গঙ্গা হাইজ্যাক থেকে অপারেশন মেঘদূত, ৬৭ বছর যেভাবে অপারেশন চালাচ্ছে RAW
RAW: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত কমিশন (USCIRF) ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু ভারত-বিরোধীদের বিদেশের মাটিতে হত্যার চেষ্টার অভিযোগ এনে র-কে নিষিদ্ধ ঘোষণার সুপারিশ করেছে
ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং ওরফে র-এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার সুপারিশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে প্রতিক্রিয়া পাল্টা প্রতিক্রিয়ার লড়াই শুরু হয়েছে এই সুপারিশ ঘিরেই। রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং ভারতের একমাত্র গোয়েন্দা সংস্থা যারা ভারতের বাইরে চলা ভারত বিরোধী কাজের ব্যাপারে দিল্লিকে খবরাখবর সরবরাহ করে। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর, গোয়েন্দা তথ্যের দুর্বলতা উপলব্ধি করে, ১৯৬৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানের পথচলা শুরু হয়। র-এর গড়ে ওঠা, কাজকর্ম, অপারেশনের ধরনধারণ ইত্যবসরে ফিরে দেখা যেতে পারে।
প্রাক র যুগ
১৯৬৮ সালে র প্রতিষ্ঠিত হলেও, এর ভিত তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমলেই। ১৮৩০ সালে জব্বলপুরের ডাকাতদের সঙ্গে মোকাবিলার জন্য ব্রিটিশ সরকার ঠগী ও ডাকাতি নামের একটি শাখা গঠন করে এবং তারা ডাকাতদের দলের সঙ্গে নিজেরা মিশে গিয়ে তাদের খবর উপরমহলে পৌঁছতে শুরু করে। এই শাখার মাধ্যমে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার এই ডাকাতদের দমন করতে সক্ষম হয়। সেই সময় থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীদের থামানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার গঠন করে সেন্ট্রাল স্পেশাল ব্রাঞ্চ। ১৮৮৭ সালে তৎকালীন ভারতীয় ব্রিটিশ পুলিশের এই বিশেষ শাখার সূচনা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯২০ সালে এই শাখার নাম পরিবর্তন করে হয় ইন্টালিজেন্স ব্যুরো ওরফে IB। এর পাশাপাশি মিলিটারিতে সাফল্য লাভের জন্য পরবর্তীতে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স নামের একটি শাখা সংগঠনও তৈরি করে।
স্বাধীনতার পর ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যেরকম জমি ভাগাভাগি হয়, সেরকম ভাবেই গোয়েন্দা সংস্থারও ভাগাভাগি হয়। ভারতের কাছে আসে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো এবং পাকিস্তানের কাছে পৌঁছে যায় মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স শাখা। তবে, স্বাধীনতার সময় ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো খুব সক্রিয় ছিল না। সেই সময় ভারতে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাও ছিল না। ফলে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোকেই বাধ্য হয়ে ভারতের অন্তর্বর্তী বিষয়ের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য বিষয়ের উপরে কাজ করতে হচ্ছিল।
র-এর প্রাসঙ্গিকতা
বিপত্তি শুরু হয় ১৯৫৪ সালে চিনের একটি বিশেষ ম্যাপ প্রকাশের পর থেকে। সেখানে চিন ভারতীয় ভূ-খণ্ডের ১২০০০ কিলোমিটার অংশ নিজেদের দেশের অংশ হিসাবে দাবি করে। প্রাথমিক বিরোধের পর চিন এই ম্যাপ প্রকাশের বিষয়টা অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে জানা যায়, চিন আগে থেকেই অরুণাচল প্রদেশ এবং উত্তরপূর্ব ভারতের একটা বিস্তীর্ণ অংশ দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। কোনওভাবে তাদের সেই গুপ্ত ম্যাপ বাইরে চলে আসে। এই তথ্য জানার পরেও, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টালিজেন্স ব্যুরো চিনের ব্যাপারে খুব একটা বেশি তথ্য জোগাড় করতে পারেনি। ফলে, তাদের অজান্তেই ১৯৬২ সালে অরুণাচল প্রদেশের সীমানা হয়ে ভারতীয় ভূ-খণ্ডে হামলা চালায় চিন। আইবি-র ভুলের কারণে ভারতীয় প্রতিরক্ষা দপ্তর এয়ার ফোর্সের ব্যবহার করতে পারেনি। চিন যেহেতু তিব্বত থেকে এই যুদ্ধ চালাচ্ছিল, কোনওরকম এয়ারবেস ছিল না তাদের কাছে। ফলে ভারত যদি এয়ারফোর্স ব্যবহার করত, তাহলে ১৯৬২ চিন-ভারত যুদ্ধে ভারত জয়ী হতে পারত অনায়াসেই। অথচ, হলো ঠিক উল্টোটা, আইবি-র অপর্যাপ্ত তথ্যের কারণে ভারত চিন যুদ্ধে পরাজিত হলো ভারত।
