RAW-কে নিষিদ্ধ করে ভারতকে দুর্বল করতে চাইছে 'বন্ধু' আমেরিকা?

RAW: গত প্রায় আড়াই দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শরিক ভারত। সেই ভারতের অন্যতম প্রধান সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাকে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে ইউএসসিআইআরএফ।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ বা ‘র’ -এর কার্যকলাপ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে ‘র’-এর বিরুদ্ধে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগ এবং ভারতের অভ্যন্তরে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের দাবি। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ (ইউএসসিআইআরএফ) থেকে উত্থাপিত একটি প্রতিবেদন এবং নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ ভারতের কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রমের ওপর নতুন করে আলোকপাত করেছে। মার্চ মাসে প্রকাশিত ইউএসসিআইআরএফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘র’ বিদেশে শিখ নেতাদের লক্ষ্য করে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত এবং ভারতের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বৈষম্য ও ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণে ভূমিকা রেখেছে।

এই অভিযোগের পেছনে দু'টি ঘটনা উল্লেখযোগ্য, ২০২৩ সালে কানাডায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যা এবং ২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুরপতবন্ত সিং পান্নুনের হত্যার পরিকল্পনা। ভারত সরকার এই সুপারিশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রক একে ‘পক্ষপাতমূলক’ ও ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। যা অস্বাভাবিক তা হলো ভারতের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর সুপারিশ করছে বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংসদের দুই কক্ষের সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটি কমিশন— যা নজিরবিহীন। গত প্রায় আড়াই দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শরিক ভারত। সেই ভারতের অন্যতম প্রধান সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাকে নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে ইউএসসিআইআরএফ। এই বিতর্ক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিখ সম্প্রদায়ের কিছু অংশ খালিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করে, যা ভারতের জন্য সংবেদনশীল।ইউএসসিআইআরএফ  দাবি করেছে, ‘র’ এই আন্দোলন দমনে কঠোর পদক্ষেপ করেছে, যার মধ্যে বিদেশে হত্যার পরিকল্পনাও রয়েছে।

এর আগে ইউএসসিআইআরএফ-এর কোনও দেশের সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করার নজির স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না। গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ (র)-এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ সেকারণেই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইউএসসিআইআরএফ সাধারণত ব্যক্তি বা বেসরকারি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগে বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়েছে, যেমন চিন, মায়ানমার বা ইরানের ক্ষেত্রে। কিন্তু কোনও দেশের সরকারি সংস্থাকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার সুপারিশের সুনির্দিষ্ট নজির নেই। ইউএসসিআইআরএফ প্রধানত বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং মার্কিন সরকারকে দেশভিত্তিক নীতিগত সুপারিশ করে। এর কার্যক্রম সাধারণত কোনও দেশকে 'বিশেষ উদ্বেগের দেশ' (Country of Particular Concern - CPC) হিসেবে চিহ্নিত করা বা ব্যক্তি ও সংগঠনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার পরামর্শ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে, কোনও দেশের সরকারি সংস্থাকে সরাসরি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ একটি বিরল এবং অস্বাভাবিক পদক্ষেপ। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিলে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এবং ২০২৫ সালের ২৫ মার্চ এই প্রতিবেদন প্রকাশের সঙ্গে নিজ্জর ও পান্নুনের ঘটনার তদন্ত এবং মার্কিন আদালতে মামলার অগ্রগতি মিলিত হয়েছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রে শিখ ফর জাস্টিস (SFJ)-এর মতো গোষ্ঠী এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপ এই সিদ্ধান্তে ভূমিকা রেখেছে। ইউএসসিআইআরএফ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ধর্মীয় স্বাধীনতার অবনতি নিয়ে সমালোচনা করে আসছে। ‘র’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশও তাদের ধারাবাহিক অবস্থানেরই একটি অংশ।

হরদীপ সিং নিজ্জর

আরও পড়ুন-সিনেমাই কি সত্যি! RAW- এর অন্দরে গুপ্তচরদের জীবন আসলে কেমন?

