ধর্ষকের প্রেমে পড়েছেন কারাপাল, রয়েছে নিজস্ব 'ব্র্যান্ড'! রহস্যের অন্য নাম তিহার জেল
Tihar Jail: ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির সঙ্গে মহিলা কারাপালের মন দেওয়া-দেওয়ার নজির রয়েছে তিহারে।
সমাজের চোখে বিপরীত মেরুতে অবস্থান। কিন্তু আসলে স্বামী-স্ত্রীর মতোই বোঝাপড়াই। নিত্যদিন লেগে থাকে সাংসারিক অশান্তিও। সিলভার স্ক্রিনে কয়েদি এবং কারাপালের সম্পর্ককে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছিলেন ‘কালিয়া’ অমিতাভ বচ্চন। তাঁর মুখে বসানো সংলাপ নেহাত চিত্রনাট্যের কেরামতি যে নয়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ দিল্লির কুখ্যাত (বিখ্যাতও বটে) তিহার জেল। সমাজের জন্য বিপজ্জনক বলে যাঁদের গণ্য করে আদালত, তাঁদের ঠাঁই হয় সেখানে। বর্তমানে রাজনৈতিক টানাপোড়েন, হুমকি-হুঁশিয়ারির কেন্দ্রবিন্দুও হয়ে উঠেছে তিহার। কিন্তু রাজধানীর বুকে অবস্থিত, সুউচ্চ দেওয়াল পরিবেষ্টিত তিহার জেলকে, ভারতের মধ্যে গড়ে ওঠা আরও এক ভারত বললেও ভুল হয় না।
রোজকার খেজুরে আলাপে সাধারণত তিহারের উল্লেখ থাকে না। যেটুকু, যা শোনা যায়, তা খবরের দৌলতেই। জেলখানা হলেও ঘরানা সংশোধনাগারের। সমাজ থেকে ছিটকে যাওয়াদের মূলস্রোতে ফেরানোর ব্যবস্থাপনা রয়েছে, নামের সঙ্গেও রয়েছে যার সামঞ্জস্য। কারণ নেপাল, সিকিম এমনকী উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় হিন্দুরা পাঁচ দিন ধরে যে উৎসব পালন করেন (দীপাবলি থেকে ভাইফোঁটা) তাও তিহার তথা তিহাড়। আলোর দীপ্তিতে অন্ধকারকে ধুয়েমুছে ফেলার উৎসব। অন্ধকার দুনিয়া থেকে কয়েদিদের আলোয় ফেরানোর প্রচেষ্টা হিসেবে তাই দেখা যেতে পারে দেশের বৃহত্তম কারাগার তিহার জেলকে।
কুখ্যাত অপরাধীদের আস্তানা হিসেবেই আম ভারতীয়ের কাছে পরিচিতি তিহারের। তিহার জেলের বন্দিতালিকায় চার্লস শোভরাজ, আবু সালেম, ছোটা রাজন, আফজল গুরু, মকবুল ভাটদের নাম যেমন রয়েছে, তেমনই সঞ্জয় গান্ধী, লালুপ্রসাদ যাদব, পি চিদম্বরম, আন্না হাজারে, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো রাজনীতিক তথা সমাজকর্মীদেরও তিহারে ঢুকতে হয়েছে। সাহারা কর্তা সুব্রত রায়ও রয়েছেন তালিকায়। তিহারে রাত কাটিয়েছেন অভিনেতা সঞ্জয় দত্তও। ছাত্রনেতা থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা কানহাইয়া কুমারও তিহাড়ে থেকেছেন। এমনকী ছাত্রজীবনে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও তিহারযাত্রা ঘটেছিল। নির্ভয়ার পাঁচ ধর্ষকের ঠাঁই হয়েছিল সেখানে। এর মধ্যে চারজনের ফাঁসি হয়, আত্মঘাতী হয় একজন।
আরও পড়ুন- ভয়ংকর পেশি, যেন বাস্তবের ‘চুলবুল পাণ্ডে’! অনুব্রতকে পাহারা দেবেন তিহারের এই জেলার?
