হাজার বছর ধরে জলের গভীরে লুকিয়ে আছে দানব? যে রহস্যের কিনারা হয়নি আজও...
Loch Ness Monster, Scotland: হ্রদে বসবাসকারী এই জলজ অতিকায় প্রাণীর বিবরণ ১,৫০০ বছর আগে মিললেও প্রাণীটির অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মেলেনি।
সবাই জানে আছে, কিন্তু কেউ দেখেনি! শত শত বছর ধরে তাবড় বিজ্ঞানীরাও যুৎসই কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। ফলে আজীবনের মতো কিংবদন্তি হয়ে রইল লোচ নেস মনস্টার, আদর করে মানুষ তাকে ডাকেন নেসি বলে। স্কটল্যান্ডের ইনভারনেসের কাছে বিশাল বড় মিষ্টি জলের হ্রদ লোচ নেসে বাস করে এই নেসি। আকারে সে এক বিশাল প্রাণী, কিন্তু কেউই সেভাবে নির্দিষ্ট করে দেখেনি এই প্রাণীটিকে। কল্পনা, না কি সত্যিই কোনও রহস্য, এ একমাত্র নেসিই জানে। হ্রদে বসবাসকারী এই জলজ অতিকায় প্রাণীর বিবরণ ১,৫০০ বছর আগে মিললেও প্রাণীটির অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মেলেনি। স্কটিশ হাইল্যান্ডে অবস্থিত লোচ নেসে গ্রেট ব্রিটেনের সবচেয়ে বেশি পরিমাণে মিষ্টি জল রয়েছে; জলের গভীরতা প্রায় ৮০০ ফুট এবং হ্রদটি লম্বায় প্রায় ২৩ মাইল দীর্ঘ! ১৯৩৪ সালে ইংরেজ চিকিৎসক রবার্ট কেনেথ উইলসন নাকি এই প্রাণীটির ছবি তোলেন। বিখ্যাত সেই ছবিটি 'সার্জনস ফটোগ্রাফ' নামে পরিচিত। তাতেই দেখা যায় জলবাসী ওই দৈত্যের মাথাটি ছোট এবং ঘাড় বিশাল লম্বা। ১৯৯৪ সালে জানা যায় উইলসনের ছবিটি জাল। আসলে একটি খেলনা সাবমেরিনের সঙ্গে একটি প্লাস্টিক এবং কাঠের মাথা জোড়া হয়েছিল। চূড়ান্ত কোনও প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও, লোচ নেসের দানব জনপ্রিয় এবং লাভজনক হয়ে স্কটল্যান্ডের অর্থনীতিতেও বাঁক আনে। ২১ শতকের গোড়ার দিকে দেখা যায়, লোচ নেস স্কটল্যান্ডের অর্থনীতিতে বার্ষিক প্রায় ৮০ মিলিয়ন ডলার যোগ করেছে।
সেন্ট কলম্বা
সপ্তম শতাব্দীর আইরিশ ধর্মপ্রচারক সেন্ট কলম্বার জীবনীতে প্রথম এই অদ্ভুত প্রাণীর কথা মেলে। সেন্ট কলম্বা স্কটল্যান্ডে খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন। সেন্ট কলম্বার জীবনীকারের মতে, ৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট কলম্বা ইনভারনেসের কাছে উত্তর পিক্টসের রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। পথমধ্যে লোচ নেস হ্রদে তিনি থামেন। তখন তিনি দেখতে পান হ্রদের মধ্যে এক অদ্ভুত দর্শন বিশালাকার জন্তু একটি মানুষকে আক্রমণ করেছে। সেন্ট কলম্বা আর কী করেন, প্রাণপণে ভগবানের নাম নিয়ে দূর থেকে ওই প্রাণীটিকে নির্দেশ দেন "এক্ষুণি এখান থেকে পালাও"! দৈত্যাকার ওই প্রাণী ফিরে যায়। শোনা যায় আরও কখনও অন্য মানুষের ক্ষতি করেনি সে।
আরও পড়ুন- আর কোনও প্রাণীর দেহেই নেই! জানেন, কেন কেবল মানুষেরই চিবুক আছে?
লোচ নেসের দৈত্যটি আসলে কে?
