চিকেন স্টু থেকে মালাই টোস্ট, আজও কলকাতার খাবারের সেরা ঠিকানা এই একচিলতে গলি

একটামাত্র গলিতে শুধু খাবারের স্বাদ, গুণমান এবং সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে দামকে সম্বল করেই ডেকার্স লেন হাসিমুখে মানুষের জন্য রকমারি খাবার পরিবেশন করে চলেছে।

 

রাস্তা না বলে গলিই বলা চলে। সেই গলির নামের সাইনবোর্ডটা গাছ এবং ত্রিপলের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। তাই কাছে না গেলে দেখা যায় না। যদিও একবার গলির সামনে পৌঁছে গেলে নাম দেখার দরকার পড়ে না। অসংখ্য সুস্বাদু খাবারের স্টল এবং মানুষের ভিড় দেখেই বোঝা যায় যে, ঠিক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছি। বড় রাস্তা থেকে গলির ভেতরে ঢুকলে মনে হতেই পারে যে, ভূতের রাজা যেমন গুপি-বাঘাকে নিজের পছন্দের হরেকরকম খাবার খাওয়ার বর দিয়েছিল, কলকাতা আমাদের সেইরকম বর দিয়েছে। সিনেমা আর বাস্তবে শুধু দুটো পার্থক্য রয়েছে। খাবার পাওয়ার জন্য গুপি-বাঘাকে হাততালি বাজাতে হতো। বাস্তবে আমাদের খাবার পাওয়ার জন্য সেই গলিতে যেতে হবে অথবা মুঠোফোনে অ্যাপ থেকে খাবার আনাতে হবে। দ্বিতীয় পার্থক্য হলো, গুপি-বাঘা গান শুনিয়ে ভূতের রাজাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল বলেই বিনামূল্যে খাবার পাওয়ার বর পেয়েছিল। আমরা তো আর ভূতের রাজাকে খুশি করার মতো গান গাইতে পারি না। তাই আমাদের খাবার কেনার জন্য খাবারের দাম দিতে হয়। যদিও আমাদের শহর এই ক্ষেত্রে আমাদের বেশ খেয়াল রেখেছে। তাই এইখানে খুব কম দামেই সকলের সাধ্যের মধ্যে বিভিন্ন রকমের খাবার পাওয়া যায়। প্রায় দুই শতাব্দী পেরিয়ে আজও বহু মানুষের প্রতিদিনের বিভিন্ন রকমের খাবারের চাহিদা পূরণ করে চলেছে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার খুব কাছেই অবস্থিত ডেকার্স লেন।

ডেকার্স লেনকে নিঃসন্দেহে কলকাতার একটা বিখ্যাত খাবারের রাস্তা বলা যেতে পারে। এখানে বিক্রি হওয়া আলাদা আলাদা খাবারের মতো ডেকার্স লেনের আলাদা দুটো নাম রয়েছে। একটা ডেকার্স লেন, যে নামটার সঙ্গে বেশিরভাগ মানুষ পরিচিত। দ্বিতীয় নামটা হলো, জেমস হিকি সরণি। কলকাতায় ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে কলকাতার কালেক্টর ফিলিপ মিলনার ডেকার্স এই এলাকায় জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে দেখা করতেন। দীর্ঘ সময় সমুদ্রে কাটিয়ে আসা নাবিকরা এখানে এসে বিভিন্ন রকমের খাবার খেত। সেই থেকেই ক্রমে এই এলাকায় বিভিন্ন রকমের খাবার বিক্রি হতে শুরু করে। ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে, স্বাধীনতার পরে, বিভিন্ন অফিসের কর্মীদের নানা সময়ের নানারকম খাবার পরিবেশন করতে থাকে এই ছোট রাস্তাটা। বর্তমানে সেই ছবিটা প্রায় একইরকম রয়ে গিয়েছে। জেমস হিকি নামটা প্রায় সবাই ইতিহাসের বইতে পড়েছি। তাঁর দ্বারা প্রকাশিত হিকির 'বেঙ্গল গেজেট' সম্ভবত ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সংবাদপত্র ছিল। তাঁর এই অবদানকে সম্মান জানিয়েই এই রাস্তার নাম তাঁর নামে করা হয়। যদিও বেশিরভাগ মানুষ এই রাস্তাকে আজও ডেকার্স লেন বলেই চেনে।