সরকারিভাবে ৪০০ একর জায়গা জুড়ে তৈরি তিহার জেলে একসঙ্গে ১০ হাজারের কিছু বেশি বন্দি রাখার অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু দেশের জনসংখ্যার মতোই, তিহারেও বন্দির সংখ্যা উপচে পড়ছে। ২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, তিহার জেলে বন্দির সংখ্যা সাড়ে ১৭ হাজারের বেশি। একসঙ্গে এতজন যেখানে বন্দি, সেখানে পৃথক বাস্তুতন্ত্রও গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। সোজা বাংলায় বললে, দীর্ঘমেয়াদি সাজাপ্রাপ্তদের নিজস্ব ঠেক রয়েছে। যে, যত বড় অপরাধী, তার অনুগামীর সংখ্যা তত বেশি। জেলের অন্য কয়েদিরা রীতিমতো মান্যিগন্যি করে। হাত-পা টিপে দেওয়া থেকে মুখের সামনে খাবার ধরা, বাদ যায় না কিছুই। এমনকী জেলের অন্দরে কয়েদিদের মধ্যে খাপ পঞ্চায়েতও বসে। জেলের মধ্যেই আলাদা সমাজ গড়ে উঠেছে। সেখানে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধলে, প্রভাবশালীর সঙ্গে দুর্ব্যবহারে আলাদা বিচারব্যবস্থা বসে। এমনকী জেলের অন্দরে টাকা-পয়সা তো বটেই, মদ, সিগারেট, মাদকও সহজলভ্য, শুধু মহার্ঘ এই যা। এক প্যাকেট সাধারণ সিগারেট কিনতে হয় ৫০০ টাকায়। একটি নিলে দাম পড়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা। টাকার বদলে জেলের কুপনেও হয় লেনদেন।
দীর্ঘ ৩৫ বছর তিহার জেলের অন্দরে কারাপালের ভূমিকায় ছিলেন সুনীল গুপ্ত। পরবর্তীকালে তিহারে নিজের অভিজ্ঞতা বইয়ের আকারে তুলে ধরেছিলেন তিনি। লিখেছিলেন ‘ব্ল্যাকওয়ারেন্ট: কনফেশন্স অব আ তিহার জেলার’। তাতে তিহারের অন্দরের সমাজব্যবস্থা সকলের সামনে তুলে ধরেছিলেন তিনি, যা পড়লে শিহরণ জাগে। ইন্দিরা গান্ধীর খুনিদের তিহার জেলে ফাঁসি হতে দেখেছিলেন সুনীল। তিহারের অন্দরের যে ছবি তুলে ধরেছেন, তা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। তিনি জানিয়েছেন, ধর্ষণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির সঙ্গে মহিলা কারাপালের মন দেওয়া-দেওয়ার নজির রয়েছে তিহারে। এমনকী সাতপাকে বাঁধা পড়ে পরিণতিও পায় সেই সম্পর্ক। প্রভাবশালী এক রাজনীতিকের বখে যাওয়া ছেলেকে তিহারে এসে মাটির মানুষ হয়ে উঠতে দেখেছেন। দেখেছেন, ম্যানেজমেন্ট পাস করা বন্দির হাতে তিহারের পণ্যকে ব্র্যান্ড TJ হতে।
তিহারের রোজনামচা বর্ণনা করতে গিয়ে চার্লস শোভরাজের উল্লেখ উঠে এসেছে সুনীলের লেখায়। জানিয়েছেন, জেলের অন্দরেও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ধরে রেখেছিলেন চার্লস শোভরাজ। জেলের অন্দরে মাদক এবং মদের আমদানি করাতেন শোভরাজই। নিজের রান্না নিজে করতেন শোভরাজ। বই লিখে বিপুল উপার্জনের টাকায় পুলিশকে ঘুষ দিয়ে হাতে রাখতেন। আবার নিরক্ষর সহবন্দির হয়ে আইনি চিঠির জবাবও লিখে দিতেন শোভরাজ। এমনকী আদালতের প্রশ্নের জবাব লিখতে শোভরাজের সাহায্য নিত জেল কর্তৃপক্ষও। বন্দির সংখ্যা এত বেশি যে ১০ জন লোক ধরে, এমন কুঠুরিতে ৫০ জনকে রাখতে হতো। কিন্তু তার মধ্যেও প্রভাবশালী মাফিয়া নেতার জন্য জেলে দু’টি কুঠুরি বরাদ্দ হতে দেখেছেন সুদীপ। একটিতে নাকি থাকতেন গ্যাংস্টার নিজে। অন্যটি বরাদ্দ ছিল তাঁর পোষা পায়রার দলের জন্য। ছেলে জেলে ঢুকতে এক রাজনীতিক নাকি পাশের একটি হোটেলই কিনে ফেলেছিলেন, যাতে ভাল খাবার রোজ পৌঁছে যায় ছেলের কাছে। সেই হোটেলে আবার চাকরিও জুটে যেত জেলের কর্মীদের পরিবারের লোকজনের।
তাই বিতর্ক থেকেও রেহাই পায়নি তিহার জেল। জেলের অন্দরে বন্দিদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে, জেলের অন্দরে মোবাইলের ব্যবহার, বাছাই করা কিছু বন্দির জন্য বিলাসের বন্দোবস্ত, জেলের অন্দরে পুলিশের হাতে বন্দিদের উপর হওয়া অকথ্য অত্যাচার, এমনকী হত্যার ঘটনাও উঠে এসেছে বার বার। গত বছর জেলের ভিতরে বসে বাইরে তোলাবাজি চক্র চালানোর অভিযোগও সামনে আসে। তোলাবাজি এবং জালিয়াতির মামলায় ধৃত সুকেশ চন্দ্রশেখর জেলের অন্দরে প্রায় ১০০ আধিকারিককে মাসিক বেতনে রেখেছেন বলে জানা যায়। সম্প্রতি আম আদমি পার্টির নেতা তথা দিল্লির প্রাক্তন মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈনের জেলের কুঠুরির সিসিটিভি ফুটেজ সামনে আসে। তাতে জেলের অন্দরেই মাসাজ নিতে, হোটেল থেকে আনা খাবার খেতে দেখা যায় তাঁকে। তিহারের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন জেলের প্রাক্তন ইনস্পেক্টর জেনারেল কিরণ বেদিও। প্রশ্ন ওঠে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে।
আরও পড়ুন- ‘দাদা’দের ভাগ্যে বডি ম্যাসাজ, ‘দাগী’ হলে নারকীয় অত্যাচার! তিহারের জেলকুঠুরি যেমন…
তবে তিহারের এই জগতের মধ্যেও রয়েছে বৈচিত্র। গড়ে তোলা হয়েছে ‘সেফ জোন’ও। ছোটখাটো অপরাধে জেলে ঢুকেছেন যাঁরা, সাজার মেয়াদ যাঁদের ছ’মাসের কম, আদালতে শুনানি চলছে যাঁদের, তাঁদের এই ‘সেফ জোনে’ রাখা হয়, যাতে পচা আলুর সঙ্গে থেকে তাঁদের মধ্যেও পচন না শুরু হয়। জেলের মধ্যে রয়েছে মুক্ত বিদ্যালয়, এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়ও। পড়াশোনায় ইচ্ছুক বন্দিদের অবাধ প্রবেশ রয়েছে সেখানে। গান, আঁকা, লেখালেখি, অভিনয়ের তালিমও দেওয়া হয়। যোগব্যায়াম শেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। কারাগারের সৌন্দর্যায়ন, পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বও বন্দিদের হাতেই। আনাজ কাটা থেকে রান্নাবান্নাও নিজে হাতেই করেন সকলে। মেনুতে থাকে ভাত, রুটি, ডাল, তরকারি, আলুভাজা, স্যালাড। বিশেষ দিনে আসে মিষ্টিও। প্রতিদিন প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার রুটি তৈরি হয়, যা মূলত মোটা আটায় তৈরি, পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। বন্দিদশা কাটিয়ে যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন বন্দিরা, তার জন্য হস্তশিল্প, কারখানার কাজ শেখানো হয়। নিয়মিত আসেন মনোবিদও।
আর তাতে ভর করেই তিহার জেলে গড়ে উঠেছে ৫০ লক্ষ ডলারের অর্থনীতি। তিহারের ১৬টি জেলে ৩৪টি কারখানা ইউনিট রয়েছে। সেখান থেকে পণ্য যায় বাজারে। তিহার জেলে উৎপাদিত পণ্য TJ ব্র্যান্ড নামে বাজারে ছাড়া হয়। গহনা থেকে সার্ফ-সাবান, বিস্কুট, আসবাবপত্রও তৈরি করেন বন্দিরা। দিল্লি সরকারের কারা বিভাগে সেই টাকা ঢোকে, যা মূলত জেলের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনাতেই খরচ করা হয়। পরিশ্রমের জন্য জেলের অন্দরে বেতনও পান বন্দিরা, যে টাকা হয় বাড়িতে পাঠা তাঁরা, নয়তো বা মেয়াদ শেষে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য জমাতে থাকেন। উৎপাদিত পণ্য নিয়ে ১৯৬১ সাল থেকে ‘তিহার হাট’ও চলছে জেল চত্বরে। সকাল ৯.৩০টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। সম্প্রতি অনলাইন বিপণনীতে নাম লিখিয়েছে ‘তিহার হাট’। কাপকেক থেকে স্টেশনারি, হস্তশিল্পজাত পণ্য কিনতে পাওয়া যায় সেখানে। সেখানে ১৫০০ টাকা থেকে শুরু আসবাবের দাম। হাতে আঁকা ছবির দাম শুরু ২ হাজার টাকা থেকে। এছাড়াও ২৫০ টাকায় ল্যাপটপ ব্যাগ পাওয়া যায়। কিনতে পাওয়া যায় খাম, মোমবাতি, বিছানার চাদর, শার্ট, সোয়েটার, কম্বল, জ্যাম, কাজু দিয়ে তৈরি বিস্কুট, চানাচুর। এই সবকিছুই তৈরি করেন বন্দিরা। দিল্লিবাসী হাসিমুখেই সেই সব পণ্য কেনেন। তাঁদের মতে, অপরাধকে ঘৃণা করা উচিত, অপরাধীকে নয়। অপরাধীদেরও পুনর্বাসন কাম্য।