নজরুলের নিজস্ব গ্রামোফোন বেজে চলে আজও...

Kazi Nazrul Islam Songs: হারুবাবুকে কানন দেবী চিঠি লিখছেন, "…যে কাজ করার কথা ছিল সরকারের অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে কাজ আপনি করেছেন।"

প্রতিদিনের নানা টানাপোড়েন, ব্যস্ততা আর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে করতে কোথাও যেন সুস্থ অখণ্ড অবসর থেকে আমরা বঞ্চিত। ছেলেবেলার গল্পশোনার দিনগুলো, তুলসীতলায় প্রদীপজ্বালা, ছুটির দিনে বা শরীর খারাপের জন্য স্কুল যেতে না পারায় দুপুরবেলার গণিতচর্চা, ভোরের আধ-ঘুমে ভেসে আসা রেডিওর সেই পরিচিত সুর আরও কত কী! মনে আসে সেই এক ঘুরন্ত চাকতি, যেটা চলতে শুরু করলে পরিবারের সকলে ঘিরে বসতেন সেই যন্ত্রকে। যা এখনও ততখানিই নস্টালজিক। আমাদের মতো ছোটদের আবার উৎসাহ বেশি ছিল হাতল ধরে দম দেবার জন্য। দম দেওয়া শেষ হলেই আবার একটা চাকতি চাপতো, শুরু হতো গান আর সবাই দম ছেড়ে বাঁচত। হয়তো বাজাতে চাইলাম হেমন্তর ‘সূর্য ডোবার পালা’ কিন্তু ওই লাইনটা বারে বারে বেজেই চলেছে। কী করব, কাটা রেকর্ড যে! দাদু পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে বলে উঠতেন ‘ওরে সূর্যকে ডোবা’। ছোট্ট হাতে দুম করে থাপ্পড় মারলাম যন্ত্রের গায়ে, ব্যস চলতে থাকল ‘আসে যদি আসুক বেশ তো…’। ঠিকই ধরেছেন — কলের গান, গ্রামোফোন রেকর্ড। নব্বই দশকের শুরুতেই যা ধীরে ধীরে লোকচক্ষু থেকে দূরে সরে যেতে থাকে খানিকটা অভিমানেই। কারণ ততদিনে ক্যাসেট প্লেয়ার, ক্যাসেট রেকর্ডার ছেয়ে গেছে। ১৯৯৫-এ তো বিপিএল-এর ডাব্‌ল্‌ডেক বহু পরিবারের অন্দর মহলে ঠাঁই পেয়ে গেছে। নতুন ক্যাসেট না কিনে ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট কিনে রেকর্ড টিপে দিলেই হবে। না, আওয়াজ বাড়ানোর কোনও দরকার নেই। গোপন অভিসারেই প্রতিলিপি তৈরি হয়ে গেল। তারপর আসল ক্যাসেট চলে যেত তার মালিকের কাছে। মনে পড়ে, পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠছিল ‘কপি করা’ ক্যাসেটের বিপণন। এই কপি করার ব্যবসা রেকর্ড প্লেয়ারের যুগেও হতো। রাসবিহারী, ধর্মতলা, ভবানীপুর, বহুবাজার, শিয়ালদার অনেক দোকানে নানা রেকর্ডের পছন্দের গান বলে দিলে সেই গান বাজিয়ে ন্যাশনাল প্যানাসনিকের যন্ত্রে তুলে নেওয়া হত। এইরকম আসল নকলের দ্বিধারায় চলত সঙ্গীতের সঙ্গে ভালোবাসা।

