কোরিয়ান বিউটির নেশায় বুঁদ ভারতীয়রা! কোরিয়ান ত্বকের নেপথ্যের আসল সত্য জানেন?
Korean Beauty Secrets : ভারতীয়দের আদৌ সম্ভব এমন চামড়া? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় হলে এমন গ্লাস স্কিন হওয়া প্রায় অসম্ভব।
প্রেমের জন্য মানুষ দেশ পার করে ফেলে, সীমান্ত মানে না। পাঁচিল মানে না, জলের পাইপ মানে না। কিন্তু ত্বকের জন্য? ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি হতে মানুষ কতটা পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত? দাগহীন, অতিরিক্ত উজ্জ্বল, নরম-কোমল ত্বক পেতে কি মানুষ এক দেশ থেকে অন্য দেশ চলে যায়? তারকারা যেতেই পারেন, বাকিরাও? চোখ ধাঁধানো এক পরিসংখ্যান বলছে বহু বহু মানুষ (বেশিরভাগই মহিলা) ঝিলিক মারা ত্বক পেতে দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল পাড়ি দেন। এই ত্বকের জন্যই কেবল সিওলে তিনগুণ বেড়েছে পর্যটন!
২০২১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় মোট ৯,৬৭,০০০ বিদেশি পর্যটক গিয়েছিলেন। এই সংখ্যা ২০২২ সালে বেড়ে হয় প্রায় ৩১,৯৮,০০০, অর্থাৎ তিনগুণ বৃদ্ধি পায় পর্যটকদের সংখ্যা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই বিপুল পর্যটক সমাগম অব্যাহত ছিল। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে অগাস্ট পর্যন্ত আনুমানিক ৬৫,০০,০০০ বিদেশি পর্যটক সেই দেশটিতে গিয়েছেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধির হার ছিল ২২৭.৩%। ১০,৯৪,০০০ জন বিদেশি পর্যটক কেবল এক মাসেই ভ্রমণ করেছিলেন দক্ষিণ কোরিয়া! কেন?
যেমন ভারত চিকিৎসা পর্যটনের জন্য পরিচিত এবং সারা বিশ্ব থেকে মানুষজন ইদানীং ভারতের চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে এবং চিকিৎসার জন্য ভারতে আসেন, ঠিক একইভাবে, দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বব্যাপী অন্যতম লোভনীয় পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে ত্বকের সৌন্দর্যের জন্য। 'কে-বিউটি সেক্টর' এই দেশের পর্যটনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুন- ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া দেশ আজ উন্নতির চূড়ায়! কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল দক্ষিণ কোরিয়া
হ্যালিউ বা কোরিয়ান ঢেউ
বেশ কয়েক বছর ধরেই কোরিয়া শিরোনামে। কে-ড্রামা, কে-বিউটি এবং কে-ফ্যাশনের মতো শব্দগুলিতে আজকাল সকলেই অভ্যস্ত। কিন্তু এসবের শুরুটা কোথা থেকে? ২০১২ সালে, মনে করে দেখুন, ভাইরাল হয়েছিল একটি গান ও নাচ, গ্যাংনাম-স্টাইল। সেই গানটিই কোরিয়ান ঢেউয়ের সূচনা।
হ্যালিউ নামে পরিচিত কে-পপ ঢেউ সবচেয়ে জনপ্রিয় হয় মহামারী চলাকালীন। লক্ষ লক্ষ মানুষ বুঁদ হয়েছিলেন কোরিয়ার গানে। সব ধরনের কে-ড্রামা দেখা, কে-পপ শোনার হিড়িক পড়েছিল। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে Netflix-এ কে-ড্রামার ভিউয়ারশিপ ৩৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই সাংস্কৃতিক ঢেউয়েই আরেকটি অংশ হিসেবে উঠে আসে 'গ্লাস স্কিন' শব্দটি। ১০ টি স্কিনকেয়ার রুটিন মেনে চলে নিখুঁত ত্বক পাওয়া এখন রীতিমতো আসক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার পপ তারকারা, যেমন BTS বা BLACKPINK এবং অভিনেতারা একটি নির্দিষ্ট সৌন্দর্য মান বজায় রেখে চলেন। এই মানগুলি একটি নির্দিষ্ট শরীরের ধরন এবং ত্বককে সামনে নিয়ে আসে যা আসলে একেবারে কাচের মতো। অবশ্যই এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এর একটি অন্ধকার দিকও আছে। দক্ষিণ কোরিয়াকে 'বিশ্বের আত্মহত্যার রাজধানী'-ও বলা হয় কারণ বহু কে-পপ তারকারাই এই নির্দিষ্ট সৌন্দর্যের মান মেনে না চলতে পেরে প্রচণ্ড চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছেন।
তাতে কীই বা এসে যায়! কাচের মতো ত্বক পেতে মানুষ তাতেও মরিয়া। মহিলারা কে-বিউটি প্রডাক্ট কিনছেন এবং কোরিয়ান বিউটি টিপস মেনে চলছেন। চাল ধোয়া জল থেকে শুরু করে শামুক, কী নেই সেই টিপসে৷ ২০২৩ সালের গুগল ট্রেন্ডস অনুসারে, গ্লাস স্কিন গত বছরের সেরা পাঁচ বিউটি ট্রেন্ডের মধ্যে ছিল। অনেক মানুষই এমন ত্বক পেতে প্রয়োজনীয় চিকিত্সার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় যান।
View this post on Instagram
লস অ্যাঞ্জেলেসের ডিজিটাল কন্টেন্ট নির্মাতা রজার এমনই স্বচ্ছ, কাচের মতো ত্বক পেতে দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়েছিলেন। 'Ulthera' (মুখ ও ঘাড়ের ত্বক শক্ত করার জন্য ব্যবহৃত নন-সার্জিক্যাল প্রসাধনী চিকিত্সা) এবং 'Potenza' (অতি-সূক্ষ্ম সূঁচ ব্যবহার করে ত্বকের বাইরের স্তর ভেদ করতে রেডিওফ্রিকোয়েন্সি শক্তি ব্যবহার করে) ব্যবহার করেন তিনি।
"কোরিয়ান অভিনেত্রীদের মতো গ্লাস স্কিন চান?” দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লারগুলিও সাধারণত ক্যাপশন এবং থিম ব্যবহার করে এসবই। ভারতীয়দের আদৌ সম্ভব এমন চামড়া? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় হলে এমন গ্লাস স্কিন হওয়া প্রায় অসম্ভব। বাজারে প্রচলিত একটি জোকস আছে, যদি কোরিয়ানদের মতো ত্বক চান তবে আপনার দক্ষিণ কোরিয়ান বাবা মা থাকতে হবে৷ কথাটা সত্যিই ভুল নয়। ভারতের বহু চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা বর্তমানে এমন গুচ্ছ গুচ্চ রোগী পাচ্ছেন যারা যারা দক্ষিণ কোরিয়ার মডেল বা গায়কের ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করছেন, "আমার এমন চামড়া হবে?” হবে না। কেন?
View this post on Instagram
দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের ত্বকে পিগমেন্টেশন হয় না। এটি তাদের জিনের মধ্যেই আছে। ভারতীয়দের ত্বকে বেশি পরিমাণ মেলানিনের উপস্থিতির কারণে হাইপারপিগমেন্টেশন এবং ছিদ্রের প্রবণতা বেশি। দক্ষিণ কোরিয়াতে খুব কম স্থূল মানুষ মেলে। দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষজন তাদের জীবনযাত্রা এবং ডায়েটকে খুব গুরুত্ব দিয়ে মেনে চলে। এটি ত্বকের উপর তাই ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মেও বাহিত হয়। চিকিৎসা করালে একেবারেই কোনও লাভ হবে না তা নয়। তেমন যোগ্য চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ পেলে ত্বকের উন্নতি হবেই। কিন্তু অবাস্তব কিছু প্রত্যাশা করলে সে গুড়ে বালি!
