কোনও পুরুষই সামলাতে পারেননি কোহিনূর! কোন মন্ত্রে 'অভিশপ্ত' হিরের নতুন মালিক হচ্ছেন ক্যামিলা!
ইংরেজরা কোহিনূরকে কাচের টুকরো মনে করে। তাই পরের বছর রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী রাজা প্রিন্স অ্যালবার্ট কোহিনূর কাটিং এবং পালিশ করান। এর ফলে ১৮৬ ক্যারেটের কোহিনূরের ওজন কমে হয় ১০৫.৬ ক্যারাট
সুদীর্ঘ শাসনে ইতি টেনে বিদায় নিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। বৃহস্পতিবার দুপুরে বাকিংহাম প্যালেসের তরফে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, স্কটল্যান্ডের বালমোরাল প্রাসাদে শান্তিতেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। মৃত্যুকালে রানির বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। সকাল থেকেই রানির শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তাঁর চিকিৎসকেরা, ছুটে আসেন আত্মীয় পরিজন। কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয়নি রানিকে। অবশেষে মৃত্যু হয় ব্রিটেনের রাজপরিবারের সবচেয়ে দীর্ঘায়ু রানির। মায়ের প্রয়াণে এবার রাজা তৃতীয় চার্লস। চার্লসের দ্বিতীয় স্ত্রী ক্যামিলা পার্কার বোলস, ডাচেস অফ কর্নওয়াল হতে চলেছেন ইংল্যান্ডের রানি। প্রয়াত রানি এলিজাবেথের উত্তরাধিকারীই পেতে চলেছেন কোহিনূর মুকুট। প্রিন্স চার্লসের রাজ্যাভিষেকের সময়েই রানি কনসোর্ট হিসেবে ক্যামিলাকে কোহিনূর সহ মুকুট হস্তান্তর করা হবে। কিংবদন্তি এই হিরেকে ঘিরে নানা গল্পকথা ও ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। প্রদীপের তলেই রয়েছে অন্ধকার! একথা কোহিনূরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিভিন্ন সময়ে একাধিক শাসক এর অভিশাপে জীবন খুইয়েছেন। কোহিনূরকে ঘিরে নানান গল্পকথা ও ইতিহাস ফিরে দেখা যাক ফের একবার।
কোহিনূরের ইতিহাস
কোহিনূর একটি আরবি শব্দ যার অর্থ জগতের আলো। মূল্যবান এই হিরের উৎপত্তি নিয়ে একাধিক তথ্য প্রচলিত রয়েছে বিশ্বজুড়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত এক সিভিল সার্ভেন্ট থিও মেটক্যাফে একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ঐতিহ্যমতে এই হিরে শ্রীকৃষ্ণের জীবদ্দশায় তাঁর থেকে আহরণ করা হয়। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের কৃষ্ণা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত গোলকুন্ডা এলাকার কলুর খনি থেকে এই হিরে প্রথম পাওয়া যায়। আঠেরো শতকে বিশ্বে একমাত্র এই এলাকাতেই তখন হিরে পাওয়া যেত। তবে কীভাবে, কে প্রথম কোহিনূর পেয়েছিলেন তা জানা যায় না। এমন বহু মূল্যবান রত্ন সাধারণত নদীর তলদেশে পাওয়া যায়। এমনকি কোন সময় কোহিনূর খনি থেকে পাওয়া তারও যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস ১১০০ থেকে ১৩০০ সালের মধ্যেই এই হিরে প্রথম হাতে আসে মানুষের।
আরও পড়ুন-রাজপরিবারে প্রথম রানি এলিজাবেথের অভিষেকই দেখা গিয়েছিল টেলিভিশনে