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠে থাকে প্রায়শই। বিশেষ করে দেশগুলির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অন্য দেশের গোয়েন্দাদের গোপন তৎপরতা। ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ (র) নিয়েও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর আগে বেশ কয়েকবার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ‘র’-এর কার্যক্রম প্রধানত গোপনীয় হওয়ায় এর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সবসময় প্রকাশ্যে প্রমাণিত হয় না, তবে বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন এটিকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন সময়ে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে, ‘র’ তাদের দেশে গোপন অভিযান চালায় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন জোগায়। ২০১৬ সালে পাকিস্তানে গ্রেফতার হওয়া কূলভূষণ জাধব নামে এক ভারতীয় নাগরিককে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। পাকিস্তান দাবি করে, জাধব ‘র’-এর এজেন্ট ছিলেন এবং বেলুচিস্তানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কাজ করছিলেন। ভারত এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলে যে, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত নৌসেনা কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

১৯৮০-র দশকে শ্রীলঙ্কার তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম-কে প্রশিক্ষণ ও সমর্থন দেওয়ার জন্য ‘র’-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। যদিও ভারত সরকার পরে এলটিটিই-এর বিরুদ্ধেই অবস্বান নেয়, তবুও এই সমর্থনের বিষয়টি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে স্থায়ীভাবে প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিকভাবে এটি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ২০২৩ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো দাবি করেন যে, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যার পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে। এই অভিযোগের পর কানাডা ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা দেখা দেয়। যদিও ভারত এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে, তবুও এটি ‘র’-এর কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক বিতর্কের একটি উদাহরণ হিসেবে দাঁড়ায়।বাংলাদেশ, নেপাল ও মলদ্বীপের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো সময়ে সময়ে ‘র’-এর বিরুদ্ধে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে। যদিও এই অভিযোগগুলো প্রায়ই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বিবেচিত হয়, তবুও তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘র’-এর ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

ভারত-চিন যুদ্ধ (১৯৬২) এবং ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের (১৯৬৫) পর ভারত সরকার বুঝতে পারে, দেশের গোয়েন্দা কার্যক্রমকে আরও সুসংহত করতে হবে। এর ফলে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে ১৯৬৮ সালে র-এর প্রতিষ্ঠা হয়। মূলত সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব পালনের জন্য। র-এর কাজ অত্যন্ত গোপনীয় হলেও, বিভিন্ন সময়ে তাদের ভূমিকা বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়েছে। র-এর প্রধান দায়িত্ব ভারতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিশেষত পাকিস্তান, চিন ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা এর অন্যতম লক্ষ্য। কাশ্মীরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমন করতে 'র' গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 'র' বিভিন্ন দেশে তাদের নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে এবং ভারতের কৌশলগত স্বার্থরক্ষায় সক্রিয় থাকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘটনায় র-এর ভূমিকা লক্ষ্য করা গেছে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা দেশগুলোর ক্ষেত্রে। ‘র’-এর কার্যক্রম সাধারণত গোপনীয় থাকলেও এর কিছু অপারেশন ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে। এর মধ্যে ‘কালবৈশাখী অপারেশন’ একটি কথিত গোপন অভিযান হিসেবে আলোচিত। একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব অনুসারে, ‘কালবৈশাখী অপারেশন’ ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বা তার আগে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) গোয়েন্দা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এই সময় ‘র’ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ‘কালবৈশাখী’ নামটি এই অভিযানের দ্রুততা এবং প্রভাবের প্রতীক হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তবে, এটি কোনও একক অপারেশনের পরিবর্তে একাধিক গোপন কার্যক্রমের কোডনেমও হতে পারে। গোয়েন্দা বিশ্লেষকদের মতে, এতে পাকিস্তানের সামরিক পরিকল্পনা বা অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের জয়ে সহায়ক হয়, শত্রুপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা ব্যক্তির ওপর আক্রমণ বা নজরদারিও চলে। পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং তাদের সঙ্গে সমন্বয় সাধন ছিল অপারেশন 'কালবৈশাখী'-র ম্যান্ডেট। এই অপারেশনে ‘র’-এর এজেন্টরা সম্ভবত কূটনৈতিক আড়ালে বা স্থানীয় সহযোগীদের মাধ্যমে কাজ করেছিল।