এই যুদ্ধের পর ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোকে আরো শক্তিশালী করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আরো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোকে আধুনিক করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু, সময় এবং অর্থ বিনিয়োগের পরেও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কাজের বিশেষ উন্নতি হয়নি। ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধেও ভারতীয় প্রতিরক্ষা দপ্তরকে খুব একটা সাহায্য করে উঠতে পারেনি আইবি। ফলস্বরূপ ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধেও ভারত ব্যর্থ হয়েছে।
র-এর প্রতিষ্ঠা
একের পর এক দু'টি যুদ্ধে পরাজয়ের পর ভারত তখন একেবারেই কোণঠাসা। এর মাঝেই ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে বসেন ইন্দিরা গান্ধি। ইন্দিরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেই তিনি তলব করেন তার পুরোনো বিশ্বস্ত অফিসার আর এন কাওকে। ইন্দিরা ও কাও-এর ব্যক্তিগত সেই বৈঠকের ২ মাস পর কাও একটি বিশেষ গোয়েন্দা শাখা তৈরি করার ব্লু-প্রিন্ট দেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে। এই গোয়েন্দা শাখা সরাসরি ভাবে ভারতের বাইরের ভারত বিরোধী কার্যকলাপ রোধের জন্য কাজ করবে এবং এই বিষয়ক সমস্ত আপডেট সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেবে। সেই বৈঠকে কাও এবং ইন্দিরা গান্ধি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ডিএস যোশী এবং তার কথামতই এই গোয়েন্দা শাখার নাম দেওয়া হয় রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং R&AW ওরফে 'র'। এই বৈঠকের মাস কয়েক পরেই ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে RAW। সেই সময় R&AW এর বাজেট রাখা হয় ২ কোটি টাকা এবং তাদের অফিস তৈরি হয় দক্ষিণ দিল্লির লোদি রোডে। অন্যদিকে ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কাজ কমিয়ে তাদেরকে শুধুমাত্র ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কাজ শুরু
রিসার্চ এন্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের সবার প্রথম দায়িত্ব ছিল ভারতের বাইরে তাদের গুপ্তচরদের পাঠানো। এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন বিদেশ সচিব টিএন কৌলের উপর। তিনি ভারতের বাইরে যত ভারতীয় দূতাবাস রয়েছে সেখানে ভুয়ো চাকরির বিজ্ঞপ্তি জারি করেন এবং তারপর সেখানে বিভিন্ন ব্যক্তিদের নিযুক্ত করে তাদেরকে ভারতের গুপ্তচর হিসেবে ট্রেনিং দিয়ে তাদের পরিচয় পরিবর্তন করে বিভিন্ন দেশে পাঠানো শুরু করেন। বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতীয় গুপ্তচররা রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে মর্স কোড তৈরি করে ভারতে পাঠাতো এবং সেই তথ্য চলে যেত সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কাছে। কিন্তু, তার মাঝেই সমস্যা সৃষ্টি করে দেয় IB। যেহেতু গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে তাদের গুরুত্ব কমে যেতে শুরু করে, তাই তারা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের কর্মকর্তাদের এবং তাদের কাজের ধরনের সরাসরি বিরোধিতা শুরু করেন। ফলে অগত্যা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আইবি এবং র এর সমস্যার মধ্যে প্রবেশ করতে হয় এবং তার কথামতই রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের প্রধানকে ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এর মাঝেই আরো একটি বড় পরিবর্তন আসে তাদের কার্যপ্রক্রিয়ায়। জানানো হয়, যদি ভারতের কোন অধিবাসী আরএসএস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাহলে তিনি এবং তার পরিবারের কোনও সদস্য র-এর সদস্য হতে পারবেন না। আর এখনও পর্যন্ত কিন্তু এই নিয়ম বহাল রয়েছে।
প্রথম অপারেশন - গঙ্গা হাইজ্যাক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই ভারত থেকে একাধিক দূতকে পাকিস্তানে পাঠানো শুরু করে র। এদের মধ্যে একজন ছিলেন কাশ্মীর বেদী, যিনি উর্দু এবং পাঞ্জাবি উভয় ভাষাতে বেশ সাবলীল ছিলেন এবং পাঞ্জাবি হলেও তিনি পাকিস্তানের বিষয়ে বেশ ভালো পড়াশোনা করেছিলেন। রিসার্চ এন্ড অ্যানালিসিস উইং তার নাম পরিবর্তন করে মহম্মদ ইব্রাহিম রাখে এবং দু'জন পাকিস্তানির মাধ্যমে তাকে সীমানা অতিক্রম করে পাকিস্তানে পাঠায় পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর ব্যাপারে খবরাখবর নেওয়ার জন্য।