১৯৩৩ সালে, লোচ নেসের তীরে একটি নতুন রাস্তা তৈরি করা হয়। এই রাস্তা দিয়ে যে গাড়ি চালকরা যাবেন স্পষ্টভাবে হ্রদটিকে দেখতে পাবেন। ১৯৩৩ সালের ২ মে, ইনভারনেস কুরিয়ারের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, স্থানীয় এক দম্পতি নাকি হ্রদের জলের উপর এক বিশাল প্রাণীকে ভেসে থাকতে, সাঁতার কাটতে দেখেছেন। লন্ডনের সংবাদ সংস্থাগুলি স্কটল্যান্ডে সংবাদদাতা পাঠাতে শুরু করে বিষয়টি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে। এখানেই শেষ না, একটি সার্কাস কোম্পানি তো আবার জানোয়ারটিকে ধরার জন্য ২০,০০০ পাউন্ড পুরস্কারের ঘোষণাও করে ফেলে। ধীরে ধীরে লোচ নেস দানবের গল্পটি সাংবাদিক মহলেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৩৩ সালে ওই পশুটিকে দেখতে পাওয়ার পরে, অন্য এক দম্পতি দাবি জানান, হ্রদের তীরের রাস্তা পার হওয়ার সময় জমিতে জন্তুটিকে দেখেছেন তারা। লন্ডনের ডেইলি মেইল সহ বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ সংবাদপত্র স্কটল্যান্ডে সাংবাদিকদের পাঠায়। ডেইলি মেইল আবার জন্তুটিকে ধরার জন্য ব্রিটিশ-দক্ষিণ আফ্রিকান অভিনেতা ও শিকারি মারমাডিউক ওয়েথেরেলকে নিয়োগ করে।
কয়েকদিন ধরে ওই হ্রদের অঞ্চলে লোচের অনুসন্ধান চালানোর পরে, ওয়েথেরেল দাবি করেন, বিশাল এক চারপেয়ে প্রাণীর পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন তিনি। ডেইলি মেইলের তো পোয়া বারো! পরদিনই কাগজে বড় করে খবর বেরোয়, "লোচ নেসের দানব কিংবদন্তি নয় বরং সত্য"।
খবর ছড়িয়ে পড়তেই অনেক পর্যটক লোচ নেসে নেমে পড়েন! নৌকা বা ডেক চেয়ারে বসে পশুটিকে এক ঝলক দেখার অপেক্ষা করেন। পায়ের ছাপের প্লাস্টার ঢালাই করে ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে খতিয়ে দেখা যায় পায়ের ছাপগুলি একটি জলহস্তীর। আরও ভালো করে বলতে গেলে একটি জলহস্তীর কৃত্রিম পায়ের। এই ছাপগুলি বড় ছাতা, অ্যাশট্রে দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এই গুজবে লোচ নেসের দানবের গল্প কিছুটা ধামাচাপা পড়ে ঠিকই কিন্তু নানা রটনা চলতেই থাকে।
আরও পড়ুন- বাঁদরেরই জাত ভাই! তবে কেন মানুষের মতো বুদ্ধি ধরে না অন্য কোনও প্রাণীই?
১৯৩৪ সালের একটি বিখ্যাত ছবিতে দেখা যায়, ডাইনোসরের মতো এক প্রাণীর লম্বা ঘাড় ঘোলা জল থেকে বেরিয়ে আসছে, পরে জানা যায় ছবিটি ভুয়ো। কেউ কেউ অনুমান করেন, 'নেসি' আসলে দীর্ঘকাল আগে বিলুপ্ত প্লেসিওসরদের একামাত্র বেঁচে থাকা সদস্য। জলজ প্লেসিওসররা ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে বাকি ডাইনোসরদের সঙ্গেই মারা গিয়েছিল বলে মনে করা হতো।
লোচ নেস বরফ যুগে জমাট বাঁধা হ্রদ ছিল। তাই এই প্রাণীটিকে বিগত ১০,০০০ বছরে সমুদ্র থেকে নেস নদীতে আসতে হয়েছে। প্লেসিওসরদের রক্ত ঠান্ডা। তাই এই পশু নাকি লোচ নেসের হিমশীতল জলে বেশিদিন টিকতে পারবে না।
অন্যরা আবার বলেন, এটি একটি আর্কিওসাইট। সাপের মতো ঘাড়ওয়ালা এক আদিম তিমি যা ১৮ মিলিয়ন বছর ধরে বিলুপ্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। আরেক অংশের মানুষ বলতে থাকেন, এসব কিচ্ছু না। তাঁদের যুক্তি, মানুষজন যা দেখেছে তা আসলে 'সিচেস'। সিচেস হচ্ছে সামান্য উষ্ণ লোচে নদীর ঠান্ডা জলপ্রবাহের কারণে জলের পৃষ্ঠের দোলন।
অনুসন্ধান অব্যাহত
লোচ নেসের এই পশুটি কি তবে সত্যিই গল্প? অবিরাম নজরদারি চালানো হয় এই হ্রদের রহস্য সমাধানের লক্ষ্যে। ১৯৬০-এর দশকে বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় গভীর জলে অনুসন্ধান চালায়। কিছুই তেমন পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিটি অভিযানে জলের নিচে চলমান বিশালাকার বস্তু দেখতে পেয়েছেন সন্ধানকারীরা। যা আসলে ঠিক কী তারা ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
১৯৭৫ সালে, বোস্টনের আকাডেমি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স লোচ নেসের একটি অভিযানে তোলা জলের নিচের ছবিগুলিকে একত্রিত করে। একটি ছবিতে দেখা যায়, প্লেসিওসর-সদৃশ প্রাণীর বিশাল দেহ। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে আরও অভিযান চালানো হয়, যদিও মেলেনি কিছুই। নানা গুজব প্রকাশ্যে ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরেও মানুষের কৌতূহল কিন্তু কমেনি।