ভুলতে পারেননি নিজের প্রথম প্রেমিকাকে, এই শহরের নামে তাঁকে অমর করে গেলেন বিধান চন্দ্র রায়

D. Bidhan Chandra Roy: দুর্গাপুর, সল্টলেক, শকুন্তলা পার্কের মতো একাধিক টাউন তৈরি করা হলো কলকাতার আশেপাশে বেশ কিছু জায়গায়। সেরকম ভাবেই নদিয়ার রুজভেল্ট টাউন নতুন করে তৈরি করলেন ডঃ বিধান চন্দ্র রায়।

বিধানচন্দ্র রায়, বাংলার সবথেকে সফল মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকায় বিধান রায়ের নাম থাকবে না এটা কার্যত হতেই পারেনা। বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তাঁর অবদান এতটাই বেশি ছিল যে তাঁকে অনেকে বাংলার সবথেকে ভাল মুখ্যমন্ত্রীর তকমাও দিয়ে থাকেন। তবে শুধুই কি প্রশাসনিক কাজ? চিকিৎসক হিসাবেও তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। যেমন ছিল তাঁর রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা, তেমনই ছিল রোগ চিহ্নিত করার ক্ষমতাও। অনেকে তাঁকে ধন্বন্তরির সঙ্গেও তুলনা করতেন। দুর্ধর্ষ ক্লিনিকাল আইয়ের জোরে তিনি বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন নিজের জীবদ্দশায়। বিলেত থেকে এফআরসিএস পাশ করার পরে তিনি বিলেতে গিয়ে কিন্তু প্র্যাকটিস করেননি। বরং সেই সময় যখন সকলে ভারত থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় নিজেদের ডাক্তারি করা শুরু করেছিলেন, সেই সময় দেশের মানুষের চিকিৎসা করার জন্য বাংলায় ফিরে এসেছিলেন ডঃ বিধান চন্দ্র রায়।

সেখান থেকেই প্রথমে কলকাতার মহানাগরিক এবং পরবর্তীতে বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি তাঁর কার্যকালে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের একাধিক উন্নয়ন করেছিলেন। সল্টলেক, লেকটাউনের মতো বেশ কিছু এলাকার রূপকার ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়। কিন্তু এসবকে ছাপিয়ে গিয়েও ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের আরও একটি গল্প অমর হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রথিতযশা ডাক্তার নীলরতন সরকারের কন্যার সঙ্গে বিধানচন্দ্র রায়ের অপূর্ণ প্রেমের কাহিনি আজও বাঙালির অজানা। তার সঙ্গে সঙ্গেই অজানা ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের তাঁর অপূর্ণ প্রেমের প্রতি আনুগত্যের কথাও। 

শাহরুখ খানের দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গেতে যেরকম রাগী বাবার ভূমিকায় ছিলেন অমরেশ পুরি, সেরকমই এই প্রেম কাহিনিতেও রাগী বাবার ভূমিকায় ডাক্তার নীলরতন সরকার। কিন্তু সিনেমায় যেমন ভাবে সিমরনকে 'যা সিমরান যা, জি লে আপনি জিন্দেগি' বলেছিলেন, অমরেশ পুরি, এই গল্পে সেরকমটা হলনা। বরং অপূর্ণই থেকে গেল তাঁদের দু'জনের রোমান্টিক সম্পর্কটি। এরকম একটি গল্প সকলেরই আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়াল আগামী কয়েক বছরের মধ্যে। হবে নাই বা কেন, এরকম সরস গল্পের খোঁজই তো করে সকলে। সিনেমা থেকে শুরু করে খবরের কাগজ সব জায়গায় একাধিক লেখাও হলো এই গল্প নিয়ে। বিগত কয়েক দশকে অনেকেই এই গল্প নিয়ে একাধিক লেখালেখি করে ফেলেছেন। 

আরও পড়ুন- ভারতের এই গ্রামে বিচার হয় স্বয়ং দেবতাদের! কড়া শাস্তি পান দেবদেবীরা

কিন্তু বিধানচন্দ্র রায় নিজের পুরোনো প্রেমকে নিজের থেকে কখনও আলাদা করেননি। বরং প্রেমিকার নামেই তিনি একটি আস্ত শহরের নামকরণ করেছিলেন যা আজকে পরিচিত কল্যাণী নগরী হিসেবে। নদিয়া জেলার এই ছোট্ট শহরটি কলকাতা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং এই শহরটি কলকাতা থেকে অনেক বেশি নবীন। বিধান চন্দ্র রায় এই শহরটি তৈরি করেছিলেন নিজের কার্যকালের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই শহরটি রুজভেল্ট টাউন হিসেবে খ্যাত ছিল। পরবর্তীতে এই শহরটিকে নিজের প্রেমিকার নামে নামাঙ্কিত করেছিলেন ডঃ বিধান চন্দ্র রায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক সময়ে জাপানি আক্রমণে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু জায়গায় জাপানি আধিপত্য শুরু হয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল শুরু হয়েছিল জাপানি উপনিবেশ তৈরি করার কাজ। সেই সময়ে ভারতের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করেছিল জাপান। পাশাপাশি, জাপানি আধিপত্যে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল ভারতের ব্রিটিশ শাসন। তার উপর যখন বার্মা অঞ্চলে জাপানি উপনিবেশ তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে সেই সময় আরও বেশি চাপে পড়ে যায় ব্রিটিশরা। এরই সঙ্গে জাপানের সহায়তায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ধীরে ধীরে মণিপুর এবং কোহিমার বেশ কিছু জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করেছিলেন। সালটা তখন ১৯৪৪, ভারতীয়দের মনে স্বাধীনতার আগুন তখন দাবানলের মতো জ্বলতে শুরু করেছে। 

সেই সময় ব্রিটিশ রাজকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিশাল সংখ্যায় আমেরিকান সৈন্য পাঠানো হলো ভারতে। বাংলার কিছু জায়গায় তারা নিজেদের ঘাঁটি গেড়ে নিল জাপানি আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য। এমনিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাপান। তাই জাপানের বিরুদ্ধে আক্রমণের গড়ে তোলার জন্য ব্রিটিশকে পর্যন্ত সাহায্য করতে রাজি ছিল আমেরিকানরা। কিন্তু এই আমেরিকান সৈন্যদের থাকার জায়গা লাগবে। তাদের থাকার জন্যই গঙ্গা নদীর ধারে নদিয়া জেলার একটি বিশেষ জায়গা চিহ্নিত করা হলো এবং সেখানে একটি বিশাল বড় এয়ারবেস তৈরি করা হলো। সেই অঞ্চলের ৪৫টি গ্রামের সাধারণ বাসিন্দাদের সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল আমেরিকানরা। তৈরি হলো একটি নতুন এয়ারবেস এবং একটি নতুন গ্যারিসন টাউন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টের নাম অনুসারে ওই জায়গাটির নাম দেওয়া হল রুজভেল্ট টাউন ওরফে রুজভেল্ট নগর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরেও ওই জায়গাটিতে তেমন লোক থাকত না। ধীরে ধীরে রুজভেল্ট টাউন পুরো সবুজে ভরে গেল। ওই শহরের আশেপাশে তৈরি করা হল একটি নতুন রেল স্টেশন, যার নাম দেওয়া হল চাঁদমারি হল্ট স্টেশন। অত্যন্ত দূরদর্শী একজন মুখ্যমন্ত্রী এবং একজন দুর্ধর্ষ ডাক্তার ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভারতের স্বাধীনতার পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহু রিফিউজি পশ্চিমবঙ্গে চলে এলেন। কিন্তু তাদের থাকার জায়গা দেওয়া বিশাল বড় সমস্যার কাজ হয়ে দাঁড়ালো। প্রয়োজন হয়ে পড়ল নগর তৈরির। বেশ কিছু স্যাটেলাইট টাউনশিপ তৈরি করা হলো কলকাতার আশেপাশে। জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করল। তাই আরও বেশি শহর তৈরি করার প্রয়োজন পড়ল। ঠিক সেই সময় শহরের সমস্যাকে দূর করার জন্য টাউন তৈরি করা শুরু করলেন বিধানচন্দ্র রায়।

আরও পড়ুন- একচিলতে ঘরেই কেটে গেল জীবন, এনার্জিতে আশি বছরের বৃদ্ধ বিমান লজ্জায় ফেলবেন তরুণদেরও

দুর্গাপুর, সল্টলেক, শকুন্তলা পার্কের মতো একাধিক টাউন তৈরি করা হলো কলকাতার আশেপাশে বেশ কিছু জায়গায়। সেরকম ভাবেই নদিয়ার রুজভেল্ট টাউন নতুন করে তৈরি করলেন ডঃ বিধান চন্দ্র রায়। ট্রেন স্টেশন থেকে শুরু করে বাজার, সুন্দর ঘর বাড়ি, জলের ব্যবস্থা, সবকিছুই করলেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সবশেষে রুজভেল্ট টাউনের নতুন নামকরণ করলেন বিধানচন্দ্র রায় নিজেই। আর এই নামটি তিনি রাখলেন তাঁর অপূর্ণ ভালোবাসা কল্যাণীর নামে। তবে এখানে কল্যাণী নিয়ে এখনও কিছু প্রশ্ন চিহ্ন রয়ে গিয়েছে।

শোনা যায়, ডাক্তার নীলরতন সরকারের কন্যা কল্যাণীর সঙ্গে নাকি প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল বিধানচন্দ্র রায়ের। একদিন ডঃ বিধান চন্দ্র রায় নীলরতন সরকারের কাছে তাঁর মেয়ের হাত চাইতে গেলে তাঁকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন ডঃ নীলরতন সরকার। তিনি বিধান চন্দ্র রায়কে অপমান করে বলেন, তাঁর মেয়ের প্রত্যেক দিনের মেকআপের খরচও নাকি ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের মাসিক আয়ের দ্বিগুণ। এই কথা শুনে অত্যন্ত অপমানিত হয়ে সেখান থেকে চলে যান ডঃ বিধান চন্দ্র রায়। কিন্তু কখনই নিজের প্রথম ভালোবাসাকে ভুলতে পারেননি। তাই, কল্যাণী শহরের নামেই তাঁর ভালোবাসাকে অমর করে রেখে যান ডঃ বিধান চন্দ্র রায়।

যদিও কল্যাণী এবং ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের এই সম্পর্ক নিয়ে আরও অনেক ধরনের ধারণা রয়েছে। অনেকে আবার বলেন, কল্যাণী নাকি নীলরতন সরকারের মেয়েই নন। এটা শুধুমাত্র একটি নাম এবং এর সঙ্গে কোনও রকম ভালোবাসার সম্পর্কের ব্যাপার নেই। বিধানচন্দ্র রায় এ শহরটি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন বলেই নাকি তার সঙ্গে কল্যাণীর নামটি জুড়ে দেওয়া হয় অত্যন্ত ইচ্ছাকৃত ভাবেই। পুরোনো কিছু নথিপত্র ঘাঁটলে এখনও দেখা যায় বিধানচন্দ্র রায় নিজেই বলেছিলেন, কল্যাণী নামটির সঙ্গে তাঁর তেমন কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু, যদি সম্পর্ক নাই থাকে, তাহলে তিনি চিরকুমার কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে বিধানচন্দ্র রায় নিজেই একবার বলেছিলেন, তাঁর বিবাহ হয়েছে এবং তার স্ত্রী একমাত্র তাঁর কাজ।

 

তথ্যসূত্র -

  • https://www.getbengal.com/details/kalyani-the-town-that-carries-bidhan-roys-scars-of-unrequited-love

More Articles