আগুনে পুড়ে শেষ ১৫ জন! সিঁড়ি নেই, জল নেই! বড়বাজারের হোটেল না জতুগৃহ?
Hotel Rituraj Fire: আগুন লাগার ফলে প্রবল ধোঁয়ার জেরে হোটেলটি ‘গ্যাসচেম্বার’-এ পরিণত হয়। যার ফলে হোটেলের ভিতরে দমকল কর্মীরাও ঢুকতে পারছিলেন না।
কলকাতার বড়বাজার এলাকাটি যে জতুগৃহ, তা নিয়ে বহু বছর ধরেই সংবাদপত্রে গুচ্ছ গুচ্ছ শিরোনাম হয়েছে। সংবাদপত্র যদি কেউ না-ও পড়ে থাকেন, দিনে-রাত্রে ওই ঘিঞ্জি এলাকার দিকে কয়েক ঝলক তাকালেই জতুগৃহের ছবিটি সম্পূর্ণরূপে ধরা পড়বে বাস্তবে। অজস্র দোকান, বিদ্যুৎবাহী তারের অভাবনীয় জটিল শামিয়ানা, গলি, তস্য গলি, ভিড়, প্রাচীন ভাঙাচোরা বাড়ি, তারই মধ্যে হোটেল, কিছু ঝাঁ চকচকে দোকান, এসি! আবারও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটল এই জতুগৃহেই। প্রাণ গিয়েছে ১৫ জনের। আবারও কলকাতার মনে পড়ে গেল স্টিফেন কোর্ট, মনে পড়ে গেল আমরি হাসপাতালের মর্মান্তিক সেইসব ঘটনা। মঙ্গলবার রাতে বড়বাজারের ঋতুরাজ নামে একটি হোটেলে আগুন লেগে ১৪ জনেরই দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়। প্রাণ বাঁচাতে নীচে ঝাঁপ দিতে গিয়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে আরেকজনের। কলকাতা মেডিকেল কলেজে মোট ন’জনকে উদ্ধার করে আনা হয়েছিল। ন’জনের মধ্যে চারজনকেই মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল বলে জানান চিকিৎসকরা।
বড়বাজারের মেছুয়ার ফলপট্টির ওই হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃতদের মধ্যে রয়েছেন ১২ জন পুরুষ, এক মহিলা এবং দুই শিশু। ৮ জনের দেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে এখনও। মর্মান্তিক এই অগ্নিকাণ্ডে আহত ১৩। মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ ওই হোটেলে আগুন লাগে। দমকলের ১০টি ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে যায়। প্রায় ৮ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ছ’তলার ওই হোটেলের দোতলায় আগুন লেগেছিল। তার পর সেই আগুন অন্য তলেও ছড়িয়ে পড়ে। হোটেলের মোট ৪২টি ঘরে তখন ৮৮ জন মানুষ ছিলেন।
প্রশ্ন উঠছে, এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল কীভাবে? হোটেল কর্তৃপক্ষের কি অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না? ঘটনার পর থেকে হোটেলের মালিকেরও আর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্থানীয় সূত্রে খবর, আগুন লাগার ফলে প্রবল ধোঁয়ার জেরে হোটেলটি ‘গ্যাসচেম্বার’-এ পরিণত হয়। যার ফলে হোটেলের ভিতরে দমকল কর্মীরাও ঢুকতে পারছিলেন না। তাঁরা মই দিয়ে চার ও পাঁচ তলার ঘরের জানলা ভেঙে সেখানে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন। তার পর একে একে হোটেলের আবাসিকদের উদ্ধার করেন।