সোশ্যাল মিডিয়া নিমেষে বহু কিছু ভাইরাল করে ফেলে। বাড়ির পাশের ক্যাফে হোক বা আস্ত কোনও দেশ। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে ও ঘটানো হয়েছে। সৌন্দর্য চিকিত্সার জন্য কোরিয়ার প্রতি মানুষের এই আকর্ষণের নেপথ্যে অবশ্যই রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এই সৌন্দর্য চিকিত্সা জনপ্রিয়তা অর্জনের আরেকটি কারণ কোরিয়ানদের ক্রয়ক্ষমতা। দক্ষিণ কোরিয়াতে, ফেসিয়াল এবং চিকিত্সার গড় খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কম। কেন?
View this post on Instagram
আরও পড়ুন- রাতারাতি কমে গেল দেশের সমস্ত নাগরিকের বয়স! যে ম্যাজিক ঘটাল দক্ষিণ কোরিয়া
এখানে টাকার মূল্য কম (ভারতের ১ টাকা মানে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ১৫ ওন)। দক্ষিণ কোরিয়ায় পার্লারগুলিতে খরচা তাই তুলমানূলভাবে কম। ধরুন স্পেশ্যাল কোরিয়ান ফেসিয়াল করাবেন। ভারতে খরচা হবে প্রায় ১০,০০০ টাকা। দক্ষিণ কোরিয়ায় মাত্র ৩,৫০০ টাকা। দক্ষিণ কোরিয়ার কিছু বিশেষ সৌন্দর্য চিকিত্সা বা পরিষেবা রয়েছে যা কেবল সেখানেই পাওয়া যায়। যেমন আপনার ত্বকের জন্য নির্দিষ্ট রঙ বিশ্লেষণ। ধরুন আপনি বুঝতে পারছেন না আপনার জন্য কোন রঙ এবং গয়না উপযুক্ত। সিওলে এমন বহু কালারভ অ্যানালিসিস স্টুডিও রয়েছে যারা আপনাকে সাহায্য করতে পারে৷ সেখানে আপনার দেহের রঙের সবচেয়ে উপযুক্ত পোশাক, মেকআপ, নেলপলিশ এবং চুলের রঙ বেছে দেওয়া হবে। খরচা আনুমানিক ৮,০০০ টাকা।
চুলের জন্য স্পা করাতে চাইলে এখানে ১৫ টি ধাপে স্ক্যাল্পের চিকিত্সা করা হয়। মাইক্রোস্কোপিক স্ক্যাল্প রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে LED স্কেলিং এবং ঘাড়ের ম্যাসাজ পর্যন্ত, এই ১৫ টি ধাপের স্পা করাতে খরচা হবে আনুমানিক ৭,০০০ টাকা।
View this post on Instagram
বা ধরুন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে আপনার ত্বকের ধরন জানতে চান। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল যন্ত্রগুলি। যা অত্যন্ত বিস্তারিত স্তরে আপনার ত্বকের শক্তি এবং সমস্যাগুলি শনাক্ত করতে এবং রোগ নির্ণয় করতে সাহায্য করে৷ এটি করাতে আপনার খরচা হবে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
ফাউন্ডেশন ম্যাচ হয় না কিছুতেই? ল্যানেইজ কোরিয়া আপনাকে আপনার সঠিক ফাউন্ডেশন শেড খুঁজে দেবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং AI ব্যবহার করে। প্রক্রিয়াটি মজার তো বটেই, আপনার চামড়ার সঙ্গে নিখুঁত মিল খুঁজে পেতে ১৫০টি শেডও পাবেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ভারতীয় পর্যটকদের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। কোরিয়ান পর্যটন বিভাগের তথ্য বলছে, কোরিয়ায় ভারতীয় পর্যটকদের সংখ্যা ২০২৩ সালের জুনের মাসেই ৪৯,৫৮০ জনের কাছাকাছি।