সৌজন্য না কৌশল? যে কারণে মোদি-বিরোধিতার সুর নরম করছেন মমতা
Mamata-Modi: মোদির সঙ্গে মমতার সুসম্পর্ক এবং সৌজন্যের আবহ আসলে কৌশলী মমতার কোনও নয়া 'পলিটিক্যাল ট্রিক'?
রাজনীতিতে সৌজন্য! আবার সৌজন্যের রাজনীতি! না কি এই সৌজন্যের অন্দরেও লুকিয়ে থাকে অন্য কোনও কৌশল? সমসাময়িক দেশীয় প্রেক্ষাপট তো বটেই, বরাবর রাজনীতির তীব্র টানাপোড়েনে যুগ-যুগান্ত ধরে আবর্তিত হয় এই প্রসঙ্গই। বারবার উঠে আসে হানাহানি, বিক্ষোভ-আন্দোলন আর তার আবহে সৌজন্যের দিননামচার কথা। সেখানেই মনে করায় সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া রাজনৈতিক ছবির আবহ। 'রাজনীতিতে স্থায়ী শত্রু কেউ নন, আজকের প্রতিপক্ষ রাত পোহালেই হতে পারেন কাছের,' এ কথার চিরন্তন সত্য যাপিত হয় অনবরত।
কিন্তু সমস্ত রাজনৈতিক যাপনের মধ্যেই বর্তমান বঙ্গের সৌজন্য আঙিনায় একটি বিষয় বারবার ভাবিয়ে তুলছে কাউকে কাউকে। একটি সম্পর্ক এবং তার সামগ্রিক বিচরণে ফের প্রশ্নের আবহ সৃষ্টি হচ্ছে, রাজনৈতিক মহলের একাংশের মধ্যে। কী? তা হলো সমসাময়িক বঙ্গের বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসক দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেপি এবং 'রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ' ছাড়িয়ে, নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে নরম মনোভাব! যা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা আর টানাপড়েনের আবহে ফের উত্তাল বঙ্গের রাজনীতি। লোকসভা নির্বাচনের আগে একই বিষয়ে আলোচনায় পিছিয়ে নেই দিল্লির অলিন্দও। কেন কী করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
সম্প্রতি, রাজ্য বিধানসভায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সি অর্থাৎ সিবিআই, ইডি-র মতো সংস্থার অতি সক্রিয়তা নিয়ে বিরুদ্ধ-প্রস্তাব পাস হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপি নেতা-রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা মমতার 'প্রাক্তন সৈনিক'কে আক্রমণ করলেও, ওই দিন বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''আমি বিশ্বাস করি না, নরেন্দ্র মোদি এগুলো করেছেন। এটি করেছেন বিজেপি-র নেতারা। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রণ অমিত শাহের মন্ত্রকের হাতে, মোদির নিয়ন্ত্রণে নয়।'' মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পরই আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে, 'মোদি ভাল বিজেপি খারাপ' ইস্যু। কেউ কেউ তুলে আনছেন, পুরনো ইতিহাস। কারণ?
আরও পড়ুন: নন্দীগ্রামে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’, কেন মমতার মুখে ঘুরেফিরে সেই একই কথা
সম্প্রতি 'নীতি আয়োগ'-এর বৈঠকে যোগ দিতে দিল্লি যান মমতা, সঙ্গে ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। একান্তে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসেন মমতা। রাজ্যের বকেয়া মেটানোর দাবিতে বৈঠক বলা হলেও রাজ্যে মমতা-বিরোধী সিপিআইএম দাবি করে, নিয়োগ-দুর্নীতি আর কয়লা, গরুপাচার-সহ একাধিক 'পাপ ঢাকতে' মোদির সঙ্গে 'সেটিং' করতে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাল্টা সরব হয় তৃণমূল। এই উত্তেজনার মধ্যেই গত ৩১ অগাস্ট বিকেলে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য এবং কলকাতা পুলিশের জন্য একাধিক ঘোষণা করার সঙ্গেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিরোধী দলের নেতাদের আক্রমণ এবং গণমাধ্যমের ভূমিকায় উষ্মা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, "একটা করে লোক গিয়ে আরএসএসের নাম করে থাকছে (সংবাদমাধ্যমে)। আরএসএস এত খারাপ বলে আমি বিশ্বাস করি না, এখনও ওঁদের মধ্যে কিছু ভদ্রলোক আছেন, যাঁরা বিজেপিকে ওইভাবে সমর্থন করেন না!"
