লাইমলাইট ছাড়াই যেভাবে বিশ্বকাপের মঞ্চে ট্র্যাজিক হিরো হিসেবে থেকে গেলেন লুকা মদরিচ

Fifa World Cup : ৪০-এর দোরগোড়ায় এসেও কী ভয়ানক স্কিল লুকার, একে নায়ক না বলে উপায় কি!

একেই বোধহয় বলে নিয়তির পরিহাস। দু’জনেই এলএম টেন। দুজনেই মাঠের কাণ্ডারি। অথচ জয়ের হাসি, উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা সবটুকু জুড়ে রইলেন একজনই। আর অন্যজন? শিরোনাম থেকে মুখ লুকিয়েছেন ইতিমধ্যেই। বড় ভুল সময়ে জন্মেছেন লুকা মদরিচ (Luka Modric)। মেসির জৌলুসে তাই ‘আনসাং হিরো’ হয়েই রয়ে গেলেন শেষ বেলায়।

টানটান উত্তেজনার একটা রাত। বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। লক্ষ কোটি মানুষ জাগছে। প্রতিটা মুহূর্তের হিসেব রাখছে। কাতারের ময়দানেও উঠে আসছে একের পর এক ঝলক। ঝড় উঠছে ক্রীড়া সমালোচক মহলে। আর্জেন্টিনার দুর্বার গতিতে ঝড়ের পূর্বাভাস ছিলই। অনেকেই কালকের ম্যাচ থেকে ফিরে গিয়েছেন স্মৃতির পাতায়। মেসির গোলের দাপট, বিশ্ব রেকর্ডের হিসাব, আলভারেজ ঠিক কতটা মারাদোনা হতে পারলেন সব নিয়েই চলছে সাংবাদিক কলম। আর হবে নাই বা কেন, জয়টুকুই তো দস্তুর। দ্বিতীয়কে কে কবে মনে রেখেছে বলুন?

আরও পড়ুন - জিতল আর্জেন্টিনা, জাগল ভারত বাংলাদেশ, এই না হলে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল!

অথচ ভোলা তো সহজ নয়। ৪০-এর দোরগোড়ায় এসেও কী ভয়ানক স্কিল লুকার। পরতে পরতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছেন। ২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেও ফ্রান্সের বিপক্ষে হারতে হয়েছিল ক্রোট ফুটবলারদের। দেশকে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতানোর যে স্বপ্ন গতবার অধরা ছিল সেটুকু সম্বল করে মাঠে নেমেছিলেন লুকা। কিন্তু এবারেও ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল না। তাতে কি? ক্রোয়েশিয়ার জার্সি গায়ে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে’ যে দ্যুতি ছড়িয়েছেন মদ্রিচ তা তো ফিকে হওয়ার নয়।

বিশ্বকাপ জ্বর খুব সাংঘাতিক। মাসখানেকের ব্যারাম। ফুটবল অনুরাগীদের মধ্যে এই সময়টা জুড়ে থাকে জল্পনা আর তর্কের রেশ। আবেগও থাকে ভরপুর। পাড়ায় পাড়ায় পছন্দের দলের পতাকা, পছন্দের তারকার ছবি, একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার অদ্ভুত এক নেশা। টিভির পর্দায় পছন্দের ফুটবলারের পারফরম্যান্স নিয়ে নিত্যদিন চলে তর্জমা। কারও হাতে পোস্টার, কেউ ব্যানার হাতে, মিছিলে শামিল হন অনুরাগীরা। মেসি, রোনাল্ডো, নেইমারদের নিয়ে এহেন পাগলামি লক্ষ্য করা গেলেও এসব দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত নন মদরিচ।

তথাকথিত প্রচারের আলো থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে রেখেছেন লুকা। তিনি থেকেছেন দলের ভিত হয়ে, মাথা হওয়ার লোভ ছিল না কোনওদিনই। রোনাল্ডর সমবয়সী, মেসির থেকে বছর দুয়েকের বড় অথচ এখনও দুর্বার তাঁর গতি। বিশ্বকাপের ময়দানে তারকা হওয়ার কোন গুণটা নেই তাঁর? শেষ বেলায় এসেও মাঝমাঠে রীতিমতো ভেলকি দেখিয়েছেন লুকা। হয়ে উঠেছেন বিপক্ষের ত্রাস, দলের একের পর এক সাফল্যের সেনাপতি। অথচ থেকেছেন প্রচার বিমুখ হয়েই। লাইমলাইটের খিদে কখনওই তাড়া করেনি তাঁকে। শিরোনামে থাকার লোভটুকুও হেলায় ছেড়েছেন আজীবন।

লুকা শুধু মাঠ কামড়ে থাকতে চেয়েছেন। নিজের কৃতিত্বকে কোনওদিনই বড় করে দেখতে চাননি। দলের মধ্যে মিশে গিয়েছেন আর পাঁচটা খেলোয়াড়ের সাথেই। নিজের সবটুকু গেঁথে দিয়েছেন দলের ভিতে। মাঠের মধ্যে তিনি কেবল একজন টিম ম্যান। আর মাঠের বাইরে ছাপোষা ‘ফ্যামিলি ম্যান’। ব্যাস এটুকুতেই সন্তুষ্ট লুকা মদরিচ। তাই খেলা নিয়ে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস, বিতর্ক, সমালোচনায় কখনওই নিজেকে জড়াননি। জড়াতে পারলে হয়তো লাইমলাইটে অভাব পড়ত না ঠিকই।