জানা গিয়েছে, ওই হোটেলে ঢোকার এবং বেরনোর একটাই সিঁড়ি। তাই আগুন লাগার সময় অনেকেই নীচে নামতে পারেননি। অনেকেই হোটেলের ঘরেই আটকে পড়েন। মূলত ওই দুর্ঘটনার সময় এই রাজ্যের ও ভিনরাজ্যের বাসিন্দারা হোটেলে ছিলেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ঠিকঠাক না থাকায় ও আপতকালীন বেরনোর রাস্তার সুবন্দোবস্ত না থাকায় অনেকেই বেঁচে বের হতে পারেননি। আগুন থেকে বাঁচতে কয়েকজন হোটেলের ছাদে পালান। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে সঙ্কেত দেন বহু মানুষ। প্রাণে বাঁচতে হোটেলের ছাদের কার্নিশে এসে দাঁড়ান অনেকে। সেখান থেকেই পড়ে গিয়ে ১ জনের মৃত্যু হয়। পুলিশ সূত্রে খবর, আনন্দ পাসোয়ান নামে ওই ব্যক্তিকে আহত অবস্থায় তাঁকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।
এত ব্যস্ত জায়গায় একটি ছ'তলা বহুতল৷ একতলায় আবার আছে পানশালা এবং রেস্তোরাঁও৷ দোতলায় বেআইনিভাবে নতুন করে রেস্তোরাঁ তৈরি করা হচ্ছিল বলেও জানা গেছে৷ অথচ বড়বাজারের এই ঋতুরাজ হোটেলে ঢোকা-বেরনোর জন্য কেন একটাই সিঁড়ি ছিল? দমকলের নিয়ম মেনে আপতকালীন কোনও সিঁড়ির ব্যবস্থা কেন ছিল না হোটেলে? অভিযোগ উঠেছে, হোটেলে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও আগুন লাগার পর তা কাজ করেনি৷ জলও বেরিয়ে আসেনি৷ প্রশ্ন উঠছে আদৌ ওই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল তো?
এই ঘটনার পর দমকল মন্ত্রী সুজিত বসু বলেছেন, “খবর পেয়ে আমরা ওখানে গিয়েছিলাম। হোটেল কর্তৃপক্ষের অনেক গাফিলতি ছিল। ওদের সিস্টেম কোনও কাজ করেনি। তার সঙ্গে পুরো বিল্ডিংটা গ্লাস দিয়ে ঢাকা ছিল। আগুন বা ধোঁয়া বের হওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না। সে কারণেই দমবন্ধ হয়ে লোকজন মারা গিয়েছে। আগুন নেভানোর সময় ভিতরে ঢুকে আমাদের লোকজনকে সেই কাচ ভাঙতে হয়েছে। হোটেলের বিরুদ্ধে আইনের দিক থেকে যা যা অ্যাকশন নেওয়ার সবটাই নেওয়া হবে।”
মন্ত্রীর কথতেই প্রশ্ন উঠছে, এমন ঘিঞ্জি জায়গায়, পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছাড়াই যে হোটেল গজিয়ে উঠল তারই বা অনুমতি দিল কে? স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই বলেছেন, জলের ট্যাঙ্ক থেকে জল নিয়ে শুরুতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছিল হোটেলের লোকজন কিন্তু পর্যাপ্ত জলও ছিল না। এত অব্যবস্থা নিয়ে বড়বাজারের মতো জমজমাট জায়গায় হোটেল চলছিল কীভাবে? এমন ঘিঞ্জি জায়গায় কোথাও সামান্য আগুন লাগলেই তা নিমেষে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। দাহ্য পদার্থের ভিড় এই এলাকায়। অথচ কোনও নিরাপত্তাই নেই? কলকাতার নগরপাল মনোজ বর্মা জানিয়েছেন, কীভাবে আগুন লাগল তা খতিয়ে দেখার জন্য বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করা হয়েছে। তদন্তপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এমন তদন্ত সমস্ত অগ্নিকাণ্ডের পরেই হয়। তার পরেও দমকলের নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে চলে বহুতল নির্মাণ, চলে সাধারণ মানুষদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। প্রশাসন কি সত্যিই দেখেও দেখে না?