১৩০৬ সালে এক হিন্দু পুঁথিতে কোহিনূরের নাম প্রথম উল্লেখ করা হয়। তবে সেই পুঁথির লেখক বা বইটির নাম জানা যায়নি আজও। কোহিনূর হিরের প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় ১৫২৬ সাল নাগাদ। মুঘল সম্রাট বাবর যখন ভারতে আসেন তখন ‘বাবরনামা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ওই বইতেই তিনি উল্লেখ করেন যে, এমন একটি হিরে রয়েছে যার মূল্য অর্ধেক দুনিয়ার প্রতিদিনের খরচের সমতুল্য। মনে করা হয় বাবর যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার হিসেবে কোহিনূর হিরে পেয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার, ১৬২৮ সালে যখন শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন তৈরির কাজ শুরু হয় তখন কোহিনুরের উল্লেখ মেলে ইতিহাসের পাতায়। সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে তাজমহলের তুলনায় চারগুণ বেশি অর্থ খরচ করে নানা মূল্যবান রত্ন দিয়ে তৈরি করা হয় ময়ূর সিংহাসন। এতেই ময়ূরের চোখ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল কোহিনূর হিরে। কোহিনূর ছাড়াও এই সিংহাসন তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয় লাল রঙের তৈমুর রুবি। তবে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুঘল সম্রাটরা রংবেরংয়ের পাথরকে বেশি মূল্যবান সম্পদ মনে করতেন। অন্যদিকে হিন্দু ও শিখ রাজাদের কাছে হিরে ছিল সবচেয়ে পছন্দের রত্ন। তবে তখনও পর্যন্ত কিন্তু এই হিরের নাম কোহিনূর হয়নি। প্রায় ১০০ বছর পর যখন মুঘল সাম্রাজ্যের রাশ আলগা হতে শুরু করেছে সেই সময় দিল্লির ধনসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পারস্যের রাজা নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করেন। কোহিনূর সহ বহু ধনসম্পদ নিয়ে তিনি আবার ফিরে যান দেশে। কথিত আছে, কোহিনূর নাকি মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ তাঁর পাগড়ির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাই পরিকল্পনা করেই প্রথা মেনে নাদির শাহ মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহের সঙ্গে তাঁর পাগড়ি বিনিময় করতে চান। আর সেই সময়েই মূল্যবান সেই হিরে মাটিতে পড়ে যায়। আলো পড়ে হিরের মারাত্মক চমকে নাদির শাহের মুখ থেকে বেরিয়ে যায় কোহ-ই-নূর, যার অর্থ আলোর পর্বত। সেই থেকেই এই হিরের নামকরণ হল কোহিনূর। এরপরের ৭০ বছর আজকের আফগানিস্তানেই ছিল কোহিনূর। তখন থেকেই আরও এক গল্পকথা জুড়ে যায় এই মহামূল্যবান হীরের সঙ্গে। তা হল কোহিনূর নাকি আদতে একটি অভিশপ্ত হিরে।
অভিশপ্ত কোহিনূর
কথিত আছে, যে পুরুষই কোহিনূরের মালিক হবেন, তিনিই হবেন দুনিয়ার মালিক কিন্তু সঙ্গে তাঁর দুর্ভাগ্যও শুরু হয়ে যাবে। ১৩০৬ সালের হিন্দু পুঁথিতেই এই কথার উল্লেখ করা হয়েছিল। অনেকের মতে এটি ভ্রান্ত ধারণা কিন্তু ইতিহাসও খানিক একই পথে এগোতে থাকে এরপর। ১৭৪৭ সালে নাদির শাহ নিজেরই এক রক্ষীর হাতে খুন হন। তাঁর সম্পূর্ণ সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। নতুন রাজা এবং কোহিনূর হিরের নতুন মালিক হন আহমেদ শাহ দুরানি। আহমেদ শাহ দুরানির পৌত্র সিংহাসন হারান এই কোহিনূরের কারণেই। এসে আশ্রয় নেন রণজিৎ সিংয়ের কাছে। ১৮১৩ সালে হাত ঘুরে কোহিনূরও ফিরে এল পঞ্জাবের শিখ রাজা রণজিৎ সিংয়ের কাছে। সকল শাসকের চোখের মণি এই কোহিনূর। কেউই এতটুকু সঙ্গছাড়া করতে রাজি নয়। রণজিৎ সিং হাতের বাজুতে জায়গা দিয়েছিলেন কোহিনূরকে। এরই মধ্যে ১৮৩৯ সালে মারা যান তিনি।
আরও পড়ুন-আন্দামানের ‘রাক্ষস’-দ্বীপের কাছে গেলেই মৃত্যু! কীভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন এক বাঙালি মহিলা?
