তেল নয়, তাল তাল সোনা ও তামার খোঁজই কি বদলে দেবে হজরত মহম্মদের পবিত্র মদিনা!
Madina Gold Mine: বিপুল এই খনিজ সম্পদে ভর দিয়ে সৌদির খনি শিল্প বিশাল মাপের উন্নতি করবে বলেই মনে করছে আল আরাবিয়া।
সৌদি আরব। ভারত থেকে প্রচুর মানুষ যেখানে চাকরির খোঁজে যান প্রতি বছর। যান আরেকটি কারণেও। ইসলামের পবিত্র শহর মদিনা এই সৌদিতেই অবস্থিত। মক্কার পরপরই উচ্চারিত এই শহরের গুরুত্ব মোটামুটি সবাই জানেন। এবার সেই শহরেই পাওয়া গেল বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ। যাকে বলে একবারে গুপ্তধনের হদিশ। এই গুপ্তধনের জেরে দেশটার খনি শিল্পের চেহারা আমূল বদলে যেতে পারে, অন্তত এমনটাই ধারণা সৌদি সরকারের। আশা, এবার কোটি কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ আসবে সৌদিতে।
বৃহস্পতিবার সৌদি প্রেস এজেন্সি একটি টুইটে এই কথা জানিয়েছে। টুইটটিতে সৌদি জিওলজিক্যাল সার্ভেকে উদ্ধৃত করে এই আবিষ্কারের কথা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন তারা। এসজিএসের তরফ থেকে ‘সার্ভে অ্যান্ড মিনারেল এক্সপ্লোরেশন সেন্টার’-এর ভূতাত্ত্বিকেরা জানিয়েছেন, বিপুল পরিমাণে সোনা এবং তামার আকরিকের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে মদিনায়। এই দুই আকরিক দীর্ঘদিন মাটির পেটে বন্দি ছিল। হদিশ পায়নি কেউই। এই প্রথম আলোর মুখ দেখছে সেই অতুল ঐশ্বর্য।
মদিনা বা আল মদিনা বা মদিনত রসুল আল্লাহ শহরটি সৌদি আরবের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। এই শহর আদতে মরুদ্যান। পূর্বে লাভাগঠিত শক্ত পাথু্রে ভূমি, অন্য তিনদিক উঁচু হেজাজ পর্বতের শৃঙ্গমালা দিয়ে ঘেরা। মক্কা-মদিনার দূরত্ব কেবল মাত্র এই হাইফেনটুকু। বা উচ্চারণের সময় সেকেন্ডের ভগ্নাংশ। রাস্তা মাপলে অবশ্য ২৭৫ মাইল। তবে ইসলামি মতে এর স্থান মক্কার ঠিক পরেই। পৃথিবীর দ্বিতীয় পবিত্র নগরী বলে একেই মনে করে ইসলাম। মক্কা থেকে দাসেদের মুক্ত করে পালানোর পর এই নতুন নগরী তৈরি করেন নবী মহম্মদ এবং এইখানেই অবস্থিত হজরত মহম্মদের সমাধি। কাজেই এটি মুসলমানদের তীর্থক্ষেত্র। শহরের মাঝামাঝি আছে নবী মসজিদ যা নির্মাণে হাত লাগিয়ে ছিলেন স্বয়ং মহম্মদও।
আরও পড়ুন- এভারেস্টের চেয়ে খাটো, তবু আজও কেন ‘অজেয়’ কৈলাস, রহস্যে মোড়া শিব ঠাকুরের আপন দেশ!
সেই মদিনা শহরেই সোনার আকরিক পাওয়া গেছে। অন্য দিকে, ওয়াদি-আল-ফারা অঞ্চলের আল-মাদিক এলাকর চারটি জায়গায় পাওয়া গিয়েছে আকরিক তামা। যদিও এই 'বিপুল' অর্থে ঠিক কতখানি, এ বিষয় এখনও স্পষ্ট করে জানায়নি সৌদি সরকার। সৌদি জিওলজিক্যাল সার্ভে টুইটে লিখেছে, “আমাদের এই আবিষ্কারের ফলে বিশ্বের দরবারে বিনিয়োগের নতুন দরজা খুলে গিয়েছে।” আল আরাবিয়া নামে এক সৌদি সংবাদপত্রও তাদের রিপোর্টে দাবি করেছে, এই আবিষ্কারের ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাঁদের ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে সৌদিকেই গুরুত্ব দেবেন বেশি। যার ফলে দেশের অর্থনীতি অনেকটাই এগিয়ে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা। যদিও বেসরকারি নথি, তবু বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই একই আশা সৌদি সরকারেরও।
নবী স্বয়ং এই শহরের সঙ্গে জড়িত। এই শহরের অতীত পরতে পরতে বাঁচিয়ে রেখেছে সেই পবিত্র নাম। সেই শহরই এখন সৌদি প্রশাসনের আশা ভরসা হয়ে উঠেছে। তাদের দাবি, এই বিপুল পরিমাণে খনিজ সম্পদ মদিনার ম আবা আল-রাহা এবং আল-মাদিক এলাকায় খনি শিল্পে প্রচুর বিনিয়োগ টেনে আনতে চলেছে। এমনকী সরকার আশা করছে, মদিনায় ওই এলাকাগুলিতে ৫৩.৩ কোটি ডলারের দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসতে পারে। যার প্রভাবে প্রায় হাজার চারেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে আর তেলের উপর নির্ভর করতে হবে না। সৌদি আরবের তরল সোনার খ্যাতি মোটামুটি কানে পৌঁছেছে সকলেরই। মূলত তৈল এবং তৈলজাত দ্রব্যেনির্ভর সৌদির অর্থনীতি। এইবার সেই তরল সোনার সঙ্গে যুক্ত হল পাথুরে সোনার খোঁজ। ফলে খনিশিল্পে কোষাগার ভরার স্বপ্ন দেখছে সৌদি। শিল্প প্রসারের ক্ষেত্র নিয়েও রীতিমতো চিন্তা ভাবনা করছে তাঁরা। বিপুল এই খনিজ সম্পদে ভর দিয়ে সৌদির খনি শিল্প বিশাল মাপের উন্নতি করবে বলেই মনে করছে আল আরাবিয়া। এমনকী বিশ্লেষকরাও জানিয়েছেন, এই খনিশিল্পের উন্নতির জেরেই আনুষঙ্গিক যে শিল্প, পরস্পর নির্ভরশীল শিল্পগুলিও লাভবান হবে। সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, সৌদির মাটির গর্ভে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে, তার পরিমাণ নেহাৎ কম না। জানুয়ারিতে সে দেশের জিওলজিস্ট কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল আজিজ বিন লাবন জানিয়েছেন, সৌদির বিভিন্ন অঞ্চলে ৫৩০০ টিরও বেশি খনিজ সম্পদের খোঁজ পাওয়া সম্ভব। লাবনের দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ বলছে, আকরিক সোনা বা তামা ছাড়াও সৌদিতে বিভিন্ন ধরনের ধাতু এবং অধাতব শিলা, আলংকারিক শিলা এব রত্ন পাথর রয়েছে। শুধু তাই না, একই সঙ্গে নির্মাণ শিল্পে ব্যবহার করা হয়, এমন নানা ধরনের সামগ্রীও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ দেশে।
আরও পড়ুন- হিজাবের আগুনে পুড়ছে ইরান! কেমন ছিল ইরানের মহিলাদের অতীত
তৈল এবং তৈলজাত দ্রব্যের উপর নির্ভরতার চক্রবূহ্য থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে ‘ভিশন ২০৩০’ নামে একটি পরিকল্পনাও নিয়েছেন সৌদির যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন। এমনকি তৈল-নির্ভর অর্থনীতির পরিচিতি থেকেও মুক্ত হতে চাইছেন তাঁরা। ২০২২ সালের জুন মাসে আরাবিয়ায় একটা সাক্ষাৎকারে সেই পরিকল্পনার নানান উদ্দেশ্য নিয়ে খোলামেলা বক্তব্য রেখেছিলেন যুবরাজ। তাঁর দাবি, ‘ভিশন ২০৩০’ রূপায়ণের অঙ্গ হিসাবে শুধুমাত্র খনি শিল্পেই ৩.২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করে রেখেছে সৌদি সরকার। ইতিমধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ টানতে নেমে পড়েছে সৌদির শিল্প এবং খনিজ সম্পদের মন্ত্রক। শুধু পরিচিতি ভাঙাই নয়, ‘ভিশন ২০৩০’ নতুন সম্ভাবনা খুঁজে দেখার এক মাধ্যমও।
সরকারের লক্ষ্য, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো, পর্যটন—ইত্যাদি নানান ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ টানার সম্ভাবনা রয়েছে। যার থেকে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক লাভ করতে পারে সরকার। সৌদি অর্থনীতির আপাদমস্তক বদলে দিতে এইসব বিনিয়োগ আসাটা অত্যন্ত জরুরি। সৌদি আরবের যে রক্ষণশীল ভাবমূর্তি গোটা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত, এবার তাতেও আঘাত হানতে চলেছেন যুবরাজ। দেশের অর্থনীতির উন্নতির তাগিদে সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ সামরিক রসদ এবং অস্ত্রশস্ত্র কেনার খরচ কমিয়ে সেই টাকা শিল্পক্ষেত্রে ঢালতে চাইছে তারা। সামগ্রিক ভাবে শিল্পের উন্নতির এই পরিকল্পনা বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রটিতে নিরাপত্তার বোধ দেবে বলেই মনে করছে সৌদি সরকার।