ডিসেম্বরের শহরে রামধনু যাত্রা! কলকাতা কি সত্যিই সাবালক হয়েছে আজও?
Kolkata Pride Walk 2023 : পার্ক স্ট্রিট জুড়ে রবিবারের এই রামধনু যাত্রা ১৯৯৯ সালের প্রথম দিনটির কথা মনে করিয়েছে অনেককে৷
শীতের কলকাতায় রামধনু নেমেছিল রবিবার। ১৭ ডিসেম্বর, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো প্রাইড ওয়াক দেখল কলকাতার সড়ক। সমাজের তৈরি করা সামাজিক লিঙ্গ পরিচয়ের 'বাইনারির' বাইরে গিয়ে অন্য সমস্ত যৌন পরিচয়ের মানুষের স্বীকৃতির দীর্ঘকালের লড়াই চলেছে। ধীরে ধীরে জয় এসেছে, ধীরে ধীরে কিছু বাধা ভেঙেছে কিছু বাধা এখনও পাহাড়ের মতোই দৃঢ়। তবু, কলকাতার বুকে এই রামধনু যাত্রা বুঝিয়ে দিল চাকা ঘুরছে, খেলা পাল্টাচ্ছে। ২৪ তম রামধনু যাত্রায় মানুষের ভিড়, নিডর হয়ে বাঁচার প্রত্যয় শহরকে বিচক্ষণ করল কিঞ্চিৎ, অনেকটা করলও না হয়তো। এবছর কলকাতার এই প্রাইড ওয়াক ছিল একটু আলাদা। সমকামী, রূপান্তরকামী, ক্যুইয়ার সন্তানদের বাবা-মায়েরাও সন্তানদের সমর্থনে মিছিলে হেঁটেছেন।
এলজিবিটিকিউ+ সন্তানদের অভিভাবকদের জন্য তৈরি গোষ্ঠী 'স্বীকার'-এর মহুয়া শেঠ জানাচ্ছেন, রবিবারের প্রাইড ওয়াকে প্রায় ২৫ জন অভিভাবক এসেছিলেন সন্তানের সমর্থনে। অন্য যে কোনও বছরের চেয়ে এই অংশগ্রহণ বেশ বেশি এবং গুরুত্বপূর্ণ৷ সারা ভারতে এই 'স্বীকার' সংস্থার সঙ্গে প্রায় ৪৫০ জন অভিভাবক রয়েছেন। এদের মধ্যে আটজন প্রাইড ওয়াকে হেঁটেছেন এখনও অবধি। তবে কলকাতার প্রাইড ওয়াকে বাবা-মায়ের ভূমিকা সমকামী-রূপান্তরকামীদের এই লড়াইকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা জুড়েছে।
সন্তানকে 'আর পাঁচজনের' মতো করেই দেখতে চাওয়া, সন্তান তেমন না হলে 'চিকিৎসা' করানোর কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে যে বাবা-মা-অভিভাবকরা সন্তানের বাঁচার অধিকার নিয়ে সওয়াল করছেন, সন্তানের পাশে থাকছেন সমস্ত লড়াইয়ে- এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি কীই বা!
১৯৯৯ সালে প্রথম কলকাতা প্রাইড ওয়াকে অংশ নিয়েছিলেন পবন ধল। এতবছরে কতটা পাল্টাল কলকাতার অবস্থান? পবন স্বাভাবিকভাবেই এই দ্রুত পাল্টে যাওায় খুশি। পথ এখনও দীর্ঘ ভীষণ তবু, এরই মধ্যে অনেকটা বপদল কাঙ্খিত পথেই এসেছে। মিছিলে অভিভাবকদের উপস্থিতি যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি অভিভাবকদের সংবেদনশীলতা তৈরির কর্মসূচিরও বৃদ্ধি ঘটেছে সমানতালে। এই মাসের শুরুতেই, কলকাতা প্রাইড ওয়াকের আয়োজকরা একটি ট্রান্স-ক্যুইয়ার স্পোর্টস মিট এবং স্বাস্থ্য শিবিরেরও আয়োজন করেছিলেন বাবা-মায়েদের জন্য।
'অদ্ভুত' বলেছে সমাজ। তাই পৃথক করে রাখার তোড়জোড় সর্বত্র। নিজেকে এই মাটি-আকাশ-জলের একজন করেই রামধনু গড়তে চাওয়ার লড়াই, আঘাত, সাফল্য কোনওটাই সহজ ছিল না, নয়ও। এই লড়াই সত্যিই কেবল ক্যুইয়ার মানুষটির নয়, পুরো পরিবারের। এতে জড়িয়ে যায় বন্ধু, প্রতিবেশী। একা হতে হতে শেষ হয়ে যাওয়া অথবা লড়াই- এই দুই পথ। রামধনুরা তো আলোর পথেই হাঁটবে।
এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তাই বাবা-মায়ের সমর্থন এক বিশাল সমস্যা এবং একইসঙ্গে সমাধানও। বাবা-মা সন্তানকে না বুঝলে প্রথম পথটিই প্রশস্ত হয়। একা হওয়া, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, শেষ করে দেওয়া। অনেক ক্যুইয়ার মানুষই ঘরছাড়া হয়েছেন। আরও সঙ্কটে পড়েছেন। চরম মুহূর্তে ঠোক্কর খেয়েছেন সবচেয়ে বেশি পরিবার থেকেই। সকলেই বদলাননি, তবে অনেক সংবেদনশীল বাবা মা সন্তানকে আঁকড়ে রেখেছেন। পাশে থেকেছেন, সমর্থন করেছেন।
পার্ক স্ট্রিট জুড়ে রবিবারের এই রামধনু যাত্রা ১৯৯৯ সালের প্রথম দিনটির কথা মনে করিয়েছে অনেককে৷ ১৫ জনের মিছিল ছিল সেবার। এখন প্রতি বছর হাজার হাজারে মানুষ হাঁটেন৷ আসলে একদিনে তো হবে না, হয় না। তবে একদিন তো হবেই, রামধনু উঠবে নির্ভীক। সেই রামধনুর তলে সমান অধিকারের লক্ষ্যে পা মেলাবেন সক্কলে। কোনও নারী-পুরুষ নয় কেবল মানুষ হাঁটবে সড়কে, গলিতে।