‘অপারেশন মেঘদূত’ ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ভারতীয় বিমান বাহিনী দ্বারা পরিচালিত একটি সামরিক অভিযান, যা ১৯৮৪ সালে সিয়াচেন গ্লেসিয়ার দখলের জন্য চালানো হয়েছিল। ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং’ এই অপারেশনে সরাসরি সামরিক অংশগ্রহণ না করলেও, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৮৪ সালে ‘র’ পাকিস্তানের পরিকল্পনা সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে, যার মধ্যে ছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক সল্টোরো রিজ দখলের প্রস্তুতি। এই তথ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সময়মতো পদক্ষেপ করতে সাহায্য করে। ‘র’-এর গোয়েন্দা কার্যক্রমের মাধ্যমে জানা যায়, পাকিস্তান লন্ডনের একটি সরবরাহকারীর কাছ থেকে আর্কটিক আবহাওয়ার সরঞ্জাম কিনছে, যিনি ভারতেরও সরবরাহকারী ছিলেন। এই তথ্য ভারতকে পাকিস্তানের পরিকল্পনার আগেই অভিযান শুরু করতে সাহায্য করে। ‘অপারেশন ফালকন’ ১৯৮৬-৮৭ সালে সিকিম ও অরুণাচল প্রদেশে চিনা অনুপ্রবেশ রোধে ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এটি সুমদোরং চু সংকটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও, সিকিমে চিনা গতিবিধির প্রেক্ষিতেও ভারতকে সতর্ক রাখে। ‘র’ চিনা সৈন্যদের গতিবিধি, তাদের সরবরাহ লাইন এবং সুমদোরং চুতে পোস্ট তৈরির পরিকল্পনা সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম করে। ‘র’ তিব্বতি প্রবাসী ও স্থানীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তিব্বত থেকে তথ্য সংগ্রহ করত, যা চিনের সামরিক পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা দেয়। সিকিম ও অরুণাচলের কাছাকাছি তিব্বতি অঞ্চল থেকে এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ‘র’ ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে চিনের সম্ভাব্য সহযোগীদের (যেমন পাকিস্তান) গতিবিধির উপর নজর রাখে, যা ভারতের সামগ্রিক কৌশলের অংশ ছিল।

২০১৪ সালের পর ‘র’-এর কর্মপদ্ধতিতে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, যা মূলত ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা নীতি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রতিফলন। যদিও ‘র’-এর কার্যক্রম গোপনীয় থাকায়, বিভিন্ন বিশ্লেষণ, প্রতিবেদন এবং গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এই পরিবর্তনগুলো চিহ্নিত করা যায়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের নিরাপত্তা কাঠামোতে ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, যার ফলে ‘র’ সাইবার গোয়েন্দা এবং সাইবার নিরাপত্তায় তার কার্যক্রম বাড়িয়েছে। এর পেছনে মূল কারণ ছিল চিন ও পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান সাইবার হামলার হুমকি, বিশেষ করে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং সরকারি তথ্যভাণ্ডারের ওপর। ফলে ‘র’ ডিজিটাল নজরদারি, হ্যাকিং প্রতিরোধ এবং সাইবার অস্ত্রের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংগ্রহে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ বাড়িয়েছে।

আরও পড়ুন-বঙ্গবন্ধু-জিয়াউর রহমানের রক্তাক্ত লাশ, খুনির বিবরণে লেখা কথা ও RAW কর্তার সতর্কতা

