উচ্চগ্রামে নেশা আর পথ পেরনোর ছলে এক মৃত্যু মৃত্যু খেলা
Kolkata Bar Hopping: পানশালার পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দেখা যায় বহুদূরে ফানুসেরা উড়ছে মৃতের স্মরণে। কার মুখের অবয়ব ভাসমান লণ্ঠনের মতো।
ছাতাওলা গলির তেরচা রোদ্দুর। পুরনো চিনাবাড়ির ইটলাল দেওয়াল। রাস্তার চিহ্ন, ফুটপাথ-কাহিনির ভিতর কারা উবু বসে পেরেক-গজালের জঞ্জাল ঘেঁটে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে লোহা সোজা করার কাজ করছেন। খাঁচার খরগোশ। লাল চোখের পুঁতি। সবজি কাটার অসফল ছুরি। ট্রামলাইনে উঠব নাকি চলে যাব হরিণবাড়ি লেনের দিকে, এই সব ভাবি। খুঁজে ফিরি হারমোনিক ট্যাভার্ন। টেবিল বুকিংয়ের এক মুদ্রা। পিয়ানোর স্খলিত বিকেল। নর্তকীর বাহুবন্ধে আদিম বন্যতুলসির মশালা আর সতেজ ফলের মেদুর কনিয়াক গন্ধ। জীবনানন্দ দাশ এই সব পথে হাঁটতে হাঁটতে কখনও ফিয়ার্স লেনের অন্ধকার বেছে নিতেন। ইহুদি সিনাগগের প্রার্থনা-সংগীত বুঝি ছড়িয়ে পড়ত সেই অন্ধকারে।
পুলিস হেডকোয়ার্টারের কাছে সেই হারমোনিক ট্যাভার্ন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। হ্যাংওভারের আকাশ লালবাজারের উলটো প্রান্তের সপ্তপর্ণী গাছের খিড়কি পার করে উড়ে যেতে চায় পাঞ্চ-হাউজগুলোর অবিমিশ্র হট্টগোল আর খেউড়ের দিকে। পরপর দ্রুত স্ফুর্তির নাম ছিল পাঞ্চ করা। একে অন্যকে দেখা হলে জিজ্ঞেস করা হতো, কটা পাঞ্চ করেছিস? এসব অবশ্য অনেক উচ্চ-পর্যায়ের নেশাড়ুদের ব্যাপার। একজন ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার সময়, একদম ফাঁকা আর গভীরতর রাতের হার্ড মেটালিক নিয়ন লাইটস, কোহল যখন তার পেটে ঘন হয়ে বসেছে, বলল, "যে কোনও ঘটনাকে দু'রকম ভাবে ভেবে দেখতে হবে আমাদের।"
সুরিন্দরকে তাই বললাম, "সুরিন্দর তোমার ছুরি বিপ্লবের কাজে ব্যবহার করো।" সুরিন্দর তাঁর ছুরির কিনারায় সাজিয়ে রাখত হরেক ফল। শসা, শাঁকআলু, পাকা পেঁপে, টমেটো। সুরিন্দরের আস্তানা কোথায় কে জানে। তবে দোকান ছিল খালাসিটোলার ভিতরে। চাটের পয়সা না থাকলেও সুরিন্দর হাসত। খালাসিটোলায় তখন চন্দ্রদোষের অভিযান। টাকা জমা রেখে খালি বোতল আর গেলাস নিয়ে কখনও টেবিলে, বেশিরভাগ সময়েই পাঁচিলের উপর পানপাত্র সাজিয়ে আসর তৈরি করা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পারস্পরিক মেধাক্ষরণ নাকি বিনিময়। সন্ধের পর থেকেই গুঞ্জরণের গুঞ্জা। লাল কুঁচফলের উল্লাস। খালাসিটোলা ছিল জাহাজি খালাসিদের সস্তার পানশালা। ইংরিজি মদ যে পাওয়া যেত না তা নয়। তবে দিশি পানেই মৌতাত বানাতেন রসিকেরা। দিনমজুর, কুলিকামিন, ব্রিফকেসবাহী বিমা কোম্পানির