চিত্রাঙ্গদা: ঋতুপর্ণর আত্মকথনে জেগে থাকেন অঞ্জন দত্ত

Rituparno Ghosh: পরিচালক দর্শককে খুবই স্পষ্টভাবে বুঝতে দিতে চান যে সেই মেসেজটি করেছে আসলে শুভ, রুদ্রর পাশে বসেই। এর কারণ কী?

‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ এই দুই ভাব দিয়ে তৈরি আমাদের মন। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এই দুই ভাবের বিচিত্র বসবাস। বিচিত্র কেন? কারণ, যে ‘নারী’ বলে নিজেকে ভাবে, জানে— তার ভেতরেও একজন পুরুষ রয়েছে। আবার, নিজের কাছে পরিচিত একজন পুরুষের অস্তিত্বের মধ্যে নীরবে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে একজন নারী।

আমি কিন্তু নারী বা পুরুষ শরীরের কথা বলছি না। বলছি, নারীভাব ও পুরুষভাবের কথা। তাই, ভিন্নযৌনতার মানুষ, যিনি দেহে পুরুষ হলেও মনে-মনে সম্পূর্ণ নারী, তাঁর সেই নারীমনের মধ্যেও পুরুষভাবের কিছু অংশ কোনও-না-কোনও থাকবেই। কীভাবে থাকবে? কতদূর থাকবে? তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। একটি ভাব তীব্র, অন্যটি কম। অথবা সমান-সমান, অথবা আরও ভিন্ন কোনও অবস্থান। যেভাবেই হোক, দু'জনের উপস্থিতি থাকবেই। তাই, আমরা কেউই পুরোপুরি কিছু নই। নারী, পুরুষ, বা ভিন্ন কোনও পরিচয়—
কোনওটাই কারও একার তৈরির নয়। অস্তিত্বের যে ভাবটি প্রখর হয়ে আছে, আমরা ভাবতে থাকি সেটুকুই বুঝি আমাদের সীমানা! তা আসলে নয়। এর বাইরেও আমাদের ভেতরে ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের অজ্ঞাত, আমাদেরই বহুতর রূপ!

‘চিত্রাঙ্গদা’-য় রুদ্র একজন সমকামী মানুষ। পার্থ, তাঁর প্রেমিক। রুদ্র চরিত্রটিকে যেভাবে তৈরি করে তুলেছিলেন ঋতুপর্ণ, দর্শকের অসুবিধা হয় না বুঝতে যে চরিত্রটির মধ্যে এক তীব্র নারীভাব উপস্থিত রয়েছে। কিন্তু সেই নারীভাবের অন্যপিঠের কথা কি কেউ আমরা ভেবে দেখেছি?

রুদ্র সেক্স চেঞ্জ করানোর সিদ্ধান্ত একে-একে নিজের জীবনের প্রিয়জনদের জানিয়েছিল। প্রথমে পার্থকে, যার সঙ্গে থাকার জন্য তার এই পরিবর্তনইচ্ছা, যে তাঁর জীবনের প্রেম। তারপর, যাঁরা তাঁকে জন্ম দিয়েছে সেই মা-বাবাকে। তারপর? এখানেই শেষ? হয়তো না।
আমরা ভুলে যেতে পারি না, রুদ্র যে শরীরটাতে বাস করছে তা একজন পুরুষের শরীর। তার মনের নারীভাবের পাশেই, নিভৃত কোণে একটি পুরুষভাবও রয়েছে। তাঁর জীবনে এসে-পড়া প্রেম-কাম-শিল্প— এই সমস্ত অনুভূতিকে রুদ্রর প্রধান অস্তিত্ব নারীমনের পাশাপাশি, তাঁর মনের সেই পুরুষভাবও গ্রহণ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, এতদিন সে থেকেছে এক পুরুষ দেহের ভেতর। আজ, এই যৌনপরিবর্তন, নিজের পুরুষ শরীরকে সে জানাবে না? জানাবে নিজের পুরুষভাবকে?

আরও পড়ুন-ঋতুপর্ণর ‘চিত্রাঙ্গদা’ একটা ইচ্ছের গল্প, কিন্তু কার?