মামাবাড়িতে ছিল Phillips-এর একখানি Fiesta আর কিছু লং-প্লেয়িং রেকর্ড আর প্রতিমাদিদার কাছে মানে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে কলের গান — একটা চোঙাওয়ালা গ্রামোফোন যন্ত্র। গরমের আর পুজোর ছুটিতে কলকাতায় এলেই দিদার কাছে গিয়ে গান শোনা, লুচি আলুর তরকারি আর এই রেকর্ড শোনা চাইই চাই। বোনাস থাকত — মান্না দে, নির্মলা মিশ্র, আরতি মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্তকে সামনাসামনি দেখা আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে আসা দু'টি টফি। ক্রমে যতই বড় হতে শুরু করলাম এই ‘দমঘোরানো কলের-গানে’র প্রতি উৎসাহ বাড়তে থাকল। রেকর্ড বাজানোর যন্ত্র তো ছিল না অগত্যা জোগাড় করতে লাগলাম প্রচুর ক্যাসেট। বেশিরভাগই রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বিজেন্দ্রগীতি, দেবব্রত বিশ্বাস, দিলীপকুমার রায়, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ভর্তি হলাম শান্তিনিকেতনে — বিশ্বভারতীর সঙ্গীতভবনে শুধুমাত্র গানের টানে। যেন স্বর্গ পেলাম হাতে। শুধু গান আর গান! কত রেকর্ড দেখার, শোনার সৌভাগ্য হলো। অতৃপ্ত বাসনা যে মনের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছিল আজ বুঝতে পারি। সংগ্রাহক হিসেবে একেবারেই নয়, পুরনো দিনগুলো ফিরে পাওয়ার জন্য। না-দেখা গানের জগৎকে অনুভব করে বাঁচার জন্য। সঙ্গীতভবনে কি স্বস্তিকাদির বাড়িতে রেকর্ড গোছানো হলে সেগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম। মনে হতো জীবন পবিত্র হয় বুঝি এদেরই স্পর্শে। তবে হ্যাঁ, নতুনের থেকে পুরনো বই কেনাটাও ছিল স্বভাবের মধ্যে। শতবর্ষ প্রাচীন অনেক বই আজও আমার সংগ্রহে আছে।

আরও পড়ুন- নজরুলের পত্রিকায় সেদিন লেখেননি রবীন্দ্রনাথ

২০১৩ সালে রবীন্দ্রসঙ্গীত গবেষণাকেন্দ্রে অধ্যাপক অরুণকুমার বসুর (যিনি গীতিকার ভাস্কর বসু) সহকারী গবেষক হিসেবে যুক্ত হলাম। বই কেনার পাগলামো আরও উঠল বেড়ে। আমার আর স্যারের উদ্যোগে সুভাষদার (সুভাষ চৌধুরী) প্রায় হাজার দুই বই সংগ্রহ করে গবেষণাকেন্দ্রে নিয়ে আসা গেল। তৈরি করতে লাগলাম গ্রন্থাগার। ইচ্ছে ছিল গ্রামোফোন লাইব্রেরি তৈরি করব, কিন্তু সে আর হলো না। প্রায় সাত বছর পরে সহযোগী গবেষক ও আধিকারিক হিসেবে যুক্ত হলাম আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও পেলাম এক শিশু গবেষণাকেন্দ্র। আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল সেই রেকর্ড সংগ্রহের খ্যাপামো। তবে দৃষ্টিভঙ্গি সর্বৈব আলাদা। নজরুলের গানগুলিকে একজায়গায় রাখা, ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার জন্য নানা বিষয় সম্বন্ধীয় রেকর্ড সংগ্রহ করা। বিজ্ঞাপন ছাপানো হলো, ‘যা কিছু নজরুল’ নাম দিয়ে। কিছু পরিচিতদের সাহস করে পাঠালাম যদি তারা সাহায্য করেন। কাউকে পেলাম না। একজন প্রবীণ সংগ্রাহক লিখলেন "এ সব নিয়ে আমি আর ভাবি না। এ যুগে এসবের কোনও দাম নেই, সব জঞ্জাল।" লোকমুখে শুনলাম রেকর্ড কোম্পানিকে টাকার বিনিময়ে গান বিক্রি করা হচ্ছে আবার তা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়াও হচ্ছে। যাঁকে দেখে আমার খুব শ্রদ্ধা হতো, দেখলাম তিনি যোগাযোগই রাখলেন না। কিছুজন বললেন "তোর যত পাগলামি। যে জিনিস কেউ শোনেনা তাই নিয়ে কেন মাথা ঘামাচ্ছিস?" উত্তর কলকাতায় আরেক প্রবীণ সংগ্রাহকের দ্বারস্থ হলাম। যদিও তিনি তখন গত হয়েছেন। তাঁর পরিবারকে বললাম, কথা বাকি থাকতেই প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। কথা শুনে মনে হলো, ওই ভদ্রলোকের এই যে রেকর্ড সংগ্রহের নেশা তাই-ই যেন তাদের পরিবারকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সংসারে থেকেও তিনি যেন সংসারের কেউ নন। তাই রেকর্ড শব্দ শুনলেই তাদের এই অবস্থা হয়। যাই হোক, শত অপমান সয়ে ফিরে এলাম। ভাবলাম, আমার বোধহয় ঠিক মতো বলা হয়নি কী আমার গবেষণাকেন্দ্রের উদ্দেশ্য। তাই সাহস সঞ্চয় করে পরেরদিন সকালে আবার গেলাম মনের দুঃখ আর চোখের জলটুকু চেপে রেখে। বাড়ির সিঁড়ি পর্যন্তও যেতে হল না। মা-হারা সন্তানের মতো প্রায় কেঁদেই ফেললাম। দেখলাম, বাড়ির নর্দমায় সব রেকর্ড ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছে। ঝাপসা চোখে একটা রেকর্ড দেখলাম পড়ে আছে রবীন্দ্রনাথের "তবু মনে রেখো"। হায় রে, অতীত! কে মনে রাখবে আর কীই বা মনে রাখবে? যার কদর ভুবনময় তাঁর স্থান আজ নর্দমায়। বিশ্বাস করুন, ছুটে পালিয়ে গেছিলাম।

