বিশু পাগলের চরিত্রে কাজী নজরুল! যে ‘রক্তকরবী’-র খোঁজ জানেন না অনেকেই

Kazi Nazrul Islam in Raktakarabi : নন্দিনী যদিও বা হলো, এবার খোঁজ চলল বিশু পাগলের। শিশিরকুমারের একমাত্র পছন্দের নাম ছিল- কাজী নজরুল ইসলাম।

বাংলা নাটকের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ যেমন এক অমূল্য সম্পদ, তেমনই আকর্ষণীয় এই নাটক প্রযোজনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য গল্প। সাল ১৯৫৪। শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় ও ‘বহুরূপী’-র প্রযোজনায় ‘রক্তকরবী’-র অভিনয় কালজয়ী মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু তার প্রায় ত্রিশ বছর আগে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়িকে ‘রক্তকরবী’ অভিনয় করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এবং সেই নাটকে বিশু পাগলের চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল খোদ কাজী নজরুল ইসলামের।

‘রক্তকরবী’ নাটকটি ১৯২৪ সালে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই বছরই শিশির ভাদুড়ি ‘সীতা’ নাটকের অভিনয় করে বাংলার নাট্যপ্রেমী দর্শককে মুগ্ধ করে দেন। রবীন্দ্রনাথ ‘সীতা’-য় শিশিরকুমারের অভিনয় দেখে একেবারে মুগ্ধ! অভিনয় ও মঞ্চকলার উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন রবিঠাকুর। শিশিরকুমার তো নিজেও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। ফলে আগে থেকেই দু'জনের যোগাযোগ ছিল। ‘সীতা’-র সাফল্যের পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের বেশ কিছু নাটকের প্রযোজনার দায়িত্ব শিশিরকুমারের হাতেই দেন। এই নাটকগুলির মধ্যেই অন্যতম ছিল ‘রক্তকরবী’। ১৯২৪-এর সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ আমেরিকা যাওয়ার আগেই তিনি শিশিরকুমারকে নাটকটি পড়ে শোনান। তিনি বিদেশ থেকে ফেরার আগেই এই নাটকের প্রযোজনা যাতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে থাকে খুব চেয়েছিলেন রবি।

আরও পড়ুন- নজরুলের নিজস্ব গ্রামোফোন বেজে চলে আজও…

তবে সব ইচ্ছারা আলো দেখে না! দু'পক্ষের যথেষ্ট আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সে নাটক শেষ পর্যন্ত অভিনয় হয়নি। তার অনেক ক'টা কারণ ছিল অবশ্য। সেই সব কারণের মধ্যে কয়েকটা নিয়ে কথা বলা যাক। ‘রক্তকরবী’ সম্বন্ধে একটি প্রচলিত ধারণা এখনও আছে যে এ নাটক ‘দুর্বোধ্য’। ‘রক্তকরবী’ নয়— শক্তকরবী। ফলে ওই সময়ের পাবলিক থিয়েটারের আমজনতা রবীন্দ্রনাথের ‘দুর্বোধ্য’ নাটক কতটা বুঝতে পারবে, সেটা একটা প্রশ্ন তো বটেই। সে নাহয় দর্শকদের বোধের উপর আস্থা রাখাও গেল। রয়েছে কাস্টিং! কারা কোন চরিত্রে অভিনয় করবেন? নন্দিনীর মতো চরিত্রে অভিনয় কে করবেন? পুরনো দিনের অভিনয় পদ্ধতি দিয়ে যে এই চরিত্রটিকে ধরা যাবে না, তা শিশিরকুমার ঠিকই বুঝেছিলেন। তাঁর পছন্দ ছিল কঙ্কাবতী সাহুকে। কঙ্কাবতী ছিলেন বাংলা থিয়েটারের প্রথম গ্র্যাজুয়েট অভিনেত্রী। কিন্তু তিনিও তখন অন্য থিয়েটার দলের চুক্তি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমায় জেরবার। শিশিরকুমার প্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। একটা সময় তো এমনও ঠিক হলো যে নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করবেন শিশিরকুমারের ভাই বিশ্বনাথ ভাদুড়ি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নাকি তাতে মত দিয়েছিলেন।

নন্দিনী যদিও বা হলো, এবার খোঁজ চলল বিশু পাগলের। শিশিরকুমারের একমাত্র পছন্দের নাম ছিল- কাজী নজরুল ইসলাম। ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙ্গার গান’ দিয়ে নজরুল তখন বাংলা কবিতার বন্ধ দরজার তালাগুলো ভাঙতে শুরু করে দিয়েছেন। নজরুল গান জানেন, আবৃত্তি জানেন, তার সঙ্গে আছে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ ইমেজ। শিশিরকুমারের নিজের ভাষায়,

“কাজী তখন আমার খুব ন্যাওটা ছিল। বয়সটা আর একটু বেশি হলে ভালো হত, তবে শেখালে ও পারত, ওর মধ্যে অভিনেতা ছিল।”

আরও পড়ুন- যৌন জটিলতাও হয়ে উঠেছিল স্নিগ্ধ! নজরুলের যে গল্পের হদিশ আজও জানেন না পাঠক

ঠিকই ভেবেছিলেন তিনি। গান দিয়ে যক্ষপুরীর দ্বার খুলিয়ে ‘দুখজাগানিয়া’-র ঘুম ভাঙানোর মতো উদাত্ত মাটির সুর মেশানো গানের কণ্ঠ আর কারই বা ছিল? প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে নজরুল, কাজ করেছেন রুটির দোকানে, প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধে গেছেন। আবার ফিরে এসে বাংলা কবিতায়-সমাজে-ধর্মে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। এ মানুষ তো বিশু পাগলের মতোই জেল ভেঙে বেরোবে। বিশু ছিল রঞ্জনের অন্য পিঠ, যে পিঠে আলো পড়ে না। একটু ভেবে দেখলেই মনে হয় নজরুলও ঠিক তাই, হাজার রকম গানের ডালি নিয়েও রবির আলোর ছায়ায় তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। শুধু প্রতিভা বা জনপ্রিয়তার বিষয় নয়, ভিতর থেকে উঠে আসা একটা প্রবল বিশ্বাসও এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। নজরুল নিজেও তো বলেছেন, “মাথার উপর জ্বলিছেন রবি”। শিশিরকুমার হয়তো তাঁকে অভিনয়টুকু শিখিয়ে দিতেন, কিন্ত ভিতরের বিশু পাগলটা তো তাঁর নিজের। বাংলা থিয়েটারের দুর্ভাগ্য যে ‘রক্তকরবী’-তে শুধু নজরুলের অভিনয় প্রতিভা নয়, এই জীবনদর্শনের স্বাদ পাওয়া থেকে পর্যন্ত সে বঞ্চিত হলো।

 


তথ্যঋণ- ‘বাংলা থিয়েটার ও নাট্যাচার্য শিশিরকুমার’- অনিল মুখোপাধ্যায় (সম্পাদনা- মলয় রক্ষিত)

More Articles