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর ‘র’-এর সাইবার ইউনিট পাকিস্তান-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ট্র্যাক করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা প্রথাগত তৃণমূল স্তরের গোয়েন্দা কার্যক্রমের পাশাপাশি ডেটা বিশ্লেষণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এছাড়া, ২০১৪ সালের পর ভারতের ‘লুক ইস্ট’ এবং ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতির প্রেক্ষিতে ‘র’-এর কার্যক্রম দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরও সক্রিয় হয়েছে। আফগানিস্তানে তালিবানের পুনরুত্থান (২০২১) এবং মায়ানমারে রোহিঙ্গা সংকটের প্রেক্ষিতে ‘র’ এই অঞ্চলগুলোতে গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছে, এবং বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলায় গোপন তৎপরতা বাড়িয়েছে। আগে যেখানে ‘র’-এর মূল ফোকাস ছিল পাকিস্তান ও চিনের ওপর, এখন এটি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে ব্রডার জিওপলিটিক্যাল গোয়েন্দায় মনোযোগ দিচ্ছে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে; ২০১৯ সালে স্যমন্ত কুমার গোয়েল ‘র’-এর প্রধান হন, যিনি পাঞ্জাবে সন্ত্রাস দমন এবং বালাকোট হামলার পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ২০২৩ সালে রবি সিনহা দায়িত্ব নেন, যিনি প্রযুক্তি-ভিত্তিক গোয়েন্দায় অভিজ্ঞ। এই নতুন নেতৃত্বের অধীনে ‘র’ আরও আক্রমণাত্মক এবং প্রতিক্রিয়াশীল কৌশল গ্রহণ করেছে, যেমন ২০২৩ সালে কানাডায় শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যার সঙ্গে ‘র’-এর সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে, যা এর আগের তুলনায় সাহসী পদক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়।

Pannun Air India

গুরপতবন্ত সিং পান্নুন

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলাতেও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়; পাকিস্তান-ভিত্তিক গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি ISIS-এর মতো বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, এবং ‘র’ এখন শুধু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে নয়, প্রতিরোধমূলক অভিযানেও অংশ নিচ্ছে, যেমন ২০১৯ সালের বালাকোট হামলায় এর ভূমিকা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও বেড়েছে; ‘র’ যুক্তরাষ্ট্রের CIA, ইজরায়েলের Mossad এবং ব্রিটেনের MI6-এর সঙ্গে তথ্য বিনিময় ও যৌথ অভিযানে সক্রিয় হয়েছে, যেমন ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থানের পর পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি ‘র’-কে আঞ্চলিক পর্যায় থেকে বৈশ্বিক গোয়েন্দা মঞ্চে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে, ২০১৪ সালের পর ‘র’-এর কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে প্রযুক্তির ব্যবহার, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোকাস বৃদ্ধি, নেতৃত্বের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আক্রমণাত্মক কৌশলের মাধ্যমে। এই পরিবর্তনগুলো ‘র’-কে আধুনিক যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আরও সক্ষম করেছে। তবে, এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে বিতর্কও বেড়েছে, যেমন পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিযোগ, যা ‘র’-এর ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ -এর ‘র’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ আন্তর্জাতিক স্তরে ‘র’-এর ভাবমূর্তি এবং ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে নানা বৌদ্ধিক পর্যালোচনা চলছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে। অনেকেই মনে করছেন, আন্তর্জাতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের CIA, ইজরায়েলের Mossad-এর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারত-আমেরিকা সম্পর্ককে শক্তিশালী করেছে। তবে, ইউএসসিআইআরএফ-এর সুপারিশ এই ইতিবাচক ভাবমূর্তিতে ছায়া ফেলতে পারে। শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যার সঙ্গে ‘র’-এর কথিত যোগসূত্র এবং আমেরিকায় একটি হত্যা পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিকাশ যাদবের বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযোগ এই সুপারিশের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি ‘র’-কে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিতর্কিত সংস্থা হিসেবে চিত্রিত করতে পারে, যা এর গোপনীয়তা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। আন্তর্জাতিক স্তরে ‘র’-এর ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব পড়তে পারে একাধিকভাবে।

আরও পড়ুন- সত্যিই ভারতের গোয়েন্দা জড়িত মার্কিন দেশের খালিস্তানি হত্যার ষড়যন্ত্রে?