এতদিন ধরে সেই দুঃখ বুকে রেখেছি। রোখ চেপে গেল, গবেষণাকেন্দ্রে গ্রামোফোন আর্কাইভ গড়ে তুলব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, অসংখ্য গবেষকদের জন্য, ছাত্রছাত্রীদের জন্য। অন্তত চেষ্টা তো করি! চিন্তা একটাই, কীভাবে? সময়টা ২০২১-এর মার্চ মাস। চারদিকে ঘোর করোনার দাপট। এক ভদ্রলোক ফোন করে ভাঙা-ভাঙা গলায় বললেন "আমি অমিত গুহ বলছি"। একথা সে-কথার পর জানলাম রবীন্দ্রভারতী অধ্যাপিকা নূপুর গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে আমাদের নম্বর পেয়ে যোগাযোগ করতে আগ্রহী হয়েছেন। তাঁর সংগ্রহে আছে কাজী নজরুল ইসলামের একটি গানের খাতা। শুনেই চমকে ওঠার পালা। স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞাসা করতে হলো এই খাতা ওঁর কাছে এল কীভাবে। বললেন "আমি সুরাজলাল মুখোপাধ্যায়ের জামাই"। সুরাজলাল মুখোপাধ্যায় — হারুবাবু !! কলকাতার সর্ববৃহৎ রেকর্ড সংগ্রাহক! পেপারে পড়েছিলাম (তখন আমি স্কুলে পড়ি) এমনকি ছবিও দেখেছি, স্টেটসম্যানে বেরিয়েছিল — প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার রেকর্ড। নানা কথোপকথনের পর আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর সংগ্রহশালায় আসার জন্য। কথা শেষ হতেই আমার ডিরেক্টর স্বাতীদিকে (ড. স্বাতী গুহ) ফোনে জানালাম। দুপুরের খাওয়া তখন মাথায় উঠেছে। বুঝতে পারছি বুক কাঁপছে কিন্তু ভাবনা দুটো। নতুন করে পাওয়ার, না আবার পুরনো সেই অবমাননার বিষ। অবশেষে ১ এপ্রিল, ২০২১ গেলাম সুরাজ শ্রুতিসদনে। ঘরে ঢোকার আগেই একটা টিনের চালের কারখানা। চারদিকে জঞ্জাল, গ্রামোফোনের পার্টস পড়ে আছে, দেখে কেমন যেন লাগল। যেই দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলাম, চোখ টেরিয়ে গেল। কী সর্বনাশ! তাক, আলমারি, টেবিল, চেয়ার, খাট, মেঝে যেদিকে তাকাই শুধু রেকর্ড আর রেকর্ড! দেওয়াল পর্যন্ত দেখা যায় না! শুধু মনে হল ‘আপন প্রাণের ধন’। কাজ শুরু করলাম, প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম চারদিন ধরে। বেছে রাখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর কাজে কোন কোন রেকর্ড আনতে হবে। হাতে নিয়ে দেখলাম সেই গানের খাতাটি। এখন লিখতে গিয়েও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। সেকালের এক বিখ্যাত রেকর্ড সঙ্গীতের গায়িকার নিজের নাম লেখা খাতার প্রথম পাতায়, সঙ্গে ফোন নম্বর। জীর্ণ পৃষ্ঠা উল্টাতেই যা দেখলাম তারপর চোখ সরে না। সবুজ কালিতে নজরুলের হাতের লেখায় খাতার প্রথম গান ‘আল্‌গা করো গো খোঁপার বাঁধন’।

