বারবার বাজিমাত! লেভ ইয়াসিন থেকে কান, ফিরে দেখা বিশ্বকাপের গোলরক্ষকদের

World Cup Football: প্রতি বিশ্বকাপে, টুর্নামেন্ট শেষে ফিফা ঘোষণা করে টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপারের নাম। ১৯৯৪ সালে ফিফা এই পুরস্কারের নাম দেয় লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড

ফুটবলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পজিশন গোলরক্ষকের। ম্যাচ জেতার কৃতিত্ব গোলকিপাররা না পেলেও হারলে সব দায় তাঁদের উপরেই গিয়ে বর্তায়। ফুটবল গোলের খেলা। দর্শক মাঠে যান গোল দেখতেই, তবে সেই গোল প্রতিহত করে এক দলের কাছে নায়ক হয়ে যান গোলকিপাররা। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে অন্যান্য খেলোয়াড়দের তুলনায় স্পটলাইট কিছুটা কম পান গোলকিপাররা। এ কথা কেউই অস্বীকার করবেন না, ফুটবলে গোলকিপাররা জয় এবং পরাজয়ের মধ্যে তফাৎ গড়ে দিতে পারেন। গোলকিপারদের ছোট্ট একটা ভুল পুরো খেলার হিসাব মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো করে দিতে পারে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল সারা ম্যাচে একের পর এক দুরন্ত সেভ করলেও, যদি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাঁরা একটি ভুল করে বসেন তাহলে রাতারাতি ‘ভিলেন’ এই গোলরক্ষকরাই। তাই অন্য পজিশনের খেলোয়াড়দের তুলনায় গোলরক্ষকদের অনেক বেশি সাবধানী হতেই হয়। এই কারণেই প্রতি বিশ্বকাপে, টুর্নামেন্ট শেষে ফিফা ঘোষণা করে টুর্নামেন্টের সেরা গোলকিপারের নাম। ১৯৯৪ সালে ফিফা এই পুরস্কারের নাম দেয় লেভ ইয়াসিন অ্যাওয়ার্ড। যদিও ২০১০ সাল থেকে প্রতি বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষককে গোল্ডেন গ্লাভস দেওয়া শুরু করেছে ফিফা। দেখে নেওয়া যাক ফুটবল বিশ্বকাপের এমন কয়েকজন কিংবদন্তি গোলকিপারকে।

লেভ ইয়াসিন

যার নামে একসময় সেরা গোলরক্ষককে পুরস্কার দেওয়া হত, শুরু করা যাক তাঁকে দিয়েই। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোলকিপার বললেও অত্যুক্তি করা হয় না লেভ ইয়াসিনকে। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে তাঁর খেলা বিশ্ব জুড়ে ফুটবলপ্রেমীদের মন কেড়েছিল। ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০-এর মধ্যে চারটি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোলকিপার তিনি। ফিফার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ফুটবলের ১৫০-এর বেশি পেনাল্টি সেভ করেছেন লেভ ইয়াসিন। প্রিয় রং ছিল কালো। এই কারণেই কালো রঙের পোশাক পরে মাঠে নামতেন তিনি। সেই থেকে তাঁর ডাকনাম হয়ে যায় ব্ল্যাক স্পাইডার। ১৯৫৬ সালের অলিম্পিকস এবং ১৯৬০ সালের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়ের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে বিশ্বের প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র গোলকিপার হিসেবে ব্যালন ডি'অর জেতার কৃতিত্ব রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই কিংবদন্তি গোলকিপারের।

আরও পড়ুন- জড়িয়েছেন মারাদোনাও, বিশ্বকাপের ডোপ কেলেঙ্কারি যেভাবে বার বার শিরোনামে

গর্ডন ব্যাঙ্কস

ববি চার্লটনের সেই ব্যাচ অফ ’৬৬-এর জয়ের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন গর্ডন ব্যাঙ্কস। ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি গোলরক্ষক গর্ডন ব্যাঙ্কসকে ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক বলে মনে করা হয়। কেন ব্যাঙ্কস সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক তার প্রমাণ ১৯৬৬ বিশ্বকাপেই তিনি দেন। সেই বিশ্বকাপে টানা ৭২১ মিনিট ইংরেজদের গোলপোস্ট সুরক্ষিত রেখেছিলেন ব্যাঙ্কস! পর্তুগালের বিপক্ষে ব্যাঙ্কস যে গোলটি হজম করেছিলেন সেটি ইউসেবিও পেনাল্টি থেকে করেছিলেন। তাঁর এই অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্সে ভর করেই ফাইনালে চলে যায় ইংল্যান্ড। ফাইনালে দুই গোল হজম করলেও ইংল্যান্ড ৪-২ গোলে জিতে নেয় ম্যাচটি। সেবার বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ পারফর্মেন্স দেওয়ার জন্য সেরা গোলকিপারের অ্যাওয়ার্ড পান গর্ডন ব্যাঙ্কস।