প্রথমত, এই সুপারিশ ‘র’-এর কার্যক্রমকে আগ্রাসী এবং আইনের ঊর্ধ্বে হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে, যা পশ্চিমি দেশগুলোর সঙ্গে এর সহযোগিতায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, CIA বা MI6-এর সঙ্গে তথ্য বিনিময়ে অনাস্থা তৈরি হতে পারে, কারণ এই অভিযোগগুলো ‘র’-এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ উত্থাপন করে।

দ্বিতীয়ত, প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, এই সুপারিশকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নৈতিক নেতৃত্বকে দুর্বল করতে পারে।

তৃতীয়ত, এটি ‘র’-এর অভ্যন্তরীণ মনোবল এবং আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা নেটওয়ার্কে প্রভাব কমাতে পারে, কারণ এর কর্মকর্তারা নিষেধাজ্ঞার ভয়ে সাহসি পদক্ষেপে সংকোচ বোধ করতে পারেন।

তবে, এই প্রভাব সীমিত থাকতে পারে, কারণ ইউএসসিআইআরএফ-এর সুপারিশ বাধ্যতামূলক নয় এবং মার্কিন সরকার এটি গ্রহণ করবে না বলেই সম্ভাবনা বেশি, বিশেষ করে ভারতকে চিনের বিরুদ্ধে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে। ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই সুপারিশ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। স্বল্পমেয়াদে, এটি দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত ইতিমধ্যে ইউএসসিআইআরএফ-এর প্রতিবেদনকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ ও ‘প্রত্যাখ্যানযোগ্য’ বলে সমালোচনা করেছে, যা দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসে ফাটল ধরাতে পারে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে, যেমন বালাকোট হামলার পরিকল্পনায় ‘র’-এর ভূমিকা এবং আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থানের পর পশ্চিমি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বৃদ্ধি। কিন্তু এই অভিযোগ সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের নীরবতা বা সমর্থন ভারতের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি মার্কিন কংগ্রেস বা বিচার বিভাগ এই সুপারিশের পক্ষে সোচ্চার হয়, তবে ভারত এটিকে আমেরিকার ‘দ্বিমুখী নীতি’ হিসেবে দেখতে পারে, যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি করবে। দীর্ঘমেয়াদে, এই ঘটনা ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের কৌশলগত গভীরতাকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারত চিনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমেরিকা যদি ‘র’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে এটি ভারতের গোয়েন্দা সক্ষমতাকে দুর্বল করতে পারে, যা চিনের বিরুদ্ধে যৌথ কৌশলের ক্ষতি করবে। তবে, বিশ্লেষকদের মতে, আমেরিকা এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে না, কারণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কৌশলগত গুরুত্ব মানবাধিকার বা ধর্মীয় স্বাধীনতার অভিযোগের চেয়ে বেশি। অতীতে, যেমন ২০২২ সালে রাশিয়ার অত্যাধুনিক মোবাইল সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল 'এস-৪০০' ক্রয়ে ভারতের বিরুদ্ধে CAATSA নিষেধাজ্ঞা (যে কোনও দেশ বা সংস্থা যদি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা বা গোয়েন্দা খাতের সঙ্গে 'গুরুত্বপূর্ণ লেনদেন' করে, তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে) এড়ানোর ক্ষেত্রে আমেরিকা ছাড় দিয়েছে, যা এই সম্ভাবনাকে সমর্থন করে। তবুও, এই সুপারিশ ভারতকে তার গোয়েন্দা কার্যক্রমে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে বাধ্য করতে পারে, যা আমেরিকার সঙ্গে তথ্য বিনিময়ে সীমাবদ্ধতা আনতে পারে। এই সুপারিশের প্রেক্ষিতে ভারতের প্রতিক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত যদি এটিকে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখে এবং কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে, তবে সম্পর্কের ক্ষতি সীমিত থাকতে পারে। কিন্তু যদি ভারত একে আন্তর্জাতিক চাপ হিসেবে গ্রহণ করে এবং প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ করে, যেমন আমেরিকার সঙ্গে গোয়েন্দা সহযোগিতা কমানো, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। উপসংহারে, USCIRF-এর সুপারিশ ‘র’-এর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে সাময়িকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেললেও, ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের কৌশলগত গভীরতা এবং পারস্পরিক স্বার্থ এই প্রভাবকে সীমিত রাখতে পারে। তবে, এটি ভারতকে তার গোয়েন্দা কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনে আরও সচেতন হতে বাধ্য করবে। 

More Articles