মোদী-মমতা 'সেটিং তত্ত্বে'র মধ্যেই আগুনে ঘিয়ের কাজ করে মমতার ওই আরএসএস-মন্তব্য। এদিকে ঠিক এর আগেই মমতার পশ্চিম মেদিনীপুর সফর, এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত প্রসঙ্গে তাঁর ভূমিকা নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। মোদিকে উপহার দেওয়া নিয়েও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুরু হয় জল্পনা। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি ফের আরএসএসের প্রতি নরম মনোভাব দেখাচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী? আবার কি 'পুরনো বন্ধু' বিজেপি নিয়ে জল্পনা বাড়িয়ে দিচ্ছেন মমতা নিজেই? এই প্রসঙ্গেই উঠে আসে মমতার আরএসএস-বিজেপি ইতিহাসও। যা সামগ্রিকভাবে স্পষ্ট করে মমতা এবং মোদী তথা বিজেপি-তৃণমূলের সম্পর্ক-আলোচনার গতিপথ।
রাজনৈতিক মহলের একাংশের ব্যাখ্যা, ১৯৯৮ সালে মমতার নেতৃত্বে বাংলার কংগ্রেস ভেঙে, তৃণমূল প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মধ্যেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এনডিএ জোটে যোগ দেয় তৃণমূল। তৎকালীন অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারে প্রবেশ ঘটে মমতার। এনডিএ সরকারের অন্যতম সহযোগী এবং কালীঘাটে আসা অটলবিহারী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ-বৃত্তের সুবাদে সরাসরি রেল মন্ত্রকের দায়িত্ব পান তিনি। এর সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয় তাঁর। নাথুরাম গডসের সমর্থক, সংগঠনের কর্মীরা যে আসল 'দেশপ্রেমিক', এমন মন্তব্যও ওই সময়কালে করে ফেলেন মমতা। ২০০৩ সালের এই মন্তব্য শুধু নয়, অন্যতম একটি পত্রিকা আরএসএস-ঘনিষ্ঠ 'পাঞ্চজন্য'-র সম্পাদক তরুণ বিজয়ের সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশিত হয়। দেশপ্রেমিক আরএসএস-এর সাহায্য বাংলার কমিউনিস্ট সন্ত্রাসবাদের নির্মূলে যে কাজে লাগবে তাও বলা হয় তাঁর তরফে! এমনকি, একটি জায়গায় বলা হয়, আরএসএস-মনোভাবাপন্ন জনতার মাত্র ১ শতাংশ ভোটও তৎকালীন বাম সরকারের পতনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে! এখানেই বিজেপি এবং মমতা সম্পর্ক কঠিন হয় আবার। এদিকে ২০০০ সালের রেল বাজেট এবং রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিন পরেই রাজ্যের জন্য একাধিক প্রকল্প আনেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে মোহভঙ্গ ঘটে শীঘ্রই! ২০০০ সালের রেল বাজেট পেশের কিছু দিন পরেই অজিত পাঁজা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পদত্যাগ করেন বাজপেয়ী সরকার থেকে। পরে আবার ফিরিয়ে নেন সেই পদত্যাগপত্র।
এরপরেই সামনে আসে 'তহেলকা কাণ্ড'। সংসদে সরব হন মমতা। এই দুর্নীতির জেরেই ২০০১ সালে এনডিএ সরকার থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। ওই বছরে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে দুর্নীতি-বিরোধী মুখ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেও সফল হননি মমতা! ফের ২০০৩-এর সেপ্টেম্বরে দফতরবিহীন মন্ত্রীত্ব সমেত মমতা ফেরেন অটলবিহারী সরকারে। ফের যোগ দেন বন্ধুদলে। পরবর্তীতে কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্ব পান তিনি। তারপরে ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচন। তথাগত রায়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে ২৯-১৩ নীতিতে রাজ্যে লড়াই করেন মমতা। ১৯৯৮, ১৯৯৯ সালে তপন শিকদারের এই রাজ্য থেকে সাংসদ হিসেবে জয়লাভ। মন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড থাকলেও এই বছর বিপর্যস্ত হন মমতা, রাজ্য বিজেপি। একটি আসনে শুধুমাত্র জেতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও ২০০১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জোট বেঁধে উল্লেখযোগ্য ফল করেন মমতা। ৫০-এর বেশি আসনে যেতে এনডিএ জোট। ফের ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জোট বেঁধে লড়াই। মাত্র ৩০ আসনে প্রথমে জয়লাভ, পরে উপনির্বাচনে ৪ আসনে জেতে তৃণমূল কংগ্রেস। বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়ার আনুষ্ঠানিক ইতি ধরা হয় এই বছরের পর থেকেই।