দালাল, পকেটমার, মস্তান, রিকশওলা, কেরানি, উঠতি ছোকরা, কাঁধে ঝোলা কবি সব এক আসনে। কলকাতার পুরনো পাঞ্চ হাউজগুলোর গন্ধ খুঁজে পাওয়া যেত নব্বইয়ের খালাসিটোলায়। নেশা উচ্চগ্রামে উঠলে গেটের ভিখারিরা থালা বাজাতেন। তাঁদের স্বরে সিমফোনির তীক্ষ্ণ সোপ্রানো সুর। সেইসব মায়াআঁখিকাজল কাটিয়ে ট্রামলাইনে উঠে পড়তাম। পথ পেরনোর ছলে মৃত্যু মৃত্যু খেলা শুরু হত। সুরিন্দরের ছুরির মতো অসফল চাঁদ। শনিবার যেন চন্দ্রদোষের রাত। নেশা করে ফিরছি আর হাসপাতালের চারদিকে কোকিল ডাকছে।
শিয়ালদায় শুঁটকি মাছ বাজারের চিপা গলি পার করে ডান হাতে আরও তস্য চিপা গলির ভিতর সাহাবাবুর ঠেক। সেখানেও গরিব গুর্বোদের কলতান, উৎসব। বাইরের কল থেকে বোতলে জল ভরে নিতে হত। অবসন্ন খাঁ-খাঁ দুপুরের মনোক্রোম ছবিতে আঁকা সাহাবাবুর ঠেকে ভিড় লেগেই রয়েছে। গেলাসে গেলাসে কবিতার কথকতা। এক লাইন লেখা আর সেই লাইনের ইলাস্ট্রেশন। সাহাবাবুর ঠেকে পোস্টার তৈরি হতো। বন্ধুরা মাতি তরজায়। যদিও তখন শঙ্খের চেয়ে শক্তি বেশি করে ভাবাচ্ছে। আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে।
সন্ধেয় অদৃশ্য পাখি ধরা ফাঁদ ঘুমের তলায় ফাঁদ পাতে। বন্দুকগলির সেই পথচিহ্ন। ফুটপাথ কাহিনি। পুরনো চিনাবাড়ির ইটলাল দেওয়াল। ট্রামলাইনের ঘণ্টায় কারা ফুসফুস জ্বালিয়ে একা হেঁটে যায়। আগুন পোড়াতে পোড়াতে ফুসফুসের জন্মদ্বার চুল্লিতে গুঁজে দেয় রাত্রিকালীন ক্ষীণ স্বাস্থ্যের আলো। সেই আলোতে কখনও ভেসে ওঠে নাগরিক পানশালা। মদের দেবতা বাক্কাস পানপাত্র ভরে দেন। মেঝে আর দেওয়ালের ফুটো দিয়ে ইঁদুরের উচ্ছ্বল ক্রীড়া। পুলিশের খবরিলালরা পেগের পর পেগ ওড়াচ্ছে। বেশি রাতে দরজা বন্ধ হলেই ভিতরে অবাধ ধুমপানের কুণ্ডলী। মদের দেবতা বাক্কাস নিজেই এবার আসর
সাজিয়ে বসেন। টেলিভিশনে ভিলেন নায়িকাকে অশ্লীল প্রস্তাব দেয়। বাইরে সপ্তপর্ণী গাছের ফুলে তীব্র আশ্লেষ, ঘোর লাগা সুবাস।
পানশালা হপিংয়ের দিনে ডিহি কলকাতার পাব ছিল অস্বচ্ছ নোংরা কাচের। ইউরিনালের মোদো দেওয়ালে শহরের অসংখ্য অলিগলির আঁকিবুঁকি। ফোন নম্বর। আনসারদার হিসেবঘর। ছবিহীন সংখ্যার ক্যালেন্ডার। উপরের তলা যেন অ্যাকোয়ারিয়ম। রঙিন মাছেদের দল সাঁতার কাটতে কাটতে নীচে নেমে আসে। শুভ্রকে দেখা যায় কোমর-মাথা ঝুঁকিয়ে অবিশ্বাস্য প্রাণ কাটিয়ে দিচ্ছে। যারা হারিয়ে গেছিল সবাই হইহই করে ফিরে এসে টেবিলের দখল নিচ্ছে। আরও অনেক রাতে পানীয়ের বুকে জমে ওঠে কাচ ক্যালাইডোস্কোপিক ধাঁধাঁ জ্যামিতিক বিচ্ছুরণ। পানশালার পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দেখা যায় বহুদূরে ফানুসেরা উড়ছে মৃতের স্মরণে। কার মুখের অবয়ব ভাসমান লণ্ঠনের মতো।