"এই ছেলেকে দিয়ে আমি গান গাওয়াব," বাথরুমে কিশোরের গলা শুনে বলেছিলেন শচীন কত্তা!
Kishore Kumar: ইন্ডাস্ট্রিতে একুশ বছর কেটে যাবার পরেও কিশোরকে সিরিয়াসলি নিচ্ছিলেন না সুরকাররা।
ষাটের দশকের শেষের দিকে হতাশ, ডিপ্রেসড কিশোর কুমার ঠিক করলেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে গাঁয়ের বাড়ি খান্ডোয়া চলে যাবেন। বম্বেতে তাঁর জন্য আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই। খুব একটা ভুল কথা না। আসলে একই সঙ্গে সেই সময় স্ট্রাগল করছিলেন দুই কিশোর কুমার। একজন কমেডিয়ান, অন্যজন গান করেন। তাও হালকা চালের, মজার গান। গভীর কিছু না। সেরা গানগুলো জোটে মহম্মদ রফির ভাগ্যে। অভিনয়েও তিনি নায়ক না। বড়জোর সেকেন্ড লিড। ইন্ডাস্ট্রিতে একুশ বছর কেটে যাবার পরেও কিশোরকে সিরিয়াসলি নিচ্ছিলেন না সুরকাররা। অন্যদিকে কমেডিয়ান কিশোর ক্রমাগত গ্রাস করে নিচ্ছিলেন গায়ক কিশোরকে।
আসলে ঝামেলাটা পাকিয়েছিলেন আভাস কুমার গাঙ্গুলি নিজেই। ১৯৪৮ সালে দেব আনন্দের ‘জিদ্দি’ ছবিতে কিশোর কুমার নামে “মরনে কি দুয়ায়েঁ কিঁউ মাঙ্গু” গেয়ে আত্মপ্রকাশ। শুনে দেখবেন। সায়গলের অক্ষম অনুকরণ মনে হবে। আর করতেনও তাই। তখন প্লে-ব্যাকের আকাশে গনগন করছেন মুকেশ। তাঁর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছেন তালাত মাহমুদ, মহম্মদ রফি। একের পর এক 'সিরিয়াস' ক্লাসিকাল গানে ভরে উঠছে চলচ্চিত্র। সেখানে একেবারে নওসিখিয়া, তালিমহীন কিশোরকণ্ঠ নেহাত ফিকে। ছোট থেকেই প্র্যাঙ্কস্টার। টিকে থাকতে তাই বেছে নিলেন কমেডিয়ানের চরিত্র। ফল হলো শাঁখের করাতের মতো। একদিকে অভিনেতা কিশোরকুমার একের পর এক ছবি সই করতে লাগলেন, অন্যদিকে গায়ক কিশোরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করলেন সুরকাররা।
আরও পড়ুন- গান প্রতি ১৫ টাকা! গানের চাবুকে বলিউড শাসন করেছিলেন সামসেদ বেগম
ব্যাতিক্রম একজন। শচীন দেব বর্মন। একদিন অশোককুমারের বাড়ি দেখা করতে গিয়ে কিশোরের বাথরুম সং শুনে পছন্দ হয়ে যায় তাঁর। অশোককে বলেন, “এই ছেলেকে দিয়ে আমি গান গাওয়াব”। শুধু মুখের কথা না। পঞ্চাশের দশকে শচীন কত্তা 'বাজি' ছবিতে দেব আনন্দের গলায় গাওয়ালেন “মেরে লবোঁ মে ছিপে”। মোটামুটি হিট। পরের বছরই 'মুনিমজি'-তে আবার দেব আনন্দের গলায় “জীবন কে সফর মে রাহি”। সিনেমার এক ডজন গানের মধ্যে একটাই মেগা হিট। গায়ক কিশোর ভাবলেন, ভাগ্য প্রসন্ন হল। পরের বছর আবার দেব আনন্দ। এবার সেন্টিমেন্টাল গান, “দুখি মন মেরে”। সিনেমার নাম 'মিস্টার ফান্টুস'। ততদিনে সায়গলের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছেন কিশোর। তবুও নায়ক কিশোরের ধারেকাছে নেই গায়ক সত্ত্বা। নবকেতনের 'নও দো গ্যারা' তে “হাম হ্যায় রাহি প্যায়ার কে”, 'পেয়িং গেস্ট'-এ আশার সঙ্গে “ছোড় দো আঁচল” কিংবা সেই বছরের সেরা হিট “মানা জনাব নে পুকারা নেহি” গাইবার পর যখন ভাবছেন এবার পুরোপুরি গানে মন দেবেন, 'কালা পানি'র মতো মেগা প্রজেক্টে শচীন কত্তা তাঁকে বাদ দিয়ে সব গান গাওয়ালেন রফিকে দিয়ে। কত্তার থেকে সেই দশকে বলার মতো সোলো একটাই পেয়েছিলেন কিশোর। “এক লড়কি ভিগি ভাগি সি”- তাও নিজের লিপে!