অলিভার কান

বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোলকিপার অলিভার কান। ২০০২ বিশ্বকাপে যদি কোনও জার্মানি সমর্থককে জিজ্ঞেস করা হত তাঁর প্রিয় খেলোয়াড় কে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর আসত অলিভার কান। সেবার বেশ গড়পড়তা দল নিয়েই বিশ্বকাপে খেলতে এসেছিল জার্মানি। তা সত্ত্বেও দেশের মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ছিলেন অলিভার কান। সেবার সমর্থকদের ভরসার মান রেখেছিলেন তিনি। কানের কারণেই নামী কোনও খেলোয়াড় না থাকা সত্ত্বেও ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছেছিল জার্মানি। টুর্নামেন্ট জুড়ে বিশ্ব সাক্ষী ছিল অলিভার কানের অবিশ্বাস্য সব সেভের। ফাইনালের আগে পুরো টুর্নামেন্টে জার্মানি গোল হজম করেছিল মাত্র একটি। পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে যেরকম ফর্মে অলিভার কান খেলেছিলেন, সেটা এক কথায় অবিশ্বাস্য।

ফাইনালের প্রথমার্ধেও দুর্দান্ত সব সেভ করে ব্রাজিলের তাবড় তাবড় খেলোয়াড়দের একা হাতে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন কান। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে রিভাল্ডোর ডিফেন্স চেরা পাসে গোল করে বেরিয়ে যান রোনাল্ডো। কিছুক্ষণ পরেই আবার অলিভার কানের জাল কাঁপিয়ে দেন তিনি। পুরো টুর্নামেন্টের নায়ক, টুর্নামেন্ট শেষ হতে হতে হয়ে গেলেন ট্র্যাজিক নায়ক। তবে দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন না হলেও, নিজের অনবদ্য পারফর্মেন্সের জন্য ২০০২ বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক এবং গোল্ডেন বল জিতে নেন অলিভার কান।

জিয়ানলুইজি বুঁফো

বিশ্ব ফুটবলে ইতালি বিখ্যাত তাদের ডিফেন্সিভ ঘরানার খেলার জন্য। এই কারণে তাদের বলা হয় আজুরি। ২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালির বিশ্বজয়ের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল তাদের দুর্ভেদ্য ডিফেন্স। পুরো বিশ্বকাপে মাত্র দু’টি গোল হজম করেছিল ইতালির ডিফেন্স। এর নেপথ্যে ছিলেন তাদের গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুঁফো। ২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালি যে দু’টি গোল হজম করেছিলো তার একটি ছিল আত্মঘাতী গোল ও আরেকটি ছিল ফাইনালে পেনাল্টি থেকে করা জিদানের গোল। পুরো বিশ্বকাপ জুড়েই দুর্দান্ত সব সেভ করেছিলেন বুঁফো। বিশেষ করে ফাইনালে জিদানের হেড, বুঁফো যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তা এককথায় অবিশ্বাস্য! বুঁফো ওই সেভটা করেছিলেন বলেই ফ্রান্স বনাম ইতালির খেলা টাইব্রেকারে গড়ায়। টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে ৫-৩ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয় ইতালি।

১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে সবচেয়ে কম গোল খাওয়ার রেকর্ড করেছিলেন ফ্যাবিয়ান বার্থেজ। কিন্তু ২০০৬ বিশ্বকাপে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন বুঁফো। এক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি, সমসাময়িক অন্যান্য খেলোয়াড়রা অবসর গ্রহণ করলেও ৪৪ বছরের বুঁফো এখনো খেলে চলেছেন বহাল তবিয়তে। আন্তর্জাতিক স্তরে না খেললেও ক্লাব ফুটবলে এখনও যথেষ্ট ভরসাযোগ্য নাম তিনি। ২০০২ থেকে ২০১৪, টানা চারটি বিশ্বকাপে ইতালির গোল সামলেছেন তিনি। গতবার ইতালি বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করলে হয়তো সেবারও তাঁকে দেখা যেত ইতালির গোল সামলাতে।

আরও পড়ুন- ব্যাড বয় না কি রাজপুত্র? মারাদোনাকে ছাড়া আজীবন ফিকে বিশ্বকাপের ময়দান!

হোসে লুই চিলাভার্ট

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, গোলকিপারদের মুখ্য কাজ গোল বাঁচানো। তবে প্যারাগুয়ের গোলরক্ষক চিলাভার্ট ছিলেন এর বিপরীত। গোল তো তিনি বাঁচাতেনই সঙ্গে গোলও করে আসতেন। সেটপিস থেকে গোল করার ক্ষেত্রে চিলাভার্টের জুড়ি মেলা ভার। ১৯৯৮ এবং ২০০২ বিশ্বকাপে প্যারাগুয়ের কোয়ালিফাই করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ‘এল পিটবুল’ হোসে লুই চিলাভার্টের।

১৯৯৫, ’৯৬, ’৯৮ সালে কোপা আমেরিকায় সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব পান তিনি। বিশ্বকাপে একটি গোলও রয়েছে তাঁর। বিশ্বের একমাত্র গোলকিপার হিসেবে তাঁর রেকর্ড রয়েছে একটি ম্যাচে হ্যাটট্রিক করার। ২২ বছরের (১৯৮২-২০০৪) ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে সাতশোর বেশি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। তাঁর নামের পাশে একটি হ্যাট্রিক-সহ রয়েছে ৫৬টি গোল।

More Articles