কাশ্মীর বেদী পাকিস্তান থেকে রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে অমৃতসরে সমস্ত ধরনের ডিটেইল আপডেট পাঠাতেন এবং সেখান থেকে সেই আপডেট সরাসরি পৌঁছে যেত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। ১৯৭০ সালের অধুনা বাংলাদেশ নির্বাচনের আগে তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আমেরিকার সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার কাছ থেকে বেশ কিছু যুদ্ধবিমান এবং বোমা কেনেন। পাশাপাশি, আমেরিকার অনেক সেনাও পাকিস্তানে আসে যুদ্ধে ইন্ধন যোগানোর জন্য। এই তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ সীমানায় তৎপরতা বাড়ায় রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং। গুপ্তচরদের মাধ্যমে অধুনা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যবর্তী সমস্ত আলোচনা, নির্বাচনের পরিকল্পনা, কার জয়ের সম্ভাবনা বেশি, সব ব্যাপারে জানতে পারে ভারত।
তবে, সেই সময় কোনোরকম সঠিক প্রমাণের অভাবে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিমান পরিষেবা বন্ধ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি ভারত সরকারের পক্ষে। কিছুটা সময় অপেক্ষা করেন ইন্দিরা গান্ধি। আর তার মধ্যেই পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি একটা ভুল করে বসে, যেটা ভারতের কাছে একটা বড় সুযোগ হয়ে ওঠে। সেই সময় জম্মু-কাশ্মীর থেকে হাশিম কুরেশি নামের একজন ব্যক্তি পাকিস্তানে যান ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির মকবুল ভাটের সঙ্গে দেখা করতে। এর কিছুদিন আগেই পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর থেকে ভারতের কাশ্মীরে ৩৬ জন জঙ্গি প্রবেশ করার চেষ্টায় ভারতীয় সেনার হাতে ধরা পড়েন।
মকবুল হাসিম কুরেশিকে ট্রেনিং দেন ভারতের একটি বিমান এরোপ্লেন গঙ্গা হাইজ্যাক করার জন্য। ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির লক্ষ্য ছিল ভারত সরকারকে চাপে ফেলে ওই ৩৬ জন জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়া। কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার চরেরা মকবুল এবং হাসিম কুরেশির সাক্ষাতের ব্যাপারে ভারত সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে হাসিম কুরেশি ভারতে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় সেনার হাতে ধরা পড়েন এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারত সরকার তাকে র-এর কাজে ব্যবহার করে। তাকে জানানো হয় সে প্লেন হাইজ্যাক করবে কিন্তু সেই প্লেনে সাধারণ মানুষ থাকবেন না, পরিবর্তে থাকবেন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার সদস্যরা। লাহোরে সেই প্লেন নামবে এবং তারপর কুরেশি দেখা করবেন তৎকালীন পাকিস্তানের বিরোধী দলনেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে।
সেই কথা মতোই কাজ করেন কুরেশি এবং অবশেষে পাকিস্তান চাপে পড়ে সেই ভারতীয় গুপ্তচরদের আবার ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে এবং পাকিস্তানের কাশ্মীর দখলের সেই প্ল্যান ভেস্তে যায়। জুলফিকার আলী ভুট্টো যদিও কোনোদিন এই প্লেন হাইজ্যাক করার পরিকল্পনার অভিযোগের সরাসরি বিরোধিতা করেননি। ফলে, এই পরিকল্পনার সঙ্গে যে জুলফিকার আলী ভুট্টো জড়িত ছিলেন সেটা পাকিস্তানের জনতার মধ্যে রটে যায় এবং পাকিস্তানের সেবছরের নির্বাচনেও ভুট্টো পরাজিত হন। পরে জানা যায় ভারতীয় গুপ্তচরদের ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হলেও সেই প্লেন ভারতে আসেনি। সেই প্লেনকে লাহোরেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সঙ্গেই হাশিম কুরেশিকে ১৯ বছরের জন্য জেল হেফাজতের রায় দিয়েছিল পাকিস্তান আদালত।
এই অপারেশন র-এর ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন, কারণে এই অপারেশনের ফলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভারতের উপর থেকে সরাসরি বিমান যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায় এবং অধুনা বাংলাদেশের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা কমে আসে। ফলে সহজেই মুজিবুর রহমান জয়লাভ করেন এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।
অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধ এবং জরুরি অবস্থা