আরও পড়ুন- যৌন জটিলতাও হয়ে উঠেছিল স্নিগ্ধ! নজরুলের যে গল্পের হদিশ আজও জানেন না পাঠক

একদিন পেলাম হারুবাবুকে লেখা কানন দেবীর একখানি চিঠি। তিনি এক জায়গায় লিখছেন

"…যে কাজ করার কথা ছিল সরকারের অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে কাজ আপনি করেছেন।"

মনে হলো ,এক শিল্পীর মনের কথা, আমি নিজে গানের লোক হয়ে পালন যদি না করি তাহলে কী করে হয়। কলকাতার কাজ সেরে ফিরলাম আসানসোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই চলে গেলাম ডিরেক্টরের ঘরে, বললাম নিজের অভিজ্ঞতা আর ‘মনের বাসনা’। একটা প্রোপোজাল তৈরি করলাম প্রাথমিকভাবে কী কী আমরা সংগ্রহ করব। নানা আলোচনায় ও সরকারি নিয়ম মেনে অনুমতিও পেলাম। মাস তিনেক পরে কিছু জিনিস এল নজরুল আর্কাইভে। সংগ্রহ দেখে সবাই বেশ খুশি বলেই মনে হলো। আমি পাণ্ডুলিপি ছাড়া বিশেষ খুশি হইনি কারণ একটা গ্রামোফোন প্লেয়ার আমার নজর কেড়েছিল। অমিতজেঠু আর জেঠিমার কাছেই জেনেছি এটি নজরুলের ব্যবহৃত গ্রামোফোন কিন্তু পেলেন কোথা থেকে আর জানালেনই বা কে? জানলাম, সত্তর দশকের সময় হারুবাবু এই পাণ্ডুলিপি আর একটা ভাঙাচোরা Double Soundbox-এর স্ট্যান্ড গ্রামোফোন কিনেছিলেন। এটি ১৯২১ সালে manufacture করেছিল ইংল্যান্ডের The Duophone Syndicate Limited (RED No. 413301)। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যন্ত্রের গায়ে His Masters Voice-এর লেবেল ও ডিলার M. L. Shaw-এর লেবেল দু'টিই আছে। অমিতবাবু জানালেন এই যন্ত্র সেকালে খান পঞ্চাশেক তৈরি হয়েছিল কিন্তু বিক্রি বা চাহিদা কোনওটিই সেভাবে ছিল না। এই তথ্য একমাত্র জানতেন ব্রহ্মমোহন ঠাকুর। তিনি অমিতবাবুকে জানিয়েও ছিলেন, বলেছিলেন "জিনিসগুলো সাবধানে রেখো অমিত।" শুনেছি ইতিপূর্বে বহু সংগ্রাহক অমিতবাবুর কাছে এসেছেন এ জিনিস নিয়ে যাবার জন্য, মোটা অর্থের প্রলোভনও তার মধ্যে নাকি ছিল। কিন্তু তাঁর মতে,

