মৃত্যুশয্যায় শুয়ে নিয়েছিলেন সোনালি ট্রফিটি, কেমন ছিল সত্যজিৎ রায়ের অস্কার প্রাপ্তির মুহূর্ত?

Satyajit Ray Oscar : সেই মুহূর্তেই বাঙালির বিশ্বজয় দেখল গোটা পৃথিবী। অস্কারের মঞ্চে সেরার সম্মান পেলেন সত্যজিৎ রায়।

সালটা ১৯৯২। দিনটা ৩০ মার্চ। কলকাতায় তখন গভীর রাত। মহানগরীর রাস্তা শাসন করার চারজন যুবকও ফিরে গিয়েছে নিজেদের আস্তানায়। মাঝে মাঝে এক আধটা মোড়ে জেগে আছে ভবঘুরে। গঙ্গার ধারে বসে চুলের জট খুঁটে যাচ্ছে বৃদ্ধ পাগল। সারাদিনের ব্যস্ত শহরটা যেন একটা ঘুমন্ত রাক্ষস। এমনই সময়, কয়েকশো কিলোমিটার দূরের একটি দেশে তখন জাঁকজমক আর আলোর ঝলকানি। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমা বদলে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে সময়ের চালচিত্রও। সেই সময়ের বিশ্বের তাবড় সিনে শিল্পীরা উপস্থিত হয়েছেন সেই মঞ্চে। ঝলমলে সেই মঞ্চের তখন একটাই নাম – অস্কার।

বেশ কিছুক্ষণ পর গোলাপি, সুন্দর একটি পোশাক পরে আমেরিকায় অস্কারের মঞ্চে উঠলেন অড্রে হেপবার্ন। বয়স হয়েছে ঠিকই; কিন্তু রূপ আর শিল্পের শ্রেষ্ঠত্বের আলো এখনও যেন তাঁর চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। হলিউডের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, কিংবদন্তি এই অভিনেত্রী ঘোষণা করলেন সেই বছরের অস্কার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট। ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠে এল সেই ট্রেনের দৃশ্য। অদৃশ্যে এসে দাঁড়াল অপু-দুর্গা। উঠে এল পথের পাঁচালি। আর অড্রে হেপবার্ন ঘোষণা করলেন দীর্ঘদেহী, ব্যারিটোন গলার সেই মানুষটির নাম। দিনের হিসেব বলছে, ৩১ মার্চ চলে এসেছে। আর সেই মুহূর্তেই বাঙালির বিশ্বজয় দেখল গোটা পৃথিবী। অস্কারের মঞ্চে সেরার সম্মান পেলেন সত্যজিৎ রায়।

সুকুমার রায়ের ছেলে, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নাতি – এই পরিচয়ের পরই দাঁড়ি পড়ে যেতেই পারত। হতে দিলেন না স্বয়ং সত্যজিৎ। প্রথমে ইলাস্ট্রেশন, তারপর ‘সন্দেশ’-এর সম্পাদনা, বিজ্ঞাপন জগতের কাজ, বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা – নানারকম প্রতিভার স্বাক্ষর দেখিয়েছেন তিনি। সেই কাজ করতে গিয়েই পড়ে ফেলা ‘আম আঁটির ভেঁপু’। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলা, এই আখ্যানকে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরবেন তিনি। ‘পথের পাঁচালি’ তৈরি কাহিনি আলাদা এক আখ্যান। আলাদা এক ইতিহাস, যা বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পাতায় অমর হয়ে আছে। অজস্র প্রতিকূলতা, ঝড়-ঝাপ্টা পেরিয়ে তৈরি হল সেই সিনেমা। বাকিটা? সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ছয় ফুট চার ইঞ্চি লম্বা এই মানুষটির গলার আওয়াজটিও ছিল মানানসই। ছবির মাধ্যমেই নিজের কথাগুলি বলে গিয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। সারাটা জীবন কাজ নিয়ে থেকেছেন, কাজ করে গিয়েছেন এক নাগাড়ে। কেবল চলচ্চিত্র নির্মাণই নয়; সত্যজিতের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। ভেনিস থেকে কান – যাবতীয় সেরা চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে সেরার পুরস্কার পেয়ে গিয়েছেন তিনি। বাকি ছিল বিশ্বখ্যাত সেই সোনালি ট্রফিটি। সেই সত্যজিৎকেই ১৯৯২ সালের ৩১ মার্চ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারে সম্মান জানাল অস্কার। সম্মান জানাল গোটা বিশ্ব।

কিন্তু হায় এ জীবন! জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, “এই পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর”। যখন অস্কার এল, তখন কিংবদন্তি এই চলচ্চিত্র পরিচালক মৃত্যুশয্যায়। ১৯৮৩ সাল। বয়স হয়েই আসছিল একটু একটু করে। সেবারই প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হল সত্যজিতের। তবুও কাজ করা থামাননি তিনি। শরীরও একটু একটু করে সুযোগ খুঁজছিল। ১৯৯২ সালে আরও একবার হার্ট অ্যাটাক। এবার আর নিতে পারেনি শরীরটা। শ্বাসকষ্টের সমস্যা আরও বাড়ল, দুর্বল হয়ে হাসপাতালের বিছানায়।

অস্কার আনতে আমেরিকা যেতে পারেননি তিনি। বরং অস্কার নিজে এসেছিল তাঁর কাছে। ভিডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে, সেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে অতি কষ্টে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন সত্যজিৎ রায়। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা অস্কারের সোনালি ট্রফিটি। আর তারপর? অস্কার প্রাপ্তির ঠিক ২৩ দিন পরই চিরকালের মতো থেমে গেল পথচলা। কেবল দুঃখ একটাই ছিল সত্যজিতের। অনেক কাজ যে বাকি থেকে গেল। কত কথা বলা হল না! কত কাজ আর করা হল না!

More Articles