১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধির সহযোগিতায় ভারত প্রথমবারের জন্য নিউক্লিয়ার টেস্ট করে এবং এর নাম দেওয়া হয় অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধ। এই গোটা অপারেশনের গোপনীয়তা বজায় রাখার দায়িত্ব ছিল ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার রয়ের উপর। এই সংস্থাটি যথাযথভাবেই তাদের দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু, ১৯৭৫ সালের ১২ই জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট একটি রায় ঘোষণা করে, যেখানে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, ১৯৭১ সালের নির্বাচনে কারচুপি করার। এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানায়, ১৯৭১ সালের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী দলের সদস্যদের উপরে অবমাননাকর কার্যকলাপ চালিয়েছেন এবং তাদের অজান্তেই তাদের ব্যাংক একাউন্ট থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত তথ্য নির্বাচনে জয়ের জন্য ব্যবহার করেছেন। অভিযোগ ওঠে, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং এর উপরেও। এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানায়, ভারতীয় এই গুপ্তচর সংস্থা সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীর হয়ে কাজ করেছে এবং বিরোধী দলের নেতাদের গোপন তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে এই সংস্থা।
এই রায় ঘোষণার পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে বিরোধী দলগুলি। ইন্দিরা গান্ধীর পদত্যাগ দাবি করতে শুরু করে বিরোধী দলগুলি। বিভিন্ন জায়গায় মিছিল বিক্ষোভ সমাবেশ চলতে থাকে। এমনকী র-এর বিরুদ্ধেও আওয়াজ জোরালো হয়। পরিস্থিতি যখন একেবারেই হাতের বাইরে যেতে শুরু করে তখন আচমকাই ২৫ জুন ১৯৭৫ রাত্রে ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করে দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ।
১৯৭৭ সালে জরুরি অবস্থা শেষ হলে নির্বাচন হয় এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোরারজি দেশাই। তিনি প্রধানমন্ত্রী হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের এই গুপ্তচর সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করেন, যার প্রধান ছিলেন মহারাষ্ট্র ক্যাডারের আই পি এস অফিসার এসপি সিং। এই তদন্তে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা ক্লিনচিট পেলেও মোরারজি দেশাইয়ের মনে হয়, র-এর প্রধান আর এন কাও ইন্দিরা গান্ধীর হয়ে কাজ করছেন এবং সেই কারণে, তাকে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা থেকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়। কাওয়ের অবসরের সঙ্গেই রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের অনেক অপারেশনের বাজেট কমিয়ে দেন মোরারজি দেশাই। ফলে একদিকে যেমন সমস্যা শুরু হয় এই গুপ্তচর সংস্থার কাজে তেমনই সমস্যা শুরু হয় এই সংস্থার গুপ্তচরদের। ফলে, এই কর্মীরা সরাসরি মিডিয়ার সামনে এসে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে শুরু করেন। ফলে, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের গুপ্তচরদের বিষয়ে অনেক দেশ সচেতন হওয়া শুরু করে দেয়।
র এবং মোসাদের গোপন সম্পর্কের সূচনা
১৯৫০-এর দশকে ভারত ইজরায়েলকে মুম্বইতে একটি কনস্যুলেট খোলার অনুমতি দিলেও, আরব বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় সম্পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে পিছিয়ে ছিল। তবে, নিরাপত্তার স্বার্থে র ও মোসাদের মধ্যে গোপন যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
এই দুই সংস্থার মূল উদ্বেগের বিষয় ছিল পাকিস্তান ও চিনের সামরিক সম্পর্ক এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের সহযোগিতা। ১৯৭১ সালে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো পিয়ংইয়ং সফরে যান এবং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেন। এছাড়া, পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তারা লিবিয়া ও ইরানের সেনাদের চিনা এবং উত্তর কোরিয়ার সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন।
আরও পড়ুন: RAW-কে নিষিদ্ধ করে ভারতকে দুর্বল করতে চাইছে ‘বন্ধু’ আমেরিকা?
পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি এবং র-মোসাদের অভিযান
১৯৭৭ সালে, প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের শাসনকালে র একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারে—পাকিস্তান গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির দিকে এগোচ্ছে। বিশেষ করে, ইসলামাবাদ কাহুটা-তে খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ প্লান্ট স্থাপন করে, যা কোনোভাবে ওয়াশিংটনের নজর এড়িয়ে যায়। তবে, র-এর গুপ্তচররা এই ব্যাপারে জানতে পারেন। তাঁরা সেই রিসার্চ ল্যাবের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং জানতে পারেন এই সব বিজ্ঞানীরা একটি নির্দিষ্ট পার্লারে চুল কাটতে যেতেন। একদিন যখন ওই বিজ্ঞানীরা সেই পার্লারে গিয়েছেন চুল কাটতে, তখন তাদের চুলের স্যাম্পেল সংগ্রহ করে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেন র-এর গুপ্তচররা। সেই চুলের স্যাম্পেলে রেডিয়েশনের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। ফলে, এর মাধ্যমেই প্রমাণ হয়ে যায় পাকিস্তান নিউক্লিয়ার টেস্ট করার দিকে এগোচ্ছে।
র এই তথ্য প্রধানমন্ত্রী দেশাইকে জানায়, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি নিজেই পাকিস্তানের সামরিক শাসক জিয়াউল হককে ফোন করে বলেন, "জেনারেল, আমি জানি আপনি কাহুটা-তে কী করছেন। র আমাকে সব তথ্য দিয়েছে।" এই মন্তব্যের ফলে র-এর অনেক গোপন সূত্র বিপদের মুখে পড়ে। অনেক র এজেন্ট সেই সময় নিহত হয়েছেন।
এই সময়েই মোসাদ ও র-এর মধ্যে আরও গভীর সহযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ১৯৭৭ সালে, ইজরায়েলের প্রখ্যাত জেনারেল মোশে দায়ান গোপনে কাঠমান্ডুতে ভারতীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পাকিস্তান মনে করেছিল, এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংস করা। ১৯৮১ সালে ইজরায়েল ইরাকের ওসিরাক পরমাণু চুল্লির ওপর বোমাবর্ষণ করলে পাকিস্তান আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ফলে, কাহুটা প্লান্টকে রক্ষা করার জন্য ইসলামাবাদ তার চারপাশে নিক্ষেপযোগ্য অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বসায়।
অপারেশন চাণক্য
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চরমে পৌঁছল। পাকিস্তানের আইএসআই, হিজবুল মুজাহিদিন, লস্কর-ই-তইবা সহ বিভিন্ন সংগঠনকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং অপারেশন চাণক্য পরিচালনা করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল আইএসআই-সমর্থিত জঙ্গি কার্যকলাপ দমন করা এবং কাশ্মীরে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
এই অপারেশনের প্রথম ধাপে র কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় গুপ্তচর নেটওয়ার্ক তৈরি করে। প্রাক্তন জঙ্গি, নিরপেক্ষ রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তানের মদদপুষ্ট জঙ্গিদের কার্যকলাপে বিরক্ত ছিল এবং নিরাপত্তা পুনরুদ্ধারের স্বার্থে র-এর সঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়। এসব গুপ্তচররা গোপনে তথ্য সরবরাহ করত, যা সেনাবাহিনীর অপারেশন পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আরও পড়ুন:সিনেমাই কি সত্যি! RAW- এর অন্দরে গুপ্তচরদের জীবন আসলে কেমন?