Dacres lane

ডেকার্স লেনের চাউমিন ও চিলি চিকেন অতুলনীয়

ডেকার্স লেনের নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার কারণ, সাধ্যের মধ্যে বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু খাবার এবং পানীয়। সেই দীর্ঘ তালিকায় কী নেই? টোস্ট, চিকেন স্টু, ডিমসেদ্ধ অথবা ঘুগনি, পাঁউরুটি খেতে চান? পাবেন। চাউমিন, রোল অথবা চপ, কাটলেট খেতে চান? পাবেন। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন অথবা পোলাও, মাংস খেতে চান? পাবেন। বিরিয়ানি, রুটি, মাংস, বিভিন্ন রকমের তরকারি , বিভিন্ন রকমের মাছের ঝোল, ডাল, লস্যি, রকমারি মিষ্টি, চা, গরম দুধ সবকিছুই এই একটা ছোট গলির বিভিন্ন দোকানে পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: চিনে খাবারের স্বর্গরাজ্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে কলকাতার এই এলাকা

দোকান বলতে যদিও সব পাকা দোকান না। রাস্তার ধারে বহু স্টল রয়েছে, যেগুলোর সামনে ভিড় লেগেই থাকে। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে অথবা বেঞ্চে বসে খাওয়ার লোকের অভাব থাকে না। ৩০-৩৫ টাকার মধ্যে অনেক দোকানেই পেট ভর্তি করা খাবার খাওয়া যায় । ডেকার্স লেনের যে খাবারগুলো একবার চেখে দেখা যায়, তার দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। সেই তালিকার মধ্যে চিকেন স্টু, পাঁউরুটি-ঘুগনি, মালাই টোস্ট, চিকেন কাটলেট, ফিশ রোল, ড্রাই চিলি চিকেন, বিভিন্ন মিষ্টি একবার অবশ্যই খেয়ে দেখা উচিত। এই সবকিছুর পরেও মনে ইচ্ছে থাকলে অবশ্যই মাটির ভাঁড়ে চা চলতে পারে।

chitto-babur-dokan-esplanade-kolkata-street-food

ডেকার্স লেন মানেই চিত্তবাবুর দোকান

ডেকার্স লেনের বিশেষত্ব শুধুমাত্র বিভিন্ন রকমের খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এখানে বহু খাবার আর পাঁচটা এলাকার দোকানের থেকে আলাদাভাবে তৈরি করা হয়। যেমন চিত্তদার সুরুচি রেস্টুরেন্টের ফ্রায়েড রাইসের স্বাদ। আমাদের পরিচিত দোকানের ফ্রায়েড রাইসের স্বাদের থেকে এই স্বাদ অনেকটাই আলাদা। এই দোকানে ফ্রায়েড রাইসে মিষ্টি একটু বেশি এবং অনেকটা ঘরোয়া পোলাওয়ের স্বাদের সমতুল। ডেকার্স লেনের চিত্তবাবুর দোকানের চিকেন স্টু সাধারন মানুষের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। এই স্টুয়ে মুরগির মাংসের সঙ্গে একটা সেদ্ধ গাজর এবং পেঁপের টুকরো দেওয়া হয়। ডেকার্স লেনের গলির মুখের দিকে একটি স্টলে খিচুড়ি পাওয়া যায়। শীতকালে সেই খিচুড়িতে ফুলকপির টুকরো দেওয়া হয়। গলির ভেতরের দিকে ফালতু টি-স্টলে মালাই টোস্টের স্বাদ বহুদিন মুখে লেগে থাকে। দুধ বারবার ফুটিয়ে ঘন করে তারপর সেটার থেকে মালাই তৈরি হয়। টোস্ট, তার ওপর দুধের মালাই এবং তার ওপর চিনি দিয়ে এই মালাই টোস্ট তৈরি করা হয়। শুনতে সাধারণ লাগলেও এই টোস্টের স্বাদ অসাধারণ।

অতিমারী শুরু হওয়ার পরে ডেকার্স লেনের দোকানগুলির ব্যবসা লোকসানের মুখে পড়েছিল‌। যদিও বর্তমানে ডেকার্স লেন তার পুরনো ছবিটা অনেকটা ফিরে পেয়েছে। অফিসের কর্মীদের সঙ্গে অন্যান্য বহু মানুষ রকমারি খাবারের খোঁজে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। হাল ফ্যাশনের দোকান নেই, ঝাঁ চকচকে বিজ্ঞাপন নেই, এয়ারকন্ডিশন নেই। একটামাত্র গলিতে শুধু খাবারের স্বাদ, গুণমান এবং সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে দামকে সম্বল করেই ডেকার্স লেন হাসিমুখে মানুষের জন্য রকমারি খাবার পরিবেশন করে চলেছে।

More Articles