথ আগলে দাঁড়ায়। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আমায় ভেংচি কাটে। বাজারে যাচ্ছি, আমার সঙ্গে সে যাচ্ছে। আমি ট্রেন থেকে নেমে অটো ধরলাম, সেও অটো ধরল। যতক্ষণ সে নিজে না যাচ্ছে ততক্ষণ নিস্তার নেই। গানের বাণীতে, সুরে যে বেদনা আছে, সেই বেদনা তখন আমার। যে পুলক আছে তাও আমার। যে দুঃখ আমার নেই, তা আমার হলো। যে হর্ষ ছিল হাওয়ায় তা আমার শরীরে এখন ছুটে বেড়াচ্ছে এধার ওধার। আবার এমনও হয়, আমার যে দুঃখ ছিল গহিন অন্ধকারে, তা এই সুরে স্বরে পথ কেটে ভেসে উঠল। আমার যে সুখ ছিল অলক্ষ্যে, হাসিমুখ দেখে সবাই তা ছুঁয়ে ফেলল। গান আসলে রিংমাস্টার। যেমন নাচায় তেমন নাচি। এমনকী হর্ষ-বিষাদ দুই তরঙ্গ শরীরটাকে দুই দিকে টানছে, এমনও হয় কখনওসখনও। যেমন আজ এখন, রবীন্দ্রনাথের একটা বহুল প্রচারিত, বহুশ্রুত গানের ভূতের দয়ায় এক অদ্ভুত দোটানায় পড়ে গেছি। গানের কথা শুরু হচ্ছে এই ভাবে-
কাঁদালে তুমি মরে
ভালবাসারই ঘায়ে
নিবিড় বেদনাতে
পুলক লাগে গায়ে
আমরা সকলেই পাড়ার প্যান্ডেলে, রবীন্দ্রজয়ন্তীতে, নানা অবসরে গানটি শুনেছি বারংবার সমবেত ভাবে, ভিড়ে। আমি একা, চুপ করে গানটা শুনিনি আগে কখনও। গান এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। একদিন আমায় একা পেতে চাইছিল সে। যাতে আমার মনের দখল নেওয়া যায়। কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, না করলেও আমার বিশ্বাস করানোর উপায় নেই। গানটি আমার কাছে এল ঘুমের মধ্যে। এবং তৎসহ যাবতীয় প্রশ্নও। ভোর ভোর প্রশ্নাকীর্ণ মন নিয়ে উঠে বসে গানটি নানাজনের গলায় শুনতে লাগলাম। প্রশ্নগুলি ক্রমে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সারা ঘরে ঘুরতে লাগল। গান এসব চায়। ঘুমে জাগরণে সে আমার মনের দখল নিয়ে মজা দেখে।
রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ভালবাসার ঘা। ভালবাসার ঘা কেমন হয়? আমার মাথায় প্রথম আসে কৈশোরে আমার প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে রোববার গ্লোবে মেল গিবসনের প্যাশন অফ ক্রাইস্ট সিনেমাটি দেখতে যাওয়ার কথা। যিশু ভালবেসে মাশুল দিচ্ছেন গোটা ছবিজুড়ে। ক্রুশ বইছেন, চাবুক খাচ্ছেন রাস্তার সস্তা চোর পকেটমারদের সঙ্গে। মুখে বলছেন, এ আমার ভালবাসার ক্ষত। তাঁর রক্তে ভেজা মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন মেরি ম্যাগদালেন। এই দৃশ্য আমার বালকমনে জলছাপ হয়ে রয়ে গিয়েছে। অনেক পরে জানলাম যবন হরিদাসের কথা। হরিদাস ঈশ্বরপ্রেমে মগ্ন, যবন হয়েও কৃষ্ণনাম করেন। প্রথমে স্থানীয় জমিদার তার কাছে বাইজী পাঠাল। সেই বাইজী অচিরেই হরিদাসের কাছে ভক্তির পাঠ নিলেন। এরপর সবক শেখানোর পালা। বাইশটি বাজারে ঘুরে ঘুরে তাঁর পিঠে বেত মারা হলো। শেষে তিনি মরে গেছেন ভেবে তাঁকে ফেলে চলে এল কাজীর পেয়াদারা। কেন রা কাড়লেন না যবন হরিদাস? কারণ ভালবাসার ঘায়ে কাঁদতে চাইছেন তিনি। এ যেন নিজের কাছেই নিজের পরীক্ষা। যে শরীরটা মার খাচ্ছে সেটা কি আমার নয়? তাহলে আমি প্রতিহত করছি না কেন? কেন যন্ত্রণা সহ্য করছি? কারণ আমি সেই শরীরটার দাস নই। আমি মানে শুধু সেই শরীরটাই নই। আমার যেটুকু অহম্, সেল্ফ, আমি চাইছি তা ক্ষয়ে যাক, ধুয়ে যাক। এই হল ভালোবাসার ঘা। আমি ঘা খেয়ে, ঘা খেয়ে আত্মজ্ঞানহীন, সেলফলেস হয়ে যাচ্ছি, হয়ে যাচ্ছি তোমার। যত মার খাচ্ছি, জীবন যত মারছে, আমি তত তোমার কাছে যাচ্ছি। আত্ম-পর দূরত্ব মিটছে ক্রমে। রবীন্দ্রনাথের আরেকটি গানের শুরুয়াত মনে পড়তে পারে কারো-
আরো আরো প্রভু, আরো আরো।এমনি করে আমায় মারো।
