দুধের শিশুর শরীরে বিষ হয়ে ঢুকছে দুধ! জানেন কী বিপদ ডেকে আনছেন
Lactose Intolerance: দুধ যথেষ্ট কম মাত্রায় খাওয়া প্রয়োজন, তবেই তা পুষ্টি বৃদ্ধি করে।
"দুধ না খেলে, হবে না ভালো ছেলে," চন্দ্রবিন্দুর গানের এই পংক্তি ছিল সকলের জানা। ভারতীয় পরিবারে ঘি, বাটার, পনির, দই ও ক্রিম খাওয়া হবে না- এমনটা হতেই পারে না। আমরা সকলেই দৈনন্দিক জীবনে এইসব খাদ্যদ্রব্য আমাদের খাবারের উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়ে থাকি। আর এই সমস্ত খাদ্যদ্রব্যই দুগ্ধশিল্প, অর্থাৎ ডেয়ারি ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে পড়ে। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই কম-বেশি দুগ্ধজাত দ্রব্য পাওয়া যায়। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন যে, দুগ্ধজাত দ্রব্য আমাদের দেশেই কেন এত প্রচলিত। এটি কি আদতেই আমাদের জন্য উপকারী, না কি শ্বেত বিপ্লবের ফলাফল, যার প্রভাব এখনও শেষ হয়নি?
ভারতের কৃষিব্যবস্থায় দুগ্ধশিল্প সবচেয়ে বড় শিল্প। এছাড়াও এই শিল্প দ্বারা আগত মুনাফার সিংহভাগটাই ভারতীয় অর্থনীতিতে যোগ হয়। দেশের অর্থনীতির প্রায় ৪%-ই আসে দুগ্ধশিল্প থেকে। গোটা পৃথিবীতে ভারতে দুগ্ধশিল্পের হার সবচেয়ে বেশি। ২০১৮-'১৯ সালে কেবল ভারত থেকেই ১১৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন দুধ উৎপাদন হয়। এর সবচেয়ে বড় কারণ লুকিয়ে আছে হিন্দু পুরাণে। কারণ, ভারতে দুধ কেবলই একটি পানীয় নয়, যে আমরা সকালবেলায় উঠে কোনও খাদ্যদ্রব্যর সঙ্গে মিশিয়ে খেয়ে নিলাম। হিন্দু পুরাণেও দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যর বিশেষ উল্লেখ আছে।
আরও পড়ুন: কুখ্যাত ২২ অক্টোবরের স্মৃতি আজও দগদগে! কোনও দিন কি ফুরোবে কাশ্মীরের ‘কালো অধ্যায়’?
সমুদ্রমন্থনে যখন অমৃত পাওয়ার জন্য যখন দেবতাদের মধ্যে প্রতিস্পর্ধা চলছিল, সেই সময়ে দেবী কামধেনুর আবির্ভাব হয় গোমাতা-রূপে। এছাড়া শ্রীকৃষ্ণর ছোটবেলার নানা গল্পের খণ্ডে আমরা দই ও মাখনের উল্লেখ পেয়ে থাকি। আর সে পালিত হয়েছিল একজন গোয়ালার ঘরে, তাই এই হিন্দুরাজ্যে গরু ও দুগ্ধ অত্যন্ত পূজনীয় সাধারণ মানুষের কাছে। সেই কারণে ভারতে দুধের গুরুত্ব অনেক বেশি।
পৌরাণিক ইতিহাস ছাড়াও এই খাদ্যদ্রব্যের অনেক পুষ্টিগুণ আছে। যেমন হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে সাহায্য করে, এছাড়া শক্তি জোগায় ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কিন্তু এত পুষ্টি থাকা সত্ত্বেও দুধ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। এমন অনেক গবেষণায় পাওয়া গেছে, যেখানে বলা হয়েছে দুধ মোটেই আমাদের শরীরের জন্য উপকারী নয়। উপরন্তু এটি আমাদের শরীরে আরও খারাপ প্রভাব ফেলে।
এই বিষয়টি সবার প্রথম সামনে আনেন হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটির পুষ্টিবিদ মার্ক হেগস্টেড ১৯৫১ সালে। ছোট থেকেই তিনি আইদাহের একটি ছোট ডেয়ারি ফার্মে পালিত হয়েছেন। ফার্মে থাকাকালীন তিনি দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের উপকারিতা সমন্ধে অনেক কিছু শুনেছিলেন। কিন্তু পুষ্টিবিদ্যা (নিউট্রিশন) পড়ার সময়ে তিনি জানতে পারলেন, এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে দুধ পাওয়া যায় না, পাওয়া গেলেও তার পরিমাণ অত্যন্ত কম। সেইসব দেশে আবার মানুষ বৃদ্ধ অবস্থায় অনেক বেশি সুস্থসবল থাকত বাকি দেশগুলোর তুলনায়। মার্ক হেগস্টেড তখন পরীক্ষানিরীক্ষা চালু করলেন যে, দুধ কি আদৌ প্রয়োজনীয় আমাদের জন্য! যদি প্রয়োজনীয় হয়, তবে কত মাত্রায় তা আমাদের পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয়।
এই বিষয়ে আরও গবেষণা করতে তিনি হাজির হলেন পেরুর এক অখ্যাত জেলে, যেখানে অপরাধীদের কেবলই ভাত ও বিনস দেওয়া হতো খাওয়া হিসেবে, এবং তাঁদের সারা সপ্তাহে কেবল একবার দুধ খেতে দেওয়া হতো। হেগস্টেড সেই জেল থেকে দশ জন কয়েদিকে বেছে নিলেন এবং নিজের পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন। সেই পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন যে, কোনও মানুষ সারাদিনে কেবল মাত্র ১২৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে, যা প্রায় হাফ গ্লাস দুধের সমান। পরে যখন তিনি সেই ১০ জন ব্যক্তির নিউট্রিশন টেস্ট করেন, তাঁদের ফলাফল একদম স্বাভাবিক এল। অর্থাৎ, দুধ যথেষ্ট কম মাত্রায় খাওয়া প্রয়োজন, তবেই তা পুষ্টি বৃদ্ধি করে। হেগস্টেডের এই পরীক্ষা আলোড়ন এনেছিল পুষ্টিবিদ্যায়।
এই পরীক্ষাটি করা হয় ১৯৫১ সালে, কিন্তু তারপরেও বাজারে বিভিন্নরকম পানীয় দ্রব্য আসে। বাজারে এতরকম পানীয় দ্রব্য আসার পরেও দুধের চাহিদা কমে না। আর এমন হওয়ার বিশেষ কারণও ছিল, কারণ দুধ ছিল একদিকে সস্তা ও অন্যদিকে পুষ্টিকর। তা পান করেই অনেক বাচ্চাদের রিকেট রোগ সেরে যেত কারণ এর প্রধান উপাদান ছিল ক্যালসিয়াম। বাচ্চাদের জন্য যে দুধের কোনও বিকল্প নেই, তার পরিচয় তো অনেকবার পাওয়া গেছে, কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও কি দুধ এতটাই উপকারী!
ওয়াল্টার উইলেটকো নামে একজন পুষ্টিবিদ ছিলেন। তিনিও হেগস্টেডের মতো একটি ডেয়ারি ফার্মে বড় হয়েছেন। কিন্তু তাঁর গবেষণা দ্বারা তিনি এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, যেসব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি নিজের দৈনন্দিক জীবনে অনেক বেশিমাত্রায় দুধ অথবা দুগ্ধজাত দ্রব্য গ্রহণ করেন, তাঁরাই পরবর্তীতে বেশিরভাগ অসুস্থতার শিকার হন। এ-বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখে উইলেটকো এবং তার টিম জানতে পারেন যে, দুগ্ধজাত দ্রব্যে ক্যালশিয়াম ছাড়াও অন্যান্য পুষ্টি-উপাদান বেশিমাত্রায় থাকার কারণে এমন শারীরিক অসুস্থতা দেখতে পাওয়া যায়।
এই বিষয়ে গবেষণা করতে করতে, উইলেটকো-র পর্যবেক্ষণে কিছু ভয়ানক বিষয় উঠে আসে। তার গবেষণা অনুসারে যে মহিলারা দিনে দুইয়ের বেশি গ্লাস দুধ খায়, তাঁদের হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি থাকে। এবং যেসব পুরুষ দিনে দুই গ্লাসের বেশি দুধ খেয়ে থাকেন তাঁদের ক্যানসার হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। এছাড়া দুধের মধ্যে ল্যাক্টোজ নামক একটি মিষ্ট পদার্থ থাকে, যা সহজে হজম করা যায় না। আর যে-সকল ব্যক্তি একেবারেই ল্যাক্টোজ হজম করতে পারেন না, তাঁদের দুগ্ধজাত পদার্থ খেলে ডায়েরিয়া পর্যন্ত হতে পারে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ল্যাক্টোজ হজম করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে।