পেয়েছিলেন অন্নপূর্ণার স্বপ্নাদেশ, ইংরেজদের প্রিয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর জীবন ছিল বর্ণময়

নদিয়ার রাজবংশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজা মানসিংহের নাম। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিহারের সুবেদার নিযুক্ত হন। ১৫৯০ সালে মানসিংহকে 'রাজা' খেতাব এবং পাঁচহাজারি মনসব প্রদান করা হয়। তিনি ১৫৯৪ সালের ১৭ মার্চ থেকে ১৬০৬ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৫৯৬ সালে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম, প্রতাপাদিত্য ভূঁইয়ার সঙ্গে রাজা মানসিংহের যুদ্ধ হয়।

নদিয়ার রাজপরিবারকে নবদ্বীপ-রাজবংশ বলে অভিহিত করা হয়। কারণ কৃষ্ণনগর ছিল রাজ্যের একটি অগ্রগণ্য নগর। নবদ্বীপ ছিল একটি প্রতিনিধিস্থানীয় জনপদ। এখানকার পণ্ডিতদের মেধা তৎকালে গগন স্পর্শ করেছিল। রাজপরিবার এই পণ্ডিতদের আলাদা মর্যাদায় ভূষিত করতেন, এই পণ্ডিতমহল রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে (অষ্টম রাজা, ১৬৯৪) 'নবদ্বীপাধিপতি' উপাধি প্রদান করেন। এই কারণে রাজপরিবারকে নবদ্বীপ রাজবংশ বলা হয়।

ভবানন্দ মজুমদার

ভবানন্দ মজুমদার (তাঁর পূর্ব নাম ছিল 'দুর্গাদাস সমাদ্দার') বাংলা জয়ের সময় মানসিংহর সহায়তা করেন। এই কারণে তৎকালীন বাদশা জাহাঙ্গির খুশি হয়ে ভবানন্দকে মহৎপুর, নদিয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর বয়শা, মশুন্ডা প্রভৃতি ১৪টি পরগণা সনন্দসূত্রে দেন। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে, তাঁর স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে 'কানুনগো' (কানুনগুঁই) পদে নিযুক্ত করেন। তখন তিনি 'মজুমদার' উপাধিতে ভূষিত হন। ১৬৩১ সালে ভবানন্দ সম্রাটের কাছ থেকে ফরমানের মাধ্যমে সুবৃহৎ জমিদারি লাভ করেন এবং জমিদার হন। নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারিতে তিনি রাজধানীতে স্থাপন করেন।

আরও পড়ুন: নবাবকে মুখ ভেংচে এসেছিলেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে! দেশপ্রেমিক গোপাল ভাঁড়ের গল্প

নদিয়ার রাজবংশের তালিকা:

  • ভবানন্দ মজুমদার (১৬০৬-১৬২৮)
  • গোপাল রায় (১৬২৮-১৬৩২)
  • রাঘব রায় (১৬৩২-১৬৮৩)
  • রুদ্র রায় (১৬৮৩-১৬৯৪)
  • রামকৃষ্ণ রায় (১৬৯৪)
  • রামজীবন রায় (১৬৯৪-১৭১৫)
  • রঘুরাম রায় (১৭১৫-১৭২৮)
  • কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭২৮-১৭৮২)
  • শিবচন্দ্র রায় (১৭৮২-১৭৮৮)
  • ঈশ্বরচন্দ্র রায় (১৭৮৮-১৮০২)
  • গিরীজচন্দ্র রায় (১৮০২-১৮৪২)
  • শ্রীশচন্দ্র রায় (১৮৪২-১৮৫৬)
  • সতীশচন্দ্র রায় (১৮৫৬-১৮৭০)

রাঘব রায়

রাঘব রায় তাঁর রাজত্বকালে পানীয় জলের জন্য দিগনগরে একটি বৃহৎ দীঘি নির্মাণ করান। ২০,০০০ টাকা ব্যয় করে ১৪২৩ হাত চওড়া ও ৪২০ হাত লম্বা দীঘিটি তৈরি করেন তিনি। দীঘিটির পূর্বদিকে ছিল সুবৃহৎ ঘাট, সুরম্য অট্টালিকা ও দু'টি মন্দির, সুনিপুণ পোড়ামাটির কারুকার্যমণ্ডিত। ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাঘবেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি রাজরাজেশ্বর, রাজ্ঞীশ্বর ও রামচন্দ্র নামে তিনটি মন্দির স্থাপন করেন।মাটিয়ারীতে তিনি নিজ পুত্র রুদ্র রায়ের নামানুসারে 'রুদ্রেশ্বর শিবমন্দির' স্থাপন করেন।

‌রুদ্র রায়

মহারাজা রুদ্র রায় রাজা হওয়ার পর রাজধানী নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের নিকট জনপদ 'রেউই' গ্রামে স্থানান্তরিত করেন, কারণ এই গ্রামটি ছিল নদিয়ার মধ্যবর্তী স্থান। রেউই-এর নামকরণ করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে 'কৃষ্ণনগর'। রুদ্র রায় ছিলেন পরাক্রমশালী রাজা। তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন। তখন নবাব ছিলেন ঔরঙ্গজেব। তিনি রুদ্র রায়ের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে গয়েশপুর, হোসেনপুর, খাড়ি, জুড়ি ইত্যাদি কয়েকটি পরগণা দান করেন। সম্রাটের সহায়তায় মহারাজা কাছারিবাড়ি, কেল্লা, পুজোর দালান, নাচঘর, চক, নহবতখানা প্রভৃতি নির্মাণ করেন।

কৃষ্ণচন্দ্র রায়

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩) ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। কৃষ্ণনগরেই তাঁর জন্ম। পিতা ছিলেন রাজা রঘুরাম রায়। বাংলা ছাড়া সংস্কৃত ও ফরাসি ভাষায় সমান ব্যুৎপত্তি ছিল। অস্ত্রবিদ্যায় ছিলেন সুনিপুণ। সংগীতের প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। তিনি নিজেও একজন সংগীতবিশারদ ছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি। তাঁর শাসনকালে বাংলায় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হয়। এই সময় মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ইংরেজ রাজত্ব কায়েম হয়। তিনি নিজের রাজ্য সুরক্ষিত রাখতে ক্লাইভের সঙ্গে মিত্রতা করেন। কিন্তু নবাব সিরাজউদদৌল্লার পতনের পর মিরকাশেম তাঁকে বন্দি করেন এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। কিন্তু ক্লাইভের পক্ষপাতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং 'মহারাজা' উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এতদ্ভিন্ন ক্লাইভ তাঁকে উপঢৌকন হিসাবে পাঁচটি কামান দান করেন।

কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন সাহিত্যপ্রেমিক‌। তিনি গুণীর সমাদর করতেন।কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ দরবারেও 'নবরত্ন'-এর সমাহার ছিল। এই 'নবরত্নগণ' হলেন:


১) সভাকবি ভারতচন্দ্র
২) হরিনাম তর্কসিদ্ধান্ত
৩) কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি
৪) বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার
৫) আয়ুর্বেদাচার্য গোবিন্দরাম (রাজবৈদ্য)
৬) অনুকূল বাচস্পতি (রাজজ্যেতিষী)
৭) পুরাণবিশারদ পণ্ডিত গদাধর তর্কালঙ্কার
৮) সংস্কৃতজ্ঞ কালিদাস সিদ্ধান্ত ও কন্দর্প সিদ্ধান্ত
৯) বিদূষক (গোপাল ভাঁড়)

এছাড়া তাঁর সভা অলংকৃত করতেন সাধক রামপ্রসাদ সেন।মধ্যযুগের অন্যতম বিখ্যাত কবি 'ভারতচন্দ্র' ছিলেন তাঁর সভাকবি। এছাড়া নবরত্নের অন্যতম বিশিষ্ট পন্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হরিনাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ তাঁর সভা আলোকিত করে রাখতেন। হাস্যরসিক গোপাল ভাঁড় ছিলেন তাঁর বিদূষক।

কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্র, আঠারো শতকের মধ্যভাগে তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য 'অন্নদামঙ্গল' রচনা করেন। জনশ্রুতি শোনা যায় যে, দেবী অন্নপূর্ণা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে স্বপ্নাদেশ দেন। সেই অনুসারে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র তখন ভারতচন্দ্রকে আদেশ দেন দেবী অন্নপূর্নার মাহাত্ম্যসূচক কাব্যটি রচনা করার জন্য। এই কাব্যটি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রতিটি খণ্ডে দেবীর মাহাত্ম্যের সঙ্গে রাজপরিবারের ইতিবৃত্ত বর্ননা করা আছে। কৃষ্ণনগরের রাজপরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের ইতিহাস, মানসিংহ কর্তৃক প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করার কাহিনি এবং দেবী অন্নদার মহিমা বর্ণিত হয়েছে।

কৃষ্ণচন্দ্র একাধারে সাহিত্যিক ও সংগীতপ্রেমী ছিলেন। তিনি গুণীর সমাদর করতেন। সাধক রামপ্রসাদ সেনকে তিনি প্রথমে মাসোহারা এবং পরে নিষ্কর জমি প্রদান করেন। নবদ্বীপ-সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতচর্চায় কৃষ্ণচন্দ্রের বিশেষ উৎসাহ ছিল। তিনি নদিয়ায় বেশ কিছু টোল-চতুষ্পাঠী স্থাপন করে দেন। সংস্কৃতচর্চার প্রভূত উন্নতি সাধনের জন্য তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন, নদিয়া থেকে অনেক দূরবর্তী স্থানের পণ্ডিতরাও তাঁর অর্থানুকূল্য ভোগ করতেন। সুদূর বিক্রমপুর ও বাকলার পণ্ডিতরাও মহারাজের আনুকূল্যে ছিলেন বলে জানা যায়। সংস্কৃত বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য নদিয়ায় আগত বিদেশি ছাত্রদের জন্য তিনি মাসে মাসে দুশো টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। টোল-চতুষ্পাঠীগুলোর জন্য নিষ্কর জমি প্রদান করেন। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রী রানি ভবানীও ছিলেন সে যুগের একজন সংস্কৃতচর্চার পৃষ্ঠপোষক।

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকাল ছিল নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ। তিনি বর্গী আক্রমণ ঠেকাতে রাজধানী 'শিবনিবাস' নামক স্থানে স্থানান্তরিত করেন। তাঁরই রাজত্বকালে হয় বাংলার রাজনীতির পট পরিবর্তন অর্থাৎ পলাশির যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, বর্গী আক্রমণ ইত্যাদি। সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কৃষ্ণচন্দ্রকে প্রথমে 'মহারাজা' এবং পরে 'মহারাজেন্দ্র বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করেন।কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পূর্ণ রাজ-উপাধিটি ছিল রাজসিক- "অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী শ্রীমন মহারাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায়"।

কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের আমলেই নদিয়ায় সর্বাধিক উন্নতি লাভ হয়।স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে তিনি কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন।এখনও কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো সমানভাবে সমাদৃত। তবে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্মরণীয় হয়ে আছেন, যোদ্ধার সাজে মৃন্ময়ী মূর্তি, যা রাজরাজেশ্বরী নামে খ্যাত। কৃষ্ণনগরের রাসযাত্রা এবং এই রাজরাজেশ্বরী পুজোর জাঁকজমক এখনও বর্তমান।

১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ বৎসর বয়সে মহারাজা অমৃতলোকে যাত্রা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠা রানির পুত্র শিবচন্দ্র রায় সিংহাসনে বসেন।

পলাশির যুদ্ধের সময় লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজের বিরোধিতা করার জন্য অনেকে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে 'বেইমান' বলেন। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে, তিনি অত্যন্ত প্রজাবৎসল, ধার্মিক, সাহিত্য ও সংগীতপ্রেমী, ন্যায়পরায়ণ রাজা ছিলেন। তিনি গুণীর সমাদর করতেন। তাঁর আমলে নদিয়ার প্রভূত উন্নতি হয়।

 

More Articles