জাভেদ আখতারের আমন্ত্রণ বাতিল: উদারপন্থীদের নীরবতায় মৌলবাদের উত্থান
Koushik Sen: আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ তত্ত্বে বিশ্বাস করি। যেমন ‘ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার’, ‘তোমার ধর্ম তুমি পালন করো’ এটা করতে গিয়েই সর্বনাশ হয়ে গেছে।
জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান বাতিল করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার হিন্দু মতবাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি এবং তাদের তাত্বিক মাথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘকে বাড়তি সুবিধা করে দিল। এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা ব্যর্থতা। জাভেদ আখতারের মতো একজন নাস্তিক এবং বুদ্ধিজীবী, প্রথিতযশা কবি, যিনি সাংঘাতিকভাবে হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধেও কথা বলেন। তাঁর মতো একজন মানুষকে শুধুমাত্র কিছু কট্টর মুসলিম সংগঠন ফতোয়া জারি করল আর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারও মেনে নিল, তা একেবারেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী।
আমার বিশ্বাস এমন বহু মানুষ আছেন, যারা এটার নিন্দা করছেন। এই বিষয়টা নিয়ে গভীরে গিয়ে আলোচনা করার, ভাবার প্রয়োজন আছে। ১৩৬৩ বঙ্গাব্দে শ্রাবণ মাসের সংখ্যায় ‘পরিচয়’ পত্রিকায় সমর সেন লিখেছিলেন, ‘উদারপন্থীদের মধ্যে সমস্যা আছে।’ ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ফ্যাসিবাদকে চিনতেও কিন্তু উদারপন্থীদের অনেকটা দেরি হয়েছিল।
আরও পড়ুন- মুক্তমনা বলেই বাতিল করতে হলো জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান?
কিছুদিন আগে পর্যন্তও বাঙালি নিজেদের কমিউনিস্ট বলে পরিচয় দিতে শ্লাঘা বোধ করত— আমরা যে বামপন্থী, বামমনস্ক, আমাদের বাংলাতে যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে, তার মধ্যে বামনীতি আছে এটা জাহির করতে বাঙালি ভালোবাসে। যদিও সেখান থেকে বাঙালি অনেকটাই সরে এসেছে। কারণ বাঙালি সমাজে সিপিএম চর্চা হয়েছে। ৩৪ বছর বাংলায় সিপিএম ক্ষমতায় ছিল বলে, বাঙালি সমাজে সিপিএম ঢুকে গেছে। কিন্তু সত্যিকারের কমিনিস্ট হওয়া খুব কঠিন কাজ।
১৯৭৭-এর মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র বলেছিলেন, “আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট।” তখন তাঁর কথায় খুব হৈচৈ হয়েছিল। অনেকেই তাঁর কথায় ভুল বুঝেছিলেন। কিন্তু তিনি যেটা বলতে চেয়েছিলেন, ভদ্রলোকের সঙ্গে কমিউনিস্টের একটা পার্থক্য আছে। কমিউনিস্ট হচ্ছে সে, যার শৌখিন ভদ্রলোকিপনাটা আসে না। আমরা ইউরোপেও দেখেছি উদারপন্থীরা সেভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধাচারণ করতে পারেনি, বলা ভালো তাঁরা চিনতেই পারেনি।
উদারপন্থী তত্ত্ব আসলে গরিবদের বিরুদ্ধেই যায়। এটা ক্ষমতাবানদেরই ক্ষমতাপুক্ত করে। আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ তত্ত্বে বিশ্বাস করি। যেমন ‘ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার’, ‘তোমার ধর্ম তুমি পালন করো’ এটা করতে গিয়েই সর্বনাশ হয়ে গেছে। এবং সরকারও ঠিক করে নিয়েছে সে সবাইকে তোল্লাই দেবে। চাকরির যোগান, শিশুর চিকিৎসা প্রদান না করতে পারলেও ধর্ম পালনের ব্যবস্থা করে দিয়ে সরকার বলতে চায় ‘আমি তোমার পাশে আছি’। চিকিৎসার জন্য একটা হাসপাতাল থেকে আরেকটা হাসপাতালে ছুটতে হলেও ছটপুজো তো করতে দিচ্ছি, রাস্তা ব্লক করে মহরম বা প্যান্ডেল বেঁধে পুজো, এই প্রশ্রয়টা রাষ্ট্র দিতে পারছে আমাদের মতো উদারপন্থীদের জন্যই। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, ধর্মতে হাত দিও না। ফলে আমাদের দেশে যারা কট্টরপন্থী। সেটা হিন্দু মৌলবাদী হোক বা মুসলিম মৌলবাদী, এই সুযোগটা পুরো উদ্যমে নিচ্ছে। তাই এই পরিস্থিতির জন্য শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করতে পারছি না। এটা আমরা যারা নিজেদের উদারপন্থী বলি, তাদেরই সমস্যা।
আরও পড়ুন- সংখ্যার রাজনীতিতে জাভেদ আখতাররাই চিরশত্রু
গরিব মানুষের কাছে ধর্ম একটা বড় আশ্রয়, সরকার চায় তারা ওটা নিয়েই থাক। আর আমলাদের ছেলে-মেয়েরা বিদেশ যাক। গরিব মানুষের চাকরির দরকার নেই, তারা পুজো করবে আর কোনো প্রশ্ন করবে না। এই যে একটা ফাঁদ পাতা হয়েছে, এটার জন্য শুধু রাষ্ট্র দায়ী নয়। ১৮৩১ সালে ইন্ডিয়া গেজেটে একটা রিপোর্ট বের হয় সে যুগের অতিবিপ্লবী সংস্কারকদের নিয়ে। পরে এদেরই নাম দেওয়া হয়েছিল ইয়ং বেঙ্গল। যারা হেনরি ডিরোজিও, হিন্দু কলেজের ছাত্রছাত্রী ছিল। রোসিঙ্কা চৌধুরী-এর লেখা India's First Radicals: Young Bengal and the British Empire বইয়ে তাঁদের নিয়ে লেখা হয়েছে।
উনিশ শতকের প্রথমের দিকে এই ইয়ং বেঙ্গলদের দেখা পাওয়া গিয়েছিল। তার আগে পিপল অফ ইন্ডিয়া কনসেপ্টটা ছিল না। অর্থাৎ সাধারণ গরিব মানুষও যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তারাও যে মানুষ, তাদের আইন, জীবন-জীবিকা, ভাবনা-চিন্তা, সমস্ত কিছুর অধিকারের কথা ইয়ং বেঙ্গল র্যাডিক্যালরাই প্রথম তুলে ধরেছিল। সেখান থেকেই ভারতে উদারপন্থার শুরু।
আধুনিক ভারত তৈরিতে ইয়ং বেঙ্গলের বড় অবদান ছিল এবং তার মধ্যে বড় পদক্ষেপ ছিল ধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সেই কারণেই ওটা একটা বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড ছিল। কিন্তু আমরা যেন পিছিয়ে গেলাম। যখন সাধারণ মানুষের কণ্ঠ এই ধারণাটাই ছিল না। এই বাংলাতেই এত বড় আন্দোলন হয়েছে, ধর্মের বিরুদ্ধে স্পষ্ট করে কথা বলা, জাতপাতের বিরুদ্ধে কথা বলা— এগুলি এরাই করেছে। তাই জাভেদ আখতারের অনুষ্ঠান বাতিল প্রসঙ্গে একটু গভীরভাবে আলোচনা হওয়া দরকার। রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার তো আমাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেই, কিন্তু আমরাও আমাদের দায়িত্বটা সঠিভাবে পালন করছি না। তাই বর্তমানে ইয়ং বেঙ্গলর মতো একটা আন্দোলনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
Whatsapp