"আমার দেশের জিনিস আমি বেসরকারি সংগ্রাহকদের বা বিদেশের কাউকে দেব না। এ আমার দেশের ঐতিহ্য, দেশের সম্পদ, বাংলার ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচিহ্ন, আমার শ্বশুরমশাইয়ের বহু পরিশ্রমের ফসল। এই গান বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে, শিক্ষার্থীরা–গবেষকরা শুদ্ধ মনে আসবে, গবেষণা করবে, তাহলেই বাবার স্বপ্ন সফল হবে বলে আমি মনে করি।"

অমিতবাবু সেই ভাঙা যন্ত্রটি এক প্রবীণ গ্রামোফোন সংস্কারককে দিয়ে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) নতুন করে সারিয়ে তোলেন। তার আওয়াজ এখন কেমন সেটা জানতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শুনতে হবে।

আরও পড়ুন- তিন হাজার গান! কোনও কপিরাইট রাখেননি নজরুল

যাইহোক, ধুমধাম করে নিয়ে আসা হলো সেই প্লেয়ার। আনা হলো একশোটি রেকর্ডনাট্যের বিরাট সম্ভার, নানা শিল্পীর গান – যূথিকা রায়, আব্বাসউদ্দিন আহ্‌মেদ, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পঙ্কজকুমার মল্লিক, আঙুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবী, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য, গিরীণ চক্রবর্তী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এছাড়াও বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে নজরুলের গান, নজরুলের নাটক (অন্যের নাটকে নজরুলের গান-সহ) এমনকী নজরুল-কণ্ঠের রেকর্ড আরও অনেক কিছু। দুষ্প্রাপ্য কিছু বই, ক্যাটালগও বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল আর্কাইভে স্থান পেল। এছাড়াও কয়েকটি রেকর্ড শান্তিনিকেতনে ভোম্বলদার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে পেলাম আর আমার সংগ্রহের প্রায় দুশো টেস্ট রেকর্ডও গবেষণাকেন্দ্রের জন্য দিয়েছি। অনেকে স্বেচ্ছায় কিছু রেকর্ড দেবেন বলেও যোগাযোগ করেছেন, তাদেরকেও আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। ভবিষ্যতে আরও কিছু দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ এখানে শোভা পাবে, যা নিয়ে গবেষণার সুযোগ থাকবে বলে আশা রাখি।

শেষে একটু অম্লমধুর বিষয় সম্পর্কে কিছু না বললেই নয় কারণ, অনেক শুভানুধ্যায়ীর শুভেচ্ছা যেমন আছে, তেমনই আছে কমল-মৃণালের মতো কটু নিন্দা। ফেসবুক থাকায় এধরনের মন্তব্য করা, এই সময়ে দাঁড়িয়ে খুবই সহজ একথা সবাই বুঝি। সংগ্রহ যখন তাদের আছে তবে এতগুলো বছরে একটা গ্রামোফোন লাইব্রেরি কেন গড়ে তোলা যায়নি? আজ তাদের কাছে প্রার্থনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য তারা এগিয়ে আসুন। রেকর্ড সঙ্গীতের আদর্শ গবেষণাগার গড়ে তুলে বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা করুন। মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অকুণ্ঠ সহযোগিতা না থাকলে নজরুল আর্কাইভের এই সংগ্রহের কাজটি হতো না। সে জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

আমি প্রকৃত অর্থে সংগ্রাহক নই তবে নির্ভেজাল গানের মানুষ। গবেষণার নানা কাজের মধ্যে এই সংগ্রহ করাও একটা দায়িত্ব, একটা কর্তব্য। তাই বিশ্বের সঙ্গীতরসিকজনেরা এই তীর্থে এসে বাংলা গানের ভাণ্ডার নিয়ে নিজে হাতে যাতে কাজ করতে পারেন, সেটাই একমাত্র উদ্দেশ্য। আমি খ্যাতি, যশ, নেতৃত্ব কিছুই চাইনি শুধু হারিয়ে যাওয়া শিল্পীদের গান আর যেন না হারায়, তারই চেষ্টা করে চলেছি। সেজন্য গুরুদেবের কথায় বলি – ‘…যে-কেহ মোরে দিয়েছ দুখ… সবারে আমি নমি’।

 

 


লেখক আসানসোলের কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের  নজরুল সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ বিভাগের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট

More Articles