ব্রিটিশদের দখলে কোহিনূর
ততদিনে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতাও যথেষ্ঠ মজবুত হয়ে ওঠে ভারতে। ব্রিটেনের রাজপরিবারের থেকে খবর আসে কড়া নজরে রাখতে হবে কোহিনূরকে। সময়মতো যেন কোহিনূর নিজেদের দখলে আনা যায় তারও পরিকল্পনা শুরু হয় কোম্পানির অন্দরে। কোহিনূরের জন্য একদশক অপেক্ষা করতে হয়েছিল ব্রিটিশদের। শেষমেষ ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো শিখ যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশরা যখন পঞ্জাবের দখল নেয়, তখন রণজিৎ সিংয়ের নাবালক পুত্র দিলীপ সিংয়ের সঙ্গে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে ব্রিটিশরা। এই চুক্তি পত্রেই লেখা ছিল, কোহিনূর হিরে তাঁরা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেবেন। এরপর সেই হিরে পৌঁছে দিতে দিলীপ সিংকে জাহাজে করে লন্ডন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি শিখ সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য করতে বিদেশে তাঁকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। ১৮৫৪ সালে যখন দিলীপ সিংয়ের ছবি তৈরির কাজ চলছে বাকিংহাম প্যালেসে সেই শেষবারের মত কোহিনূরকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পান তিতিনি। শেষ বয়সে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও সফল হননি দিলীপ সিং। ৫৫ বছর বয়সে প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয়।
কোহিনূরের শাপমোচন
কোহিনূরের নতুন মালিক হয়ে ওঠেন রানি ভিক্টোরিয়া। যে পুঁথিতে কোহিনূরের অভিশাপ সম্পর্কে লেখা ছিল সেখানেই উল্লেখ করা হয়েছিল, একমাত্র ভগবান বা কোনও মহিলাই এই হিরে ধারণ করতে পারবেন কোনওরকম কুপ্রভাব ছাড়াই। তেমনটাই ঘটল। ১৮৫১ সালে ব্রিটেনের রাজপরিবারের তরফ থেকে এই হিরে জনগণকে দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে ইংরেজ জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল একেবারে অদ্ভুত। মহামূল্যবান এই কোহিনূর দেখে তাঁদের কাচের টুকরো মনে হয়। তাই পরের বছর রানি ভিক্টোরিয়ার স্বামী রাজা প্রিন্স অ্যালবার্ট কোহিনূর কাটিং এবং পালিশ করান। কিন্তু এর ফলে ১৮৬ ক্যারেটের কোহিনূরের ওজন কমে হয় ১০৫.৬ ক্যারাট, প্রায় ৪০ শতাংশ ওজন কমে যায়। আজ এই হিরের মাপ ৩.৬×৩.২× ১.৩ সেন্টিমিটার, প্রায় একটি মুরগির ডিমের সমান। ব্রিটিশ রাজবংশও কোহিনূরের অভিশাপ দূর করতে বংশের নারীদের কাছেই এই হিরে অর্পণ করে। আজ অবধি তার অন্যথা দেখা যায়নি। অনেকরই মতে, কোহিনূর ধারণের শর্ত পূরণ হয়েছে তাই শান্তির পরিবেশে থেকে গিয়েছে সে। আজও লন্ডন টাওয়ারের মিউজিয়ামে রয়েছে এই কোহিনূর হিরে। ১৭৩ বছর ধরে ব্রিটিশ রাজপরিবারের কাছেই রয়েছে কোহিনূর। এবার যার মালিক হতে চলেছেন রাজা তৃতীয় চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলা।