দেবীর গোপন রূপ দেখে অন্ধ হয়েছিল ভক্তরা! কিরীটেশ্বরী সতীপীঠে আজও জীবিত কিংবদন্তি

Satipith Kiriteswari: কিরীটেশ্বরী মহাপীঠ না উপপীঠ, এই নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও কিরীটেশ্বরী হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান, এই বিষয় নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।

মুর্শিদাবাদ নাম শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রাচীন বাংলার নবাবি আমল। তবে শুধু ঐতিহাসিক দিক থেকেই নয়, পৌরাণিক দিক থেকেও এই জেলার গুরুত্ব অসীম। এই জেলাতেই রয়েছে ৫১ সতীপীঠের অন্যতম কিরীটেশ্বরী মন্দির। মুর্শিদাবাদে মন্দিরগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বোধহয় সতীপীঠ দেবী কিরীটেশ্বরীর মন্দির। মুর্শিদাবাদের অপর পাড়ে অর্থাৎ ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে ডাহাপাড়া থেকে দুই কিলোমিটার দূরে মন্দিরটি অবস্থিত। কিরীটেশ্বরীর পূর্বনাম ছিল কিরীটকণা। তান্ত্রিক মতে এবং পীঠনির্ণয় ও পুরাণ-কাহিনি অনুসারে এখানে দেবী দক্ষিয়ণী সতীর কিরীট অর্থাৎ মুকুটের কণা পতিত হয়েছিল। এইজন্য এই স্থানটিকে মহাপীঠ বলে। আবার এখানে দেবীর কোনও অঙ্গ পতিত না হয়ে ভূষণ পতিত হয়েছিল, তাই এই স্থানকে অনেকে তন্ত্রবিদ পূর্ণ পীঠস্থান না বলে উপপীঠও বলে থাকেন। চন্দ্রমতে দেবীর নাম বিমলা, ভৈরব সম্বর্ত। মা কিরীটেশ্বরী এখানে দক্ষিণাকালী ধ্যানে পূজিতা। বাংলার এই মা কালী সকলের। তার কাছে ধর্মের কোনও ভেদাভেদ নেই। তার কাছে সব সন্তান সমান।

শাক্তমতে এই স্থান একটি প্রাচীন মহাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ। পাঠান-মুঘল শাসনকালেও এই স্থানের খ্যাতি ছিল। কিরীটেশ্বরী সতীপীঠে আসলে সতীর কোন অঙ্গ পড়েছে, তা নিয়ে ভিন্নমত আছে। তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থে এটিকে একটি সতীপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মন্দিরের পুরোহিতদের মতে কিরীট হচ্ছে সতীর কপালের ওপরে শিরের নিচের সংযোগস্থল। কিন্তু শিবচরিত গ্রন্থে ‘কিরীট’ অর্থে সতীর মাথার মুকুটের কথা বলা হয়েছে। মুকুট পড়ার কারণে দেবীকে মুকুটেশ্বরী বলেও ডাকা হয়।

ইতিহাস
কিরীটেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে অবশ্য বহু মত প্রচলিত আছে৷ প্রাচীন ইতিহাস অনুসারে এর নাম ছিল কিরীটকণা। তাই কেউ বলেন, এখানে সতীর মুকুটের কণা পড়েছিল, আবার কেউ বলেন ললাট বা কপাল। কিন্তু মন্দিরের সেবাইত দিলীপকুমার ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, ‘কিরীট’ কথাটি এসেছে করোটি বা মাথার খুলি থেকে। আর সেই করোটির টুকরো আছে বলেই নাম হয়েছে কিরীটি আর সেখান থেকে নামকরণ ‘কিরীটেশ্বরী’। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী সময়ে সংস্কারের বিষয়েও নানা তথ্য উঠে এল দিলীপবাবুর কথা থেকে। তিনি জানান, ১১০৪ বঙ্গাব্দে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন নাটোরের রানি ভবানী। পরবর্তী সময়ে মহারাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রাই ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে এই মন্দিরের সংস্কার করেন। তবে দিলীপবাবু জানাচ্ছেন, যোগেন্দ্রনারায়ণ রাইয়ের সময়ের যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে পুনঃসংস্কারের কথা উল্লেখ রয়েছে। সেক্ষেত্রে তার আগে আরও কেউ এই মন্দিরের সংস্কার করেছেন বলেই মনে করা হয়।

ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, বাংলার ইতিহাসের বহু সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই মন্দিরের কিংবদন্তি। বলা হয়, রানি ভবানীর দত্তক পুত্র রাজা রামকৃষ্ণ মায়ের দর্শন লাভের জন্য এখানে পঞ্চমুন্ডির আসন স্থাপন করে সাধনা শুরু করেছিলেন। সাধনা-শেষে মায়ের দর্শন না পেয়ে আকুল রামকৃষ্ণ নিজের প্রাণ দিতে গেলে মা দৈবযোগে বলেন সময় হলে তিনি রামকৃষ্ণকে দেখা দেবেন। এরপর রামকৃষ্ণ বাংলাদেশের নাটোরে গিয়ে কঠোর সাধনা শুরু করেন এবং মায়ের দর্শন লাভ হয়। মা স্বপ্নাদেশে রানি ভবানীকে কিরীটকণা-তে মন্দির স্থাপন করতে আদেশ দেন। রানি ভবানী পঞ্চমুন্ডির আসনের খানিক ওপরে একটি গর্ভ তৈরি করে তার ভিতরে মায়ের শিলামূর্তিটিকে স্থাপন করেন। রাজা রামকৃষ্ণ মুর্শিদাবাদে তাঁর রাজধানী বড়নগর থেকে এখানে আসতেন। মন্দির-প্রাঙ্গনে দু'টি পাথরখণ্ড রাখা আছে, যার ওপর বসে রাজা রামকৃষ্ণ সাধনা করতেন। তারপরে লালগোলার রাজা ভগবান রায়, মুঘল সম্রাট আকবরের থেকে এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৪০৫ সালে দেবীর প্রাচীন মন্দিরটি ভেঙে পড়ে। পরবর্তীকালে উনিশ শতকে ভগবান রায়ের বংশধর দর্পনারায়ণ রায় নতুন মন্দির নির্মাণ করান। রাজা রাজবল্লভ এখানে দু'টি শিবমন্দির তৈরি করেছিলেন।

old temple

পুরনো ভগ্ন মন্দির

তিন ধর্মের স্থাপত্যের মিশেল রয়েছে এই মন্দিরে। এক্ষেত্রে মন্দিরের সেবাইত দিলীপকুমার ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের স্থাপত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় এই মন্দিরে।

গুপ্তমঠের কাহিনি
খোলা প্রান্তরের মধ্যে দূরে দূরে একগুচ্ছ শিব মন্দির নিয়ে দেবীর সাদামাঠা মন্দির। বর্তমানে রং করার ফলে চাকচিক্য ফিরেছে। মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। অন্যান্য পীঠস্থানের মতোই দেবীর চিহ্নস্বরূপ প্রস্তরীভূত অংশ সাধারণের অগোচরে থাকে। পীঠের মাহাত্ম্য বর্ণনায় বলা হয়েছে, এই পবিত্র বস্তু দেখা বারণ, কেউ যদি দেখতে চায়, তাহলে তার বিভিন্ন ক্ষতি হয়। বহু সন্ন্যাসী এই স্থানের মাহাত্ম্যর জন্য এখানে ছুটে আসতেন অতীতে। একসময় মন্দিরটি জঙ্গলে আবৃত হয়ে পড়ে ছিল। পরিষ্কারের পর মূল মন্দিরের ভিত্তি, ধ্বংসাবশেষ, সাধক রামকৃষ্ণ রায়ের সাধনপীঠের প্রস্তরাসন সামনে আসে। এই পীঠস্থান যে সাধকের আরাধনায় জাগ্রত হয়ে উঠেছিল, সেই সাধক হলেন রানি ভবানীর দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণ রায়। সেই রামকৃষ্ণের সাধনাস্থান, পঞ্চমুন্ডির আসন এখনও এই পীঠে রাখা আছে।

অতীতের সেই ভগ্ন মন্দিরটি ছিল দক্ষিণদুয়ারী। বর্তমানের পশ্চিমমুখী মন্দিরটি মুর্শিদকুলি খাঁ-র প্রধান কানুনগো দর্পনারায়ণ রায় ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করে দেন। কালীসাগর নামে একটি দিঘিও কাটান মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। এখনও ঘাটের বাঁধানো সিঁড়িগুলির কয়েকটি দেখা যায়। মুর্শিদাবাদ সদ্য তখন বাংলায় রাজধানীর তকমা পেয়েছে। শহরের গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পবিত্র পীঠস্থানের গুরুত্বও বৃদ্ধি পায় মানুষের কাছে। এখানে এলে প্রাচীন ও নতুন- দুই মন্দিরই চোখে পড়ে। প্রাচীন বা আদি মন্দির বলে যেটি কথিত, তাতে ছোট বেদির ওপর দেবীর মুখ অঙ্কিত আছে। দুই মন্দিরেই পূজা নিবেদিত হয়। কিরীটেশ্বরী গ্রামটিতে প্রচুর মন্দির রয়েছে। গ্রামের উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে এক দালান-মন্দির, যা গুপ্তমঠ নামে পরিচিত। কথিত আছে, এখানে নাকি দেবীর কিরীট রাখা আছে। মন্দিরটি রানি ভবানী কর্তৃক নির্মিত। কিরীটেশ্বরী মন্দির থেকে এই গুপ্তমঠ যাবার পথটি গ্রামের মধ্য দিয়ে।

গুপ্তমঠ
গুপ্তমঠ দেবী মন্দিরের কাছেই অবস্থিত। প্রসঙ্গত, দেবীর প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও নবনির্মিত মন্দিরের সামনে অবস্থান করছে। জনশ্রুতি রয়েছে, বর্তমানে যে স্থানে গুপ্তমঠ রয়েছে, প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে ওই স্থানে ১৭২ ঘর পান্ডা এবং অন্যান্য জাতি-উপজাতির বসবাস ছিল। প্রায় ৩০০ বছর আগে আফগান আক্রমণের আশঙ্কায় পান্ডারা মূল পশ্চিমমুখী মন্দির থেকে দেবীকে বর্তমান গুপ্তমঠে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নিয়ে আসার সময় পান্ডারা মায়ের রুপ দেখার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে সহমত হয়। প্রথমে জনাকয়েক পাণ্ডা মায়ের রূপ দেখেন। মায়ের রূপ দেখামাত্রই মায়ের রূপদর্শনকারী পান্ডারা অন্ধ হয়ে যান। এই ঘটনার পরেই অন্যান্য পান্ডারা মায়ের রুপ দর্শনে বিরত থাকেন। কিন্তু মায়ের রোষানলে পড়ে ১৭২ ঘর পান্ডা পরিবার বিনাশ হয়ে যায়।

দেবীমূর্তির বৈশিষ্ট্য
মন্দিরে দেবীর কোনও মূর্তি নেই। এমনকী, কোনও ছবিও এখানে পূজিত হয় না। শিলামূর্তিকেই দেবী-রূপে পুজো করা হয়। এই শিলাটির রঙ লাল এবং শিলাটি একটি আবরণে ঢাকা থাকে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে এই আবরণটি পরিবর্তন করা হয়। বলা হয়, সতীর কিরীটটি এই মন্দিরের কাছেই রানি ভবানীর গুপ্তমঠে রাখা আছে। প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। অনেকের মতে, এখানে দেবীর ভৈরবরূপে যে মূর্তি পূজিত হয়, সেটি একটি প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি। এই মূর্তিটি 'ধ্যান বুদ্ধমূর্তি' নামে পরিচিত।

Deity

দেবীর শিলামূর্তি

ভোগ এবং বলিপ্রথা
গুপ্তমঠে প্রতিদিন সকালে দেবীর নিত্যপুজো হয়। দুপুরে ভাজা, তরকারী ও মৎস্য সহযোগে অন্নভোগ হয়। মন্দিরের পুরোহিত নেপাল ভট্টাচার্য বলেন, ৩৬৫ দিন দেবীর অন্নভোগে মাছ দিতে হয়। মাছ ছাড়া দেবীর ভোগ হয় না। দেবীর ভোগের মাছ ভক্তরা যোগান দেয়। প্রতিদিন কেউ না কেউ ভোগের আগে মন্দিরে মাছ দিয়ে যায়।

কালীপুজোর দিন সারারাত ধরে মায়ের পুজো হয়। পুজো শেষে ছাগ বলি দেওয়া হয় এখানে। এছাড়াও দূর্গা পুজোর অষ্টমীর পুণ্য তিথিতে গুপ্তমঠে মায়ের মহাপুজো হয়। মহাপুজো উপলক্ষ্যে মন্দিরকে রং করার পাশাপাশি আলো দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়। ওইদিন বহু মানুষ মানতের পুজো দিতে আসেন। মহাপুজোর দিন সকালে প্রথমে মায়ের মহাস্নান হয়। এরপরে দিনভর চলে যাগযজ্ঞ। যজ্ঞ শেষে মানতের ছাগ বলিদান দেওয়া হয়। মহাপুজো দেখতে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয় গুপ্তমঠ প্রাঙ্গনে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব
দেবী মন্দির যে জাগ্রত সেই নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত। কথিত আছে, পলাশীর যুদ্ধের পর যখন বাঙলার ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র মীরজাফর, নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁর সঙ্গী রাজা রাজবল্লভকে নির্মম ভাবে হত্যা করেন। সেই দিন এই মন্দিরের একটি শিবলিঙ্গ নাকি নিজে থেকেই ফেটে গিয়েছিল।

আবার আরেক কাহিনি অনুসারে, মিরজাফর শেষ বয়সে কঠিন কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হন। সেই সময় অনুশোচনা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে। ওই সময় তিনি দেবীর চরণামৃত পান করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল ওটা পান করলেই তিনি কুষ্ঠ রোগমুক্ত হবেন। দেবীর চরণামৃত যখন তাঁর কাছে আনা হয়, তখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। ওই চরণামৃত মুখে দেওয়ার পরই নাকি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন একসময়ের বিতর্কিত মিরজাফর। এইসব কাহিনির সত্য-মিথ্যা নিরূপণ এখানে সম্ভব নয়। তবে এ-থেকে এটুকু বোঝাই যায়, দেবী কিরীটেশ্বরীকে বাংলার হিন্দু মুসলমান তাদের নিজেদের অংশ বলেই ভেবেছে।

কিরীটেশ্বরী মহাপীঠ না উপপীঠ, এই নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও কিরীটেশ্বরী হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান, এই বিষয় নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। পাশের জেলা বীরভূমের তারাপীঠে তারা মায়ের দর্শনে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। কিন্তু সঠিক প্রচারের অভাবে কিরীটেশ্বরীতে সেইভাবে লোকের সমাগম হয় না।

More Articles