কিন্তু এমন একটা সময়ে জন্মেছিলেন এই মানুষটি, যে এই আচমকা উচ্ছ্বাসে গা ভাসানোকে তাঁর মেকি মনে হয়েছে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ক্রোয়েশিয়ার চেহারাটা তাঁকে মর্মে মর্মে বিঁধেছে। সে জন্যই হয়তো মায়াবি জুতোয় পা গলিয়ে চলতে ভালবাসেন না লুকা। শিশিরে পা ভিজিয়েই তাঁর স্বস্তি। নায়ক হতে গেলে এর থেকে বেশি আর কীই বা লাগে? জয়ের মুকুট দিয়ে তো বিচার হয় না। ট্র্যাজেডিও নায়ক তৈরি করেছে বারবার। হিরোর মতো না হোক ট্র্যাজিক নায়ক হয়েও মধ্যরাতের ময়দানে লুকার উপস্থিতি ভোলা সহজ নয়।

গতবার একটা একটা করে ধাপ এগিয়ে লুকা যখন শিখরের খুব কাছে, তখনও নাম-যশ-খ্যাতির পরোয়া করেননি। আপেক্ষিক ওসবে মোহ নেই তাঁর। ছিপছিপে চেহারার একটা তরুণ ফুটবলারের মতো ধরে রেখেছেন নিজেকে। দায়িত্ব আর যত্নের মিশেলে কেবল কাজ করে গিয়েছেন। কখনও ডিব্রল, কখনও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, কখনও আবার অ্যাটাকিং মিডিও, প্রয়োজন মেনে নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন মাঠে। তাঁর মরিয়া প্রয়াস সব সময় নজর কেড়েছে। হ্যাঁ শেষ সফরে জিততে পারেননি ঠিকই, কিন্তু যে ভিত তিনি শক্ত করেছেন দলের গভীরে তা রসদ জোগাবে আগামীর ক্রোয়েশিয়াকে।

আরও পড়ুন - প্রথম বিশ্বকাপেই আগুন ঝরাচ্ছেন ২২ বছরের আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার! কে এই জুলিয়ান আলভারেজ?

গতবার রাশিয়া মনে রেখেছিল লুকার চোখের জলে ভেজা বিরহের ইতিহাস। মনে রেখেছিল ক্রোয়েশিয়াও। সেই বিরহ মুক্তির চাবিকাঠিটুকু খুঁজতে খুঁজতেই এসেছিল এবারের সেমিফাইনাল। কিন্তু না, সেই মুক্তির খোঁজ মিলল না। কেবল যন্ত্রণার স্মৃতির পুনরাবৃত্তি ঘটল মাত্র! চূড়ান্ত লড়াইয়ের এক ধাপ আগেই দাঁড়ি পড়ল লুকার মরিয়া সংগ্রামের। মেসি ম্যাজিকের দাপটে অচিরেই হারল তাঁর দাঁতে দাঁত চাপা লড়াই। অথচ এককালের বার্সেলোনায় খেলা এই মেসির বিরুদ্ধেই কত না জয়ের নজির রয়েছে মদরিচের। রিয়াল মাদ্রিদের বিশ্বস্ত সৈনিক হয়ে অজস্র ট্রফি জয় করেছেন এই মাঝমাঠের স্তম্ভ। অথচ বিশ্বকাপের ময়দানে পরিণতি বলতে ট্র্যাজিক নায়ক।

লুকা এখন বেলা ফুরিয়ে যাওয়াদের দলে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে এটাই নাকি শেষ বিশ্বকাপ ছিল তাঁর। নিজের তো বটেই, দেশের পাহাড়সমান প্রত্যাশার মহাভার কাঁধে নিয়ে কাতারে নোঙর ফেলেছিলেন লুকা। গতবারের অপ্রাপ্তিটুকু পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্যদিকে খিদে চেপে মাঠে নেমেছেন তো আরও একজন, একটা শেষ জয়ের নেশা তাঁকেও তাড়িয়ে বেরিয়েছে। তাই আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়া যখন মুখোমুখি হল সেমি-ফাইনালে, তখন একজনের আবেগকে তো স্কোয়াডে ঝড়ের মুখে পড়তেই হত। অনিবার্য ছিল সেটাই। শেষ বাঁশির শব্দে যখন মেসির দল আলোর খুব কাছে, ঠিক তখন ওই একটা শব্দেই চুরমার হল একরাশ স্বপ্ন। বিশ্বকাপের আঙিনা থেকে ঝরে পড়া তারা দলে জায়গা পেলেন মদরিচ ঠিকই, তবে সেমিফাইনাল মহাকাব্যের ট্র্যাজেডি পর্বের নায়কের শিরোপাটা পেলেন নিঃসন্দেহেই।

More Articles