অবশেষে বিরক্ত কিশোর নিজেই সুর দিয়ে অভিনয় শুরু করেন। ৬১-তে রিলিজ করা 'ঝুমরু'তে “ঠান্ডি হাওয়া ইয়ে চাঁদ হ্যায় সুহানি”-তে তাঁর গলা শুনে চমকে গেলেন শ্রোতারা। এ কোন কিশোর? এত আবেগ তাঁর গলায়! আগে তো কেউ এর খোঁজ রাখেনি! একের পর এক বেদনাভরা গানে নিজেকে নিংড়ে দিতে লাগলেন কিশোরকুমার। হাহাকারের মতো বাজতে লাগল “কোই লওটা দে মেরে”, “যিন রাতোঁকি ভোর নেহি” আর কাল্ট হয়ে যাওয়া “আ চলকে তুঝে”। নিজেকে সিরিয়াস প্রমাণ করতে জান লাগিয়ে দিলেন। সাত বছর পরে আবার শচীনকর্তা দেব আনন্দের গলায় ফিরিয়ে আনলেন তাঁকে। কিন্তু সেই স্টিরিওটাইপ গানে ,“ইয়ে দিল না হোতা বেচারা”। বরং ছেলে রাহুল 'পড়োসন'- ছবিতে “ক্যাহনা হ্যায় ক্যাহনা হ্যায়”-র মতো গান দিলেন তাঁকে। কিশোর বুঝলেন তাঁকে সেকেন্ড বেস্ট হয়েই থাকতে হবে। এক নম্বর হওয়া আর এই জীবনে হবে না। তখনই বম্বে ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা। নেহাত দাদা অশোককুমার কোনওমতে ঠেকালেন। ভাগ্যিস! কারণ ঠিক এই সময় দুটো ঘটনা ঘটল।
আরও পড়ুন- জোর করে ঠোঁটে চুমু খান নায়ক, বাধ্য হতে হয় নগ্ন চরিত্রে, কানন দেবী এক অজানা ‘বনফুল’
'আরাধনা' নামে এই ছবিতে রাজেশ খান্না নামে এক নতুন মুখকে সুযোগ দেওয়া হলো আর সেই ছবির সুরকার হিসেবে কাজ করতে করতে হঠাৎ শচীনদেব শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় বাকি কাজ চালানোর ভার পেলেন ছেলে রাহুল। আর ডি। বাবার এক রকম অনিচ্ছাতেই কিশোরকে দিয়ে গাওয়ালেন “মেরে সপনো কি রানি” আর “রূপ তেরা মস্তানা”। গ্রামাফোন, রেডিও থেকে শুরু করে সবার মুখে মুখে ফিরতে লাগল গান দুটো। চমক কাটতে না কাটতে রাহুল ভয়ানক এক কাজ করলেন যা তাঁর বাবা ভাবতেও পারতেন না। 'প্যায়ার কা মৌসম' ছবিতে একই গান “তুম বিন যাউ কাহাঁ” গাওয়ালেন দুইজনকে দিয়েই। রফি আর কিশোর। কিশোরেরটা হিট করল। রফি বুঝলেন তাঁর সিংহাসন টলছে। 'আরাধনা' সাফল্য পেতেই দেব আনন্দের পর আর এক নায়কের গলায় স্থায়ী হয়ে গেলেন কিশোর। এবার পাকাপাকি। 'কাটি পতং'-এর “ইয়ে জো মোহাব্বত হ্যায়” কিংবা পিকনিকের অপরিহার্য গান “ইয়ে শাম মস্তানি”, 'সফর'-এর “জিন্দেগি কা সফর” অথবা “কুছ তো লোগ কহেঙ্গে”, “চিঙ্গারি কোই ভড়কে”- কিশোর-রাজেশ জুটি হিন্দি ছবির এখনও পর্যন্ত সেরা ডুও হয়ে রয়েছে।
শচীন কত্তা অবশ্য পরে ভুল বুঝে 'অভিমান' এর অমিতাভের কণ্ঠ দিলেন কিশোরকে। কিশোর হৃদয় খুঁড়ে গাইলেন “তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে রেয়না”। কত্তার সুর করা 'মিলি' ছবির শেষ গানটাও তাঁরই গাওয়া। কত্তা হাসপাতালে শুয়ে শেষ মুহূর্ত গুনছেন। কিশোর স্টুডিওতে গাইছেন “বড়ি সুনি সুনি হ্যায়”- যে ক'টা উদাস গানের জন্য কিশোর বিখ্যাত, বোধকরি তাদের সেরাটা। শচীন কত্তার জন্য এত সুন্দর এপিটাফ আর কেউ লিখতে পারতেন না। কেউ না।