বলা চলে র কাশ্মীরে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে জঙ্গিদের মধ্যে সন্দেহ ও বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়। কাশ্মীরের হান্দেওয়ারা অঞ্চলে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে জঙ্গিদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের নিজেদের দলের সদস্যদের প্রতি সন্দেহ বাড়ে। এছাড়া, পাকিস্তান-সমর্থিত নেতাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়, যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সমর্থন কমে যায়।
এই অপারেশনের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পুলিশ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি নেতাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। কুপওয়ারায় হিজবুল মুজাহিদিনের কমান্ডার আমিন দারের ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া গেলে ভারতীয় বাহিনী সফল অভিযান চালিয়ে তাকে নির্মূল করে। এছাড়া, উরির কাছে অস্ত্র পাচারের গুরুত্বপূর্ণ রুট চিহ্নিত করে তা বন্ধ করা হয়। এই অপারেশন কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করতে সাহায্য করে এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে বড় উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
অপারেশন ক্যাকটাস
মালদ্বীপে র-এর সফল সামরিক হস্তক্ষেপ
১৯৮৮ সালের ৩ নভেম্বর, মালদ্বীপে একটি সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হয়, যা ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার ‘অপারেশন ক্যাকটাস’-এর মাধ্যমে ব্যর্থ হয়। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ লুতুফি, যিনি শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পিপলস লিবারেশন অর্গানাইজেশন অব তামিল ইলম (PLOTE)-এর সহায়তায় মালদ্বীপের সরকার ফেলে দেওয়ার এবং সেখানে ভারত বিরোধী কার্যকলাপ পরিচালনার পরিকল্পনা করেছিলেন। খবর পেয়ে, মালদ্বীপের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মৌমুন আবদুল গাইয়ুম দ্রুত ভারতের কাছে সামরিক সহায়তা চাইলে, ভারত কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই একটি সুসংগঠিত সামরিক অভিযান পরিচালনা করে এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়।
অভ্যুত্থানের সূচনা ও মালদ্বীপের আহ্বান
অভ্যুত্থানের জন্য প্লোটে-এর প্রায় ৬০ জন ভাড়াটে সৈন্য রাতের অন্ধকারে মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে অবতরণ করে এবং শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করে নেয়। রাষ্ট্রপতি গাইয়ুম প্রথমে তার বাসভবনে আটকা পড়েন, কিন্তু পরে সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারকে সাহায্যের জন্য আবেদন করেন। যদিও তিনি একাধিক দেশের কাছে সাহায্যের অনুরোধ জানান, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সাড়া দেন এবং সামরিক হস্তক্ষেপের নির্দেশ দেন।
ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং র অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু করে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর ৫০তম প্যারা ব্রিগেডের ৪০০ কমান্ডো মাত্র ১৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে বিমানযোগে মালেতে অবতরণ করে। ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজও দ্রুত মালদ্বীপের দিকে রওনা দেয়। প্যারাট্রুপাররা নামার পরই তারা রাষ্ট্রপতি গাইয়ুমকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয় এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।
সেনা অভিযানের ফলাফল দ্রুত প্রকাশ পায়। প্লোটে-এর সৈন্যরা ভারতের অভিযানের তীব্রতায় বিচলিত হয়ে পড়ে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বেশ কয়েকজন বিদ্রোহী পালানোর চেষ্টা করলেও ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘আইএনএস গোদাবরী’ ও ‘আইএনএস বেতওয়া’ তাদের আটক করে। অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী লুতুফিকেও গ্রেফতার করা হয় এবং মালদ্বীপ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
‘অপারেশন ক্যাকটাস’ ছিল ভারতের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সামরিক অভিযান, যেখানে দেশটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় দ্রুত হস্তক্ষেপ করে সফলতা অর্জন করে। ভারতের কার্যকর ভূমিকার জন্য আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগান ভারতের এই সাহসী উদ্যোগের প্রশংসা করেন। এছাড়াও, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গুপ্তচর সংস্থার দ্রুততার সঙ্গে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সামরিক বিশ্লেষকদের কাছ থেকে উচ্চ প্রশংসা অর্জন করে।