ঠিক এই চিন্তার হাত ধরে এসে দাঁড়ায় অঞ্জন দত্ত অভিনীত ‘শুভ’ চরিত্রটি। একটি সাক্ষাৎকারে ঋতুপর্ণ ঘোষকে প্রশ্ন করা হয়েছিল:

প্রশ্ন। If Shubho (a counsellor, played by Anjan Dutt) is an alter ego of Rudra, why didn’t you consider making it a female character?

উত্তর। Rudra is living with his feminine self, so he is talking to his masculine self, which is Shubho… I did what came naturally to me, or else it would have become a psychology class.

অর্থাৎ সম্পূর্ণ ছবিটিতে সেক্সচেঞ্জ করানোর মুহূর্তে রুদ্রর নারীমন নিজের পুরুষমনের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে ফিরে দেখছে নিজের জীবনকে। নিজের শরীরকে। এমনকী নিজের শিল্পকেও। সেই কথোপকথন থেকে তিনটি দৃশ্যের কথা বলতে চাইব।

ছবির প্রথম দিকের একটি দৃশ্যে রুদ্র ও শুভর মধ্যে সংলাপ মুহূর্তটি এমন:

রুদ্র। ঘোরানো সিঁড়ির ইংরেজি কী?
শুভ। হুম… কী?
রুদ্র। ঘোরানো সিঁড়ির ইংরেজি কী?
শুভ। স্পাইরাল স্টেকেস (হাত দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দেখিয়ে)
রুদ্র। পারলে না। (মৃদু হেসে)
শুভ। স্পাইরাল স্টেকেস? (আবারও হাত দিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি দেখিয়ে)
রুদ্র। আবার পারলে না। যে কোনও মানুষ ঘোরানো সিঁড়ি বা স্পাইরাল স্টেকেস বলতে গেলে, (হাতের আঙুল ঘুরিয়ে) এটা করে। আমি ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো অন্যরকমভাবে বলবে!
শুভ। কেন? আমায় অন্যরকম ভাবতে গেলে কেন?
রুদ্র। আমি ভেবেছিলাম, তোমার পেশেন্টরা, যারা তোমার কাছে আসে, যাদের সঙ্গে তুমি ইন্টারঅ্যাক্ট করো, তারা ইনভেরিয়েভলি ‘ঘোরানো সিঁড়ি’ বা ‘স্পাইরাল স্টেকেস’ বললে এরকম করে! তুমি অ্যাটলিস্ট অন্যরকম করবে।
শুভ। তাহলে তো আমার ডান্সার পেশেন্ট থাকার কথাই নয়। তারা হাত-পা নেড়ে ছাড়া কথা বলতে পারে না।
(এই সময় রুদ্রর ফোনে একটি এসএমএস ঢোকে)
রুদ্র। এই, এটা শোনো! দিস ইন্টারেস্টিং! ইফ ড্রাংকিং ড্রাইভিং ইজ নট অ্যালাউড, দেন হাও কাম বারস্‌ হ্যাভ পার্কিং লটস্‌?
শুভ। কে?
রুদ্র। জানি না। নাম নেই।
শুভ। চেনা?
রুদ্র। ৯৮৩১৫৬০০৪।
(রুদ্র ডায়েল করে নম্বরটি। অন্যদিকে, শুভ নিজের মোবাইলটা সুইচ অফ করে দেয়)
রুদ্র। নাহ…সম্পর্ক নেহি হো পা রাহা হ্যায়। আনঅ্যাভেলেবেল।
শুভ। পার্থ ফোন করেছিল?
রুদ্র। না, করেনি।
শুভ। তুমি করেছিলে?
রুদ্র। না।
শুভ। করতে ইচ্ছে করেছে না?
রুদ্র। না। দেখতে ইচ্ছে করছে।

এই সংলাপের মধ্যে অনেকগুলি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ! পরপর বলার চেষ্টা করছি। স্পাইরাল স্টেস্কেস বা ঘোরানো সিঁড়ির একটি তৈলচিত্র টাঙানো ছিল রুদ্রর নার্সিংহোমের ঘরে। সেই ছবিটির সূত্রেই কথা ওঠে। এবং রুদ্রর ফোনে একটা মেসেজ ঢোকে, যেখানে কলব্যাক করে সুইচ অফ পায় রুদ্র। অথচ, পরিচালক দর্শককে খুবই স্পষ্টভাবে বুঝতে দিতে চান যে সেই মেসেজটি করেছে আসলে শুভ, রুদ্রর পাশে বসেই। এর কারণ কী?

