পুকুর থেকে পাওয়া গিয়েছিল দেবীর চরণ, শক্তিপীঠ কালীঘাট আজও ভক্তদের বিস্ময়

কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরটি ২০০ বছরেও বেশি পুরনো। এটি ১৮০৯ সালে সাবর্ণ রায়চৌধুরী জমিদার পরিবারের শিবদাস রায়চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল রায়চৌধুরী এবং ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরীর উদ‍্যোগে আদিগঙ্গার তিরে মন্দিরটি...

 

৫১ সতীপীঠের মধ্যে ৪১তম শ্রেষ্ঠ একটি সতীপীঠ হলো মহাতীর্থ 'কালীঘাট'। পুরাণমতে, সতীর দেহ সুদর্শন চক্র দ্বারা ছিন্ন করার সময় কালীঘাটে সতীর দক্ষিণ পদাঙ্গুলি পড়েছিল। এই অঞ্চলটিকে শক্তিপীঠ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

পীঠমালায় বর্ণিত আছে, এখানে দেবী কালিকা ও পীঠ-রক্ষক ভৈরব নকুলেশ্বর।

নকুলেশঃ কালীঘাটে দক্ষপদাঙ্গুলি চ।

সর্বসিদ্ধিকারী দেবী কালিকা তত্র দেবতা।।


সতীর অঙ্গের দক্ষিণ পদের চারটি আঙুল এই স্থানে পড়েছিল। পীঠমালায় বর্ণিত রয়েছে,

মাতঃ পরাৎ পরে দেবী সর্ব্বজ্ঞানময়ীশ্বরী।
ক্ষেত্রানাং কথ্যতেদেবী কালীক্ষেত্রং বিশেষত দেব্যুবাচ।
দক্ষিণেশ্বর মারভ্য যাবচ্চবহুলা পুরী।
ধনুরাকার ক্ষেত্রঞ্চ যোজনদ্বয় সংখ্যকং।।
তন্মধ্যে ত্রিকোনাকার ব্রহ্মাবিষ্ণু শিব্যত্ম্যকং।
মধ্যে চ কালিকা দেবী মহাকালী প্রকীত্তির্তা।।
নকুলেশঃ ভৈরব যত্র যত্র গঙ্গা বিরাজিতা।
তত্র ক্ষেত্রং মহাপূণ্যং দেবনামপি দুর্লভং।
কাশীক্ষেত্রং কালীক্ষেত্র মভেদোপি মহেশ্বরঃ।
কীটোহপি মরনে মুক্তি কিং পুনম্মার্নবাদয়ঃ।
ভৈরবী বগলা বিদা(কালী)মাতঙ্গী কমলা তথা।

ব্রাহ্মী মাহেশ্বরী চন্ডীচ্যাষ্ঠশক্তি বসে সদা।।

আরও পড়ুন: সতীর অঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত আলো দেখেছিলেন তান্ত্রিক, কিংবদন্তির ঠিকানা এই জেলা

অর্থাৎ, "মাতা সর্ব জ্ঞানের ঈশ্বরী,সর্বসিদ্ধিকারী। উত্তরে দক্ষিণেশ্বর এবং দক্ষিণে 'বহুলা' (বেহালা)। মাঝখানে ধনুকের মতো বাঁকা ত্রিকোণাকার অংশে (কলকাতা) অবস্থান করছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। এর মাঝখানে মহাকালী বিরাজিতা। এই স্থানে ভৈরব 'নকুলেশ্বর' রয়েছেন সদা-জাগ্রত হয়ে। মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে আদিগঙ্গা। মহাপুন্যস্থান এবং দেবভূমি এই কালীঘাট। এই স্থানে এলে কাশীবাসের মতো পুন্য অর্জন করা যায়। এখানে অষ্টমহাবিদ্যা ভৈরবী, বগলামুখী, বিদ্যা(কালী), মাতঙ্গী, কমলা, ব্রাহ্মী, মহেশ্বরী ও চণ্ডী বিরাজ করছেন।"