অপারেশন মেঘদূত: সিয়াচেন জয়ের নেপথ্যে র
১৯৮৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় যে, শীত শেষ হওয়ার পর তারা সিয়াচেন হিমবাহের মূল শৃঙ্গগুলো দখল করবে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৭ এপ্রিল ১৯৮৪ সালের মধ্যে তারা সৈন্য মোতায়েন করবে এবং সেই লক্ষ্যে লন্ডনের একটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ১৫০টি আর্কটিক শীতকালীন পোশাক অর্ডার করে। কিন্তু তারা জানত না যে, র ইতোমধ্যেই এই পরিকল্পনার সন্ধান পেয়ে গেছে।
র অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে পাকিস্তানের পরিকল্পনাটি নস্যাৎ করার ব্যবস্থা করে। ভারতের সেনাবাহিনীর জন্য ৩০০টি আর্কটিক পোশাক অগ্রিম অর্ডার করা হয়, যার ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর সরঞ্জাম সরবরাহ বিলম্বিত হয়। এই কৌশলের ফলে ভারতীয় সেনারা নিজেদের প্রয়োজনীয় গিয়ার আগে পেয়ে যায়, অথচ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের প্রয়োজনীয় শীতকালীন পোশাক ও সরঞ্জাম সময়মতো পায়নি। এই এক কৌশলী পদক্ষেপই ভারতকে এক বিশাল সুবিধা এনে দেয়।
র-এর তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি পাকিস্তানের আগে সিয়াচেনের শৃঙ্গে অভিযান শুরু করবে। ভারতীয় সেনাবাহিনী গোপনে মার্চ মাসেই তাদের অগ্রগতি শুরু করে। কিছু সেনাকে হেঁটে পূর্ব দিকের ঘাঁটিতে পৌঁছানো হয়, অন্যদিকে বাকিদের ১৩ এপ্রিল ১৯৮৪ সালে এয়ারড্রপ করা হয়। পাকিস্তান যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গতিবিধি আগেভাগে বুঝতে না পারে, সেই জন্য প্রথমে বিমান ব্যবহারের পরিবর্তে পায়ে হেঁটে অগ্রসর হওয়ার কৌশল নেওয়া হয়।
পাকিস্তান যখন জানতে পারে যে ভারত ইতিমধ্যেই সিয়াচেন পৌঁছে গিয়েছে, তখন তারা পাল্টা হামলা চালায়। তবে, পশ্চিম দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও পাকিস্তান তীব্র ঠান্ডা ও উচ্চতাজনিত প্রতিকূলতার কারণে ভারতীয় সেনাদের সরাতে ব্যর্থ হয়। লড়াইয়ের পর ভারত সিয়াচেনের শৃঙ্গগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
সাম্প্রতিক অভিযোগ
সম্প্রতি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং-এর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ উঠেছে আন্তর্জাতিক স্তরে, যা কূটনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কানাডায় খলিস্তানি নেতা গুরপতওয়ন্ত সিং পান্নুন হত্যার চেষ্টার ঘটনায় কানাডা সরকার ও মিডিয়া ভারতের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে টানাপোড়েনের দিকে নিয়ে গিয়েছে। যদিও ভারত সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে যে, তারা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেবে, তবে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।
ভারতের বিরুদ্ধে মার্কিন কমিশনের অভিযোগ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত কমিশন (USCIRF) ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে, দাবি করেছে যে সংখ্যালঘু ভারত-বিরোধীদের বিদেশের মাটিতে হত্যার চেষ্টা করছে এই সংস্থা। তারা র-কে নিষিদ্ধ ঘোষণার সুপারিশ করেছে এবং ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। যদিও, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইউএসসিআইআরএফ-কে পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছে। দাবি করেছে যে, এটি ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির কাঠামোর বাস্তবতাকে উপেক্ষা করছে।
ভারত সরকার ইউএসসিআইআরএফ-এর দাবিগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এ ধরনের প্রচেষ্টা ভারতের গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণুতার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারবে না। বিশেষ করে, খলিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপন করে কমিশন ভারতের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান নিচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ভারত জোর দিয়ে বলেছে যে ইউএসসিআইআরএফ-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে বাস্তবতার প্রতিফলন নেই এবং এটি সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বহুবার সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ খারিজ করেছেন এবং বলেছেন যে তাঁর সরকারের নীতিগুলো সব সম্প্রদায়ের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। যদিও নানা সময়ে প্রধানমন্ত্রী-সহ তামাম বিজেপি নেতার মন্তব্য, সংখ্যালঘু নির্যাতনের নানা সংবাদ শিরোনামের কারণে এই বিবৃতি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে।