আঘাত করলে লাগত দু'জনেরই, আজও কাঁদায় লায়লা-মজনুর প্রেমকাহিনি

লায়লা-মজনু প্রেমকাহিনি আবিশ্ব পরিচিত। এই কাহিনির মূল উৎস আরবি লোকগাথা। কেউ কেউ বলেন, এর ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে। তবে সেই মতের পক্ষে তেমন একটা জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

আমির পুত্র কয়েস বাল্যকালে বণিক-কন্যা লায়লার প্রেমে পড়ে মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেন। তখনই তিনি 'মজনু' বা 'পাগল' নামে পরিচিত হন। লায়লাও মজনুর প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন। কিন্তু উভয়ের বিবাহে আসে বাধা। ফলে মজনু পাগল হয়ে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। অন্যদিকে লায়লার অন্যত্র বিয়ে হলেও তাঁর মন ঘিরে থাকেন মজনু। তাঁদের দীর্ঘ বিরহজীবনের অবসান ঘটে করুণ মৃত্যুর মাধ্যমে। এই মর্মস্পর্শী বেদনাময় কাহিনি অবলম্বনেই লায়লা-মজনু কাব্য রচিত।

শোনা যায়, লায়লা-মজনু সপ্তম শতাব্দীর নাজদি বেদুইন কবি কায়েস ইবনে আল-মুলাওয়া এবং তাঁর প্রেমিকা লায়লা বিনতে মাহদি-র প্রেমকাহিনি-নির্ভর প্রাচীন আরব্য লোকগাথা। এই কাহিনি পরবর্তীতে ফারসিকবি নিজামি গানজাবি-র পঞ্চকাহিনিযুক্ত আখ্যান কাব্যগ্রন্থ 'খামসা'-র (পাঁচ) তৃতীয় খণ্ডে স্থান পায়। পরবর্তীতে প্রেম-সম্পর্কিত কাব্য হিসেবে এটি প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন একে মধ্যপ্রাচ্যের রোমিও-জুলিয়েট বলে আখ্যায়িত করেন। দৌলত উজির বাহরাম খান বিরচিত লায়লা-মজনু কাব্য রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান কাব্যধারায় একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে স্থান পেয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র মতে, লায়লা-মজনু কাব্যের রচনাকাল ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দ। কবি দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত লায়লা-মজনু কাব্য, পার্সি তথা ইরানি কবি জামির-এর লায়লা-মজনু নামক কাব্যের ভাবানুবাদ।

আরও পড়ুন: অন্য ধর্মে প্রেম, উদ্ধার হওয়া নরকঙ্কাল || অভিশপ্ত চিহ্ন বহন করছে এই জেলা


লায়লা ও মজনু আমাদের দেশে সবচেয়ে আলোচিত প্রেমকাহিনি। যদিও কালজয়ী এই প্রেমকাহিনির সত্যাসত্য নিরূপণ করা এখন অনেকটাই কষ্টসাধ্য। সময়ের বিবর্তনে নানা জাতি আর নানা দেশের মানুষের মুখে মুখে লায়লা-মজনুর গল্প বিবর্তিত হয়েছে নানাভাবে।

লায়লা-মজনুর প্রেম লোকমুখেই বেশি ছড়ায়। শোনা যায়, বহু বছর পূর্বে আরব দেশে ছিল বনু আমির বেদুইন গোত্রের এক মহান শাসক, যার নাম ছিল সাঈদ। তিনি ছিলেন আরবের ধনী, তাঁর ধন-দৌলত এতোটাই প্রচুর ছিল যে, আরব দেশে তাঁকে ধনাঢ্য সুলতান নামে অভিহিত করা হত। কিন্তু এত কিছুর পরেও তিনি সুখী ছিলেন না। কারণ তাঁর কোনও সন্তান ছিল না। আল্লাহতালার কাছে অনেক প্রার্থনার পর তাঁদের সংসারে একটি সুন্দর ও ফুটফুটে ছেলে জন্মায়। শিশুটির জন্মের পর বাদশা প্রজা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে টাকাপয়সা ও খাবার বিলোতে শুরু করেন। শিশুটির নাম রাখা হয় কয়েস। এই কয়েসই গল্পের, অর্থাৎ লায়লা-মজনুর প্রেমকাহিনির প্রধান নায়ক।

লায়লা মজনুর প্রেম ঘিরে নানা জনপ্রিয় মিথ ছড়িয়ে আছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। স্বর্গীয় প্রেমের প্রতীক মানা হয় এই লায়লা-মজনু জুটিকে। বিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে লায়লা এবং কয়েস একে-অন্যের প্রেমে পড়েন। তাঁদের প্রেম সমাজের নজরে এলে দু'জনের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে যায়। নিঃসঙ্গ কয়েস মরুপ্রান্তরে নির্বাসনে যান। কয়েসের ক্ষ্যাপাটে আচরণের জন্য তাঁকে ডাকা হত মজনু (পাগল) নামে। লায়লার বাবা কয়েসের সঙ্গে লায়লার বিয়েতে সম্মতি দেন না। কথিত আছে, লায়লার বাবা মজনুকে আহত করলে লায়লাও আহত হতেন, এমনই ছিল তাঁদের সেই স্বর্গীয় প্রেম। কিন্তু মজনুকে মরুভূমিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে বেদুইনের দল মজনুর হার না-মানা ভালবাসা দেখে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তারা লায়লার বাবাকে যুদ্ধে হারিয়ে দেয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। লায়লাকে তাঁর বাবা জোর করে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর লায়লা মজনুর কাছে ফিরে আসেন, কিন্তু প্রচণ্ড দুঃখ আর অনাহারে মজনু মারা যান। লায়লাও মজনুর পথ অনুসরণ করেন। মৃত্যুর পর তাঁদের পাশাপাশি সমাধিস্থ করা হয়। স্বর্গে গিয়েও ভালবাসার মানুষকে চাওয়ার তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের আকুতি এই কাহিনিকে অমর করে রেখেছে।

লায়লা মজনুর প্রেম ঘিরে নানা মুনির নানা মত। কিছু সূত্র থেকে এটা জানা যায় যে, তাঁদের উভয়ের বাবা-মা তাঁদের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন এবং সর্বশেষ তাঁরা ভারতে চলে আসেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, ভারতের রাজস্থানে লায়লা-মজনুও চলে আসেন এবং রাজস্থানের অনুপগড়ে তাঁদের মাজার রয়েছে।


আবার অনেকে বলে থাকেন, লায়লার বৃদ্ধ স্বামী মজনুকে মারার জন্য লোকবল নিয়ে এক জঙ্গলে রওনা দেন এবং মজনুকে আক্রমণ করেন। আবার অনেকে বলে থাকেন, মজনুকে যখন আঘাত করা হয়, ম্যাজিক্যালি সেই সম-পরিমাণ আঘাত লায়লার গায়েও লাগে। এভাবে যখন লায়লার বৃদ্ধ স্বামী মজনুর বুকের মাঝে ছুরি চালান, তখন লায়লাও মৃত্যুবরণ করেন। পরে তাঁদের দুইজনকে একসঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়। লায়লা-মজনুর প্রেমকাহিনি নিয়ে রয়েছে এমনই নানা রকম মিথ। 


এই প্রেমকাহিনি কাল অতিক্রম করে মুখে মুখে বিবর্তিত হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে এটা জনশ্রুতি, সেভাবে এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তবে এই প্রেম ঘিরে যে মিথ যুগের পর যুগে সঞ্চারিত, তাতে একটা কথা বলাই যায়, এর পরিণতি ট্র্যাজিক। তাই হয়তো প্রেমিক মন লায়লা-মজনুর জন্য রেখে যাবে এক ফোঁটা চোখের জল।

More Articles