কালীঘাটে মূলত আটটি পুজো হয়। রক্ষাকালী পুজো, স্নানযাত্রা, জন্মাষ্টমী, মনসা পুজো, চড়ক, গাজন, রামনবমী ও দীপান্বিতা। এই মন্দিরে দুর্গাপুজোও হয়। মায়ের মঙ্গলারতি দিয়ে দিন শুরু হয়, এরপর নিত্যপুজো, দুপুরের ভোগ ও আরতি হয়। দুপুরের ভোগে থাকে বিশাল আয়োজন। প্রত্যহ মায়ের ভোগে থাকে ৩০ কিলোগ্রাম গোবিন্দভোগ চালের ঘি-ভাত,৪ কিলোগ্রাম গোবিন্দভোগ চালের সাদা ভাত, পাঁচ রকমের ভাজা, শুক্তো, ২০ কিলোগ্রাম ওজনের শাক-সবজি (সাধারণত গরমকালে থাকে আলু-পটলের তরকারি, শীতকালে হয় আলু ফুলকপি, শিম ইত্যাদি)।নিত্যভোগে প্রত্যহ মাকে আঁশযুক্ত মাছ দেওয়া হয়। এর মধ্যে বর্ষাকালে দেবীর জন্য থাকে ইলিশ মাছ। দিন শুরুর প্রথমেই বলি হওয়া মাংস দিয়ে প্রস্তুত হয় দেবীর 'মহাপ্রসাদ'।

Kalighat

কথিত আছে, কালীঘাটের কালীর মহিমা অপার। ভক্তদের বিশ্বাস, অত্যন্ত জাগ্রত এই দেবী মাতার কাছে বিশ্বাস-সহকারে কিছু কামনা করলে, মা তাকে কখনওই খালি হাতে ফেরান না, তিনি সবারই মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন। কালীঘাটের মাকে অনেকে বলেন, কলকাতার রক্ষাকর্ত্রী। এখানে কালীমাতার ভৈরব হলেন নকুলেশ্বর। কালীঘাট মন্দিরের কাছেই পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর শিবের মন্দির। জনশ্রুতি আছে, কালীঘাটের মন্দির-সংলগ্ন একটি পুকুর থেকে সতী মায়ের খণ্ডিত অঙ্গ পাওয়া গিয়েছিল। এই পুকুরটি 'কুণ্ডপুকুর' নামে খ্যাত। এর জল গঙ্গা জলের মতো পবিত্র বলে অনেকে মনে করেন। শোনা যায় যে, ইংরেজ আমলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীদের নিয়মিত মায়ের মন্দিরে আনাগোনা ছিল। তাঁরা মায়ের পুজোও দিতেন। একবার একজন শ্বেতাঙ্গ সাহেব মামলা জেতার জন্য মায়ের কাছে মানত করেন। তাঁর মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় এবং তিনি তিন হাজার (সেই আমলে) টাকার পুজো দিয়ে যান। পাঞ্জাব এবং বর্মা দখলের পর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে ষোড়শপচারে মায়ের পুজো দেওয়া হয়। মুসলমান ভক্তরাও প্রতি মাসে (প্রায় ৫০০জন) মায়ের মন্দিরে নিয়মিত পুজো দিয়ে যেতেন। কালীঘাটের কালীমাতার মাহাত্ম্যগুণে বহু মানুষ এখানে অনেক দান-ধ্যান করেছেন এবং বর্তমানেও সেই ধারাবাহিকতা চলে আসছে।

১) রাজা নবকৃষ্ণ ১৭৬৫ সালে মায়ের সোনার মুণ্ডমালাটি তৈরি করে দেন এবং সঙ্গে লক্ষাধিক টাকাও প্রদান করেন। পাতিয়ালার মহারাজাও মায়ের একটি মুণ্ডমালা (সোনার) তৈরি করে দিয়েছিলেন।

২) খিদিরপুরের গোকুলচন্দ্র ঘোষাল মায়ের চারটি হাত রূপোর করিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কালীচরণ মল্লিক সেই হাত সোনার করিয়ে দেন।

৩) মায়ের সোনার জিহ্বা গড়িয়ে দেন পাইকপাড়ার রাজা ইন্দ্রচন্দ্র সিংহ।

৪) দেবী মায়ের মাথার ছাতাটি দিয়েছিলেন নেপালের সেনাপতি জংবাহাদুর।

৫) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ‍্যোগে আদিগঙ্গার ঘাটটি বাঁধানো হয়েছিল।

৬) আন্দুলের জমিদার রাজা কাশীনাথ রায় 'নাটমন্দির'-টি তৈরি করান।

কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরটি ২০০ বছরেও বেশি পুরনো। এটি ১৮০৯ সালে সাবর্ণ রায়চৌধুরী জমিদার পরিবারের শিবদাস রায়চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল রায়চৌধুরী এবং ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরীর উদ‍্যোগে আদিগঙ্গার তিরে মন্দিরটি তৈরি হয়। হাটখোলার দত্ত পরিবারের কালীপ্রসাদ দত্ত এবং বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সন্তোষ রায়চৌধুরী মন্দিরটির সংস্কারসাধন করেছিলেন। মায়ের বর্তমান রূপ প্রদান করেন সন্ন্যাসী ব্রহ্মানন্দ গিরি ও আত্মারাম গিরি। কথিত আছে, এই আত্মারাম ব্রহ্মচারী এখানে মায়ের ধ্যান করছিলেন। এক রাতে ধ্যানে বসা অবস্থায় তিনি এক দেবীকণ্ঠ শুনতে পান। তিনি শুনতে পান, যে বেদিতে বসে তিনি ধ্যান করছেন সেটি ব্রহ্মবেদি। (ব্রহ্মবেদি, অর্থাৎ ব্রহ্মা যেখানে বসে দেবীর আরাধনা করতেন) তিনি দৈববাণী শুনতে পান যে, দেবীর অঙ্গ পাশের কালিন্দী হ্রদে (বর্তমানে এটি কুণ্ডপুকুর নামে পরিচিত) পড়ে আছে। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, নীলগিরি পর্বতে 'ব্রহ্মানন্দ গিরি' নামে একজন সাধক আছেন। তাঁর কাছে কষ্টিপাথরের যে শিলাস্তম্ভটি রয়েছে, তা যেন এই ব্রহ্মবেদিতে স্থাপন করা হয়। এরপর আত্মারাম নীলগিরি গিয়ে ব্রহ্মানন্দর সঙ্গে দেখা করেন এবং কোনও দৈববলে সেই ১২ হাত লম্বা এবং ২ হাত চওড়া শিলাকে কালীঘাটে নিয়ে আসেন এবং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে নাকি সেই শিলাকে মাতৃরূপ প্রদান করেন এবং সেই ব্রহ্মবেদির ওপর স্থাপন করেন। কিন্তু দেবীর খণ্ডিত চরণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপর একরাতে কালিন্দি হ্রদের ভেতর থেকে আলোকের বিচ্ছুরণ দুই সন্ন্যাসী দেখতে পান, এবং পরদিন সেখানে মায়ের চরণাংশ পাওয়া যায়। দিনটি ছিল স্নানযাত্রা। তাই স্নানযাত্রার দিন নিয়ম মেনে এখানে পুজোপার্বণ চলে।

কালীঘাট কালী মন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অভিনব রীতিতে নির্মিত। মূর্তিটির জিভ, দাঁত, মুকুট, হাত ও মুণ্ডমালাটি সোনার। মন্দিরের মধ্যে একটি সিন্দুকে সতীর প্রস্তুরীভূত অঙ্গটি সযত্নে রক্ষিত আছে। এটি কারও সম্মুখে বের করা হয় না। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান ছাড়াও সারা বছর ভক্তসমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে কালীঘাটের মায়ের মন্দির।

 

More Articles