‘সিঁড়ি’ এমন একটি জিনিস, যাকে আশ্রয় করে ওঠা যায়। নামাও যায়। নিজের অস্তিত্বের পুরুষভাবের সঙ্গে যখন কথা বলছে রুদ্র, তখন তার মনের ওঠা-নামা, একবার অতলে আরেকবার আকাশে পৌঁছনো— স্বাভাবিক ব্যাপার। সেই সংকেতকে সিঁড়ির মধ্যে দিয়ে এখানে সংকেতসূত্রে প্রতিস্থাপন করলেন ঋতুপর্ণ!

আরও পড়ুন-ঋতুপর্ণর চিত্রাঙ্গদা: ফেলে আসা প্রথম প্রেমের অবিচল চরণধ্বনি

শুধু তাই নয়, এর রেশকে ঋতুপর্ণ নিয়ে গেলেন অন্য মুহূর্তের সংলাপে, সিঁড়ির ধর্ম অনুযায়ী নেমে গেলেন মনের অন্য অবগাহনে।

শুভ। আচ্ছা এই পুরো প্রসেসটা দিয়ে যাওয়ার পর তুমি পুরো ব্যাপারটা এন্ট্যায়রলি টেকনিক্যালি মেনে নিতে পারবে?
রুদ্র। মানে?
শুভ। তুমি অলরেডি নার্সদের ‘স্যার’ বলতে বারণ করেছ, ভেবে দ্যাখো!
রুদ্র। পার্থকে কখনও ঘোরানো সিঁড়ির ইংরেজি জিজ্ঞেস করিনি। (আঙুল ঘুরিয়ে) এমন করে বলত কিনা জানি না।
শুভ। আবার যদি দেখা হয়, জিজ্ঞেস করবে?
রুদ্র। কত কী জিজ্ঞেস করিনি! আমি বলছিলাম না যে, আই ডোন্ট নো চিত্রাঙ্গদা ওয়েল এনাফ। বাট দেন, ডিড আই নো পার্থ ওয়েল এনাফ? ডু আই নো মাই পেরেন্টস ওয়েল এনাফ? আমার দলের ছেলেমেয়েরা? ওদের চিনি আমি?
শুভ। বাট লুক অ্যাট দ্য ফ্লিপ সাইড, ইউ গট টু নো ইওর সেলফ!
রুদ্র। আই ডাউট ইট!

এখানে আমরা বুঝতে পারি, প্রথম সংলাপে কেন ‘ঘোরানো সিঁড়ি’-র শব্দচিত্রআবহকে ব্যবহার করেছিলেন ঋতুপর্ণ। আসলে এ হলো, নিজেই নিজেকে খোঁজার এক ক্রমপথ, যেখানে শেষ অবধি আত্মসন্দেহ থেকেই যায়। থেকে যায় 'ডাউট'। তাই, নিজেকে পুরোপুরি বুঝতে পারে না রুদ্র। এ অনেকটা কবিতার মতন। যেখানে শব্দ, ধীরে-ধীরে নিজের প্রকৃত অর্থ উন্মোচন করে।

এর পাশেই একটি অন্য সংলাপে আবারও দেখতে পাই শুভর পাঠানো আত্মগোপনকারী মেসেজ। রুদ্র মেসেজটি পড়ে:

রুদ্র। হোয়াই ইজ ইট, দ্যাট এভরি বডি ওয়ান্টস টু গো টু হেভেন বাট ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডাই! প্রোফাউন্ড
শুভ। সেম নম্বর?
রুদ্র। হুম।
শুভ। দাও
রুদ্র। ৯৮৩১৫৫৬০০৪
শুভ। আনঅ্যাভেলেবল!

এইখানে এসে, অপরিচিত নম্বরটির সঙ্গে রুদ্রর একটি সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। সেই সম্পর্কই সর্বাত্মকভাবে জেগে ওঠে ছবির শেষের দিকে। যেখানে ঊষাকাল। সমুদ্রতীর। রুদ্র আর শুভ হেঁটে আসছে।

রুদ্র। আচ্ছা, আমি তো কাল অপরেশন টেবিলে মারাও যেতে পারি?
শুভ। যেতে পারি কেন? যাবে। ইউ ওয়াকড ফর আ নিউ লাইফ! দুটো জীবন তো একসঙ্গে থাকতে পারে না? হুম? ইউ হ্যাভ টু গিভ ওয়ান আপ। এখন তোমাকে ডিসাইড করতে হবে, হাউ ইউ উইশড টু বি রিমেম্বারড?
রুদ্র। অ্যাজ দ্য ভাইভেসিয়াস, এনারজেটিক, এক্সেন্ট্রিক, ক্রিয়েটিভ ডান্সার?
শুভ। নাকি চিত্রাঙ্গদা, সুরূপা?
রুদ্র। কিন্তু সেটাও তো পার্মানেন্ট নয়? ইম্মটারল নয়? হুম… না। তুমি আমায় কনফিউজ করো না। আর যে করুক, তুমি করো না।
নার্স। গুড মর্নিং স্যার। ডক্টর সোম বলেছেন আপনার খাবারটা খেয়ে নিতে। এখন ছ'টা বাজে। আর চার ঘণ্টা পরে অপরেশন।
রুদ্র। কী করব?
শুভ। আমি ডক্টর সোমকে ফোন করছি।
রুদ্রর ফোনে আবারও এসএমএস ঢোকে। এসএমএসটি হলো, ‘হোয়াই ইজ আ বিল্ডিং কল্ড আ বিল্ডিং ইভেন আফটার ইটস কমপ্লিট?’
রুদ্র। হোয়াই?
শুভর ফোনের মেসেজ ঢোকার রিং বাজে।
শুভ। বিকজ নো ট্রাঞ্জেশন ইজ এভার কমপ্লিট। ইটস আ অনগোয়িং প্রসেস!
Chitrangada

একটা বিল্ডিংকে তার নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও আমরা বিল্ডিং নামে ডাকি কেন? ডাকি তার কারণ, কোনও নির্মাণই সম্পূর্ণ নয়। এ এক প্রবহমান পদ্ধতি।

আরও পড়ুন-সমপ্রেমের আলোয় রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’-কে নতুন করে দেখেছিলেন ঋতুপর্ণ

এখানে মনে রাখতে হবে, এই অভাবনীয় প্রশ্নের উদ্রেক ও তার উত্তর যে রুদ্রকে দিচ্ছে সে আসলে তারই অস্তিত্বের পুরুষভাব। এবং যখন এইকথাগুলি সে বলছে, তার কিছু পরেই সেক্সচেঞ্জের অপরেশন হবে রুদ্রর। পুরুষ শরীর থেকে নারী শরীরের দিকে সে হেঁটে যাবে। প্রশ্ন জাগে, ওই ঊষাকালে সমুদ্রতীর তবে কি ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’-এর মধ্যকার আলো-অন্ধকার ভূমি?

আমার মনে হয়, যে-কোনও প্রশংসাই ‘শুভ’ চরিত্রটির বুননের ক্ষেত্রে যথার্থ নয়। কারণ, একা এই চরিত্রটি আত্মকথনে এগিয়ে নিয়ে গেছে রুদ্রকে। এমনকী তাঁর বহু অজানা মনের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। হয়তো এই কারণেই চরিত্রটির প্রফেশন হিসেবে মনোবিদের পরিচয়-পোশাককে ব্যবহার করেছিলেন ঋতুপর্ণ! এবং তাঁকে দিয়ে প্রায় পুনর্বার রুদ্র ফেলে-আসা জীবনকে অনুপুঙ্খ পাঠ করিয়ে নিয়েছে। এই চরিত্রে, অঞ্জন দত্তের কণ্ঠের অনবদ্য ব্যবহার, হাঁটা, ধৈর্য এবং রুদ্র-র মনকে আগে থেকে কিছুটা জেনে যাওয়া, এক পরিপূরক সত্তার আবেশে পূর্ণ মুখচ্ছবি চরিত্রটিকে সবচেয়ে স্মরণীয় করে তোলে। তাই মনে হয়, ‘চিত্রাঙ্গদা’ ছবিটিকে অতলে বুঝতে গেলে কেবল ‘শুভ’ চরিত্রটিকে নিবিড়ে, বারংবার দেখা ও ভাবা উচিত!

More Articles