মার খাওয়া যেন একটা সংলাপ। যত মার খাচ্ছি আমি তত কাছে যাচ্ছি আমার কাঙ্খিতজনের। মার খেতে খেতে পিঠ বেঁকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে দাঁড়াতে পারব না উঠে, তবু আমি পিঠ পেতে রেখেছি। একদিকে ভাবলে দীন ভারতীয় জীবনের এইটাই তো যাপনের ব্যসবাক্য। আবার অন্য দিক থেকে ভাবলে প্রচলিত খ্রিস্টাচার। যারা ভিঞ্চিকোড দেখেছেন তারা জানেন ঈশ্বরের নামে রক্তপাতের বিষয়টি। শুধুই কি খ্রিস্টানদের মধ্যে এই যন্ত্রণার অভিজ্ঞান রয়েছে? না, রয়েছে লোকায়ত ধর্মেও। গাজনে। বানফোঁড়া, আগুনঝাঁপ, কপালফোঁড়া কত কী! কেন এই উন্মাদনা? ঘা দিয়ে ভালবাসা প্রমাণ করা বোধহয়। একই জিনিস যারা দেখতে চায় তারা দেখতে পারে মহরমে। ভালবাসা এই আত্মহুতির প্রদর্শনের জন্যে কাউকে প্রস্তুত করে। ভালবাসার ঘা বোঝাতেই কি ঋত্বিক ঘটক তার ছবিতে রবীন্দ্রগানে চাবুকের শব্দ ব্যবহার করলেন? নীতা ভালবেসে ঘা খেয়েছে, জীবন তাকে সপাসপ চাবুক মেরেছে।
আবার অন্য একটি কথাও ভাবছি। ঘা শব্দটিতেই তো পচন অর্থ। রবীন্দ্রনাথ কি একটি শব্দ দ্বিবিধার্থে ব্যবহার করেননি? একটানা ভালবাসতে-বাসতে বাসতে মনে ঘা ধরে যায়নি? অনাদরের হলুদ পুঁজ ঝরে পড়েনি? সেই পুঁজ জমা ঘেয়ো অংশ ফেলে দিতে কি চোখের জল বেরিয়ে আসেনি? এই কি সেই কান্না?
আমাকে আশ্চর্য করে এর পরের দুটো লাইন। নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে। বেদনা যদি কারণ হয় চিৎকার, কান্না এই হবে সংগত অভিব্যক্তি। এখানে রবীন্দ্রনাথ একটা অন্য দিক খুলে দিচ্ছেন। পরিচয় করাচ্ছেন বেদনার পুলকের সঙ্গে। বেদনার পুলক, তাও কি হয়? চুম্বনে অপটুর ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোলে যে বেদনা জন্মায় তাতে কি পুলক নেই! যৌনতার যে বেদনা তা তো পুলকসঞ্চারীই। যাত্রাপথের আনন্দগান বইটিতে পড়েছি এই গানটি কমবয়সি মেয়েদের গাইয়ে তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছিল শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে। তার মানে, বেদনার পুলক কি শীর্ষসুখকে ইঙ্গিত করে? যৌনতার কথা আরও এল অন্তরার কারণে। সকলের জানা পঙক্তি-
তোমার অভিসারে
যাব অগম পারে,
চলিতে পথে পথে
বাজুক ব্যথা পায়ে,
কাঁদালে তুমি মোরে।
অগম পার কোথায়? নারীর যোনিদ্বার? যার শেষ প্রেমিক জানে না। আকাশ? সচিন সেঞ্চুরি করে যেদিকে চেয়ে থাকত? সেই চেয়ে থাকাটুকুর জন্য সচিনকে লড়তে হয়েছে, ক্রমে লড়তে হয়েছে। ভাঙতে থাকা শরীরের সঙ্গে, মনের সঙ্গে, সব ধরনের প্রতিরোধের সঙ্গে। একে পথশ্রম বলে হয়তো। কাঁটা ফুটলে অস্ফূটে মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় যার কোনও মানে নেই, রয়েছে শুধু ধ্বনি। রবীন্দ্রনাথ তাই ব্যথা শব্দটির সঙ্গে বাজা জুড়ে দিয়েছেন, বাজুক ব্যথা পায়ে। ব্যথা যে বাজে তা আমরা ভাবিনি তার আগে পরে। এই রবীন্দ্রনাথই লিখেছেন, বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে।
বেদনার বাজনা মাথায় ঝমঝম করে বাজছে। তবু যে অগম পারে যেতে চাইছে, প্রেম সেই কাঙালের। আর প্রেমের মতোই গান। সর্বস্ব লুঠ করে কাঙাল করে দিল। তবু তাকে ছাড়া যাচ্ছে না। হয়তো বাড়িতে এখন আনন্দ, হুল্লোড়, কিন্তু গান কাঙাল করে রেখেছে যে শুনছে তাকে। কাঙাল মন ভাবছে, গান তাকে দিয়ে ভাবাচ্ছে, যে চলে গেল সে এ ভাবে না গেলেও পারত। বলে গেলে পারত। কতদূর গেল সে? ভালবাসা এমনিতে ভালো। গানের মতো। কিন্তু সে ঘা দেয় আচম্বিতে, সহযাত্রীর অনুপস্থিতি জানান দিয়ে, যে আমার সঙ্গে সুর করে গান গাইত সে আজ নেই, এইটুকু প্রমাণ করে, আমাকে বেকুব করেই তার আত্মপ্রতিষ্ঠা। চোখের জলে ভাসা ছাড়া আর কোনো উপায় জানা আছে নাকি কারও? এর নামই বুঝি ভালবাসার ঘা।