তারপর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব। মমতার রাজনৈতিক অবস্থান বদল। কংগ্রেস, ইউপিএ সরকারে যোগ। মন্ত্রীত্ব। মমতা-অটল সম্পর্কের মতোই, বিজেপি-আরএসএস-এর প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল কংগ্রেস-এর রাজনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান, তা-ও প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। প্রশ্ন আর উঠেছে অভিযোগও। আর এখানেই ফের উঠে আসছে মমতা আর নরেন্দ্র মোদীর নবতম সম্পর্কের কথা। যেখানে প্রাসঙ্গিক হচ্ছে আরএসএস-মমতা প্রসঙ্গও। ২০০৩-এর সময়কাল শুধু নয়, মমতা এই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার পর ২০১২ সালেও প্রশংসা এসেছে আরএসএস-এর মুখপাত্র 'পাঞ্চজন্য'-র তরফে। মমতাকে সংঘের নেতাদের পক্ষে 'মা দুর্গা'র সঙ্গেও তুলনা করা হয়ছে। ওই মুখপাত্রে বলা হয়, "দেশ মমতার মতো এক ডজন নেতা পাক, যিনি নিজের স্বার্থবর্জন করে টাকাহীন রাজনীতি করেছেন।" এমনকি, ভোট-পরবর্তী হিংসা এবং বিজেপি নেতাদের রোজকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আরএসএস প্রধানের তরফে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বয়ান আসে, যেখানে রাজ্য সরকারের সূক্ষ্ম সমালোচনা করা হয় মমতার নাম না নিয়েই। তা নিয়েও তৈরি হয় বিতর্ক! এদিকে আরএসএস ঘনিষ্ঠ পত্রিকায় মোদী আর মমতার 'কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের লক্ষ্য' নিয়েও তুলনা করা হয়। এখানেই মোদী, বিজেপি এবং মমতা নিয়ে অভিযোগ স্পষ্ট হয় ফের।
যদিও একদা অটলবিহারী-ক্যাম্পের কাছের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছেন ক্রমশ! কট্টর হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-ঘেঁষা বিজেপির বিপরীত পথে হেঁটে ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। রাজ্যে বিপুল জনসমর্থনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে। ইতিহাসের পাতায় অনেক ঘটনা থাকলেও আজকের মমতা হয়েছেন ভিন্ন, মৌলিক। কিন্তু প্রবল বিজেপি-বিরোধিতার মধ্যেও দেশের অন্যতম মোদি-বিরোধী মুখ মমতার এমন বক্তব্য কি সত্যিই দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ তৃণমূলকে বাঁচাতে? আর এখানেই কি জোরদার হচ্ছে সেই সেটিং তত্ত্ব-ই?
এই প্রসঙ্গে ইন্সক্রিপ্ট যোগাযোগ করেছিল একাধিক রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে। বাম যুবনেতা শতরূপ ঘোষের দাবি, ''একটা সময় অটলবিহারী ভালো আদবানি খারাপ, আবার আদবানি ভালো, মোদি খারাপ, এবার নরেন্দ্র মোদি ভালো, অমিত শাহ খারাপ। এরপরে দেখবেন অমিত শাহ ভালো, যোগী আদিত্যনাথ খারাপ। এরকম চলতেই থাকবে। এটা ঘোষিত সত্য, এই ইতিহাসকে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। ১৯৯৮ সালে তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা তো ওদের হাত ধরেই। কী করে অস্বীকার করবেন, আসলে ওঁরা এই রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপরেই বাঁচেন। সেটিং তো আছেই।'' শতরূপ আরও বলেন, "আরএসএসের যা যা ঘোষিত নীতি, জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৭০ প্রত্যাহার, বাবরি মসজিদ ভেঙে মন্দির। এসবের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে কিছু বলেন? শুনবেন না তিনি এই বিষয়ে কিছু বলবেন। আসলে তিনি রাজনৈতিক দল না হলেও আরএসএসের মতো সংগঠনের প্রতি নরম। সম্পর্কও ভাল!''
যদিও এই প্রসঙ্গে ইন্সক্রিপ্ট-র প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূল নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, "নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নরম মনোভাব দেখাচ্ছেন, এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রচার। তিনিই নরেন্দ্র মোদির তীব্র রাজনৈতিক বিরোধী, যার প্রমাণ আমরা রাজ্যের প্রত্যেক নির্বাচনে দেখেছি। আর বিজেপির রোজকার যে কাজ, এজেন্ডা সেটা হয়তো নরেন্দ্র মোদি জানেন না, এমন ভেবেই হয়তো অমিত শাহ-র মন্ত্রক, কেন্দ্রীয় এজেন্সির অতি সক্রিয়তা প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একথা বলতে চেয়েছেন। আর কিছু নয়। সিপিএম এসব প্রচার করছে। আসলে ওরা তৃণমূলের ক্ষতি চাইছে, পাছে বিজেপির ভালো হয়। মমতা রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হন। আর বিজেপি বেড়ে উঠুক এই রাজ্যেও, চাইছে সিপিআইএম।''
যদিও সেটিং তত্ত্ব আর মমতা-মোদি সম্পর্ক প্রসঙ্গে ইন্সক্রিপ্ট-এর প্রশ্নের উত্তরে বিজেপি নেতা শঙ্কুদেব পন্ডার দাবি, ''এসব কারা বলছেন! কেন বলেছেন! সেটিং কোথায়! নবান্নে ফিশ ফ্রাই খেতে কারা যান? আমরা তো যাই না। আর এসব বাজে কথা বলা হচ্ছে। সব রটনা। কোথাও কোনও সেটিং নেই, সবটাই বিপক্ষকে হারাতে ব্যাটিং!''
উল্লেখ্য, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে তৃণমূলের ভাঙন এবং বঙ্গ বিজেপির বাড়াবাড়ির আবহেই মমতা-মোদি দু'জনেই একে অপরকে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়ান। দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠা হয়, মমতার মোদি এবং বিজেপি-বিরোধিতার সূত্র। যা আরও বাড়ে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের সময়। নন্দীগ্রাম, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী 'কাঁটা'র মধ্যেই আগুনে বক্তব্য রাখেন মমতা, অভিষেকরা। মোদীর রাজনৈতিক বিরোধিতায়, 'কে হরিদাস পাল' থেকে 'কোমরে দড়ি পরানো' মমতা-মন্তব্যে শোরগোল পড়ে। পাল্টা সরব হয় বিজেপি। একের পর এক ইস্যুতে পদ্মর তরফে নিন্দিত হন মমতা। রাজ্যে অল আউট আক্রমণে ঝাঁপায় বিজেপি। কিন্তু এর মধ্যেই ফের প্রকাশ্যে আসে 'সেটিং তত্ত্ব', যেখানে দাবি ওঠে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদির গোপন রাজনৈতিক আঁতাত নিয়ে! কেন?
রাজনীতিক কারবারিদের একাংশের দাবি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদির প্রতি নরম, সেটিং করছেন এই অভিযোগ ওঠার পিছনে মূলত কয়েকটি কারণ রয়েছে; এক, নয়ের দশকের মমতা এবং আরএসএস সম্পর্ক, বিজেপি-প্রধান এনডিএ সরকারে মমতার দলের প্রবেশ। যা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও উসকে দেয় তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কের ইতিহাসকে। 'ধর্মনিরপেক্ষ মমতা'-র বর্তমান ভাবমূর্তিতে যা 'রাজনৈতিক কাঁটা'-র মতো। আর সেই কাঁটাকেই হাতিয়ার করছেন কেউ কেউ। যেখানে মোদি, বিজেপি বা আরএসএস নিয়ে মমতা কিছু বললেই সেই ইস্যু ছাড়ছে না বিরোধী বামেরা!
দুই, সিঙ্গুরে মমতার আন্দোলনে রতন টাটার ন্যানো গাড়ির কারখানা যায় গুজরাতে। তখন সেখানে নরেন্দ্র মোদির সরকার। ঠিক ওই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মমতার মোদির সঙ্গে সৌজন্যের সম্পর্ক নিয়ে আজও কটাক্ষ করা হয় বারবার। যেখানে মোদির রাজনীতিতে মমতা ভালো, এই বিষয়টি স্পষ্ট করার চেষ্টা করেন কেউ কেউ।
তিন, দাবি করা হয়, আসাদুদ্দিন ওয়েসির মতো মমতার দলের মোদি-বিরোধিতা আসলে জাতীয় দল কংগ্রেসের প্রধান বিরোধী-মুখ হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে, আখেরে রাজনৈতিকভাবে লাভ হচ্ছে মোদির, এবং তাঁর দলের! বিরোধী ভোট ভাঙছে, এই ক্ষেত্রে মমতার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ।
চার, সাম্প্রতিককালের বঙ্গের প্রেক্ষিতকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। দাবি, নারদা এবং সারদা কাণ্ড তৃণমূলকে অস্বস্তিতে ফেললেও সময়ের সঙ্গে তার ঝাঁঝ কমেছে! কিন্তু ফের নিয়োগ দুর্নীতি, অবৈধভাবে গরু, কয়লা পাচারে জড়িয়েছেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা। প্রায় সমস্ত ঘটনার তদন্ত করছে কেন্দ্রের তদন্তকারী সংস্থাগুলো। একের পর গ্রেফতার হচ্ছেন তৃণমূল ঘনিষ্ঠরা। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের প্রধান তথা 'দেশের নেতা' মোদির শরণে মমতার ফের বৈঠক-উদ্যোগ নিয়ে, সেটিং তত্ত্ব আরও জোরদার করেছে সিপিএম। তদন্তের হাত থেকে বাঁচতে এই কাজ করছেন মমতা, অভিযোগ করেছে বাম, কংগ্রেস। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই সেই অভিযোগকে ইন্ধন জুগিয়েছে মমতার বক্তব্য।
যদিও সমস্তটাই অভিযোগ আর দাবির দোলাচলে আবর্তিত হচ্ছে বারবার। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মোদি আর মমতার তীব্র বিরোধ আর বঙ্গ বিজেপিকে সামলাতে গিয়ে, কেন ইচ্ছাকৃত বিজেপির মুখ মোদীর প্রতি নরম মনোভাব মমতা দেখাবেন, তার সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না রাজনীতিক কারবারিদের অন্য অংশ। তাঁদের দাবি, সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন, তার পরেই লোকসভা নির্বাচন। আর ঠিক তার আগেই নানা ইস্যুতে চাপে রয়েছে তৃণমূল। এই অবস্থায় সিপিআইএম-এর সঙ্গে মূলত বিজেপি এবং শুভেন্দু অধিকারীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই জরুরি তৃণমূলের কাছে। সেখানে দাঁড়িয়ে, মোদির প্রতি সৌজন্য ছাড়া রাজনৈতিক স্বার্থে মমতা এই কৌশল নেবেন, এমনও বলা যায় না। তাই, এই অবস্থা আসলে কথার জন্য কথা বলার মতোই, বলে মত ওই অংশের।
নিজস্ব কৌশল আর পাল্টা যুক্তির আদলে মোদি-র প্রশংসা করে, দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ তৃণমূল, রাজনৈতিক শত্রু বঙ্গ বিজেপির আক্রমণ-অস্ত্র কি ভোঁতা করছে? আর তার সূচনা কি পরোক্ষভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই সৃষ্টি হচ্ছে, এই প্রশ্নের অবতারণাও করেছেন কেউ কেউ? দাবি, পুরনো ইতিহাস, মমতা-আরএসএস সম্পর্ক, মমতার 'পুরনো বন্ধু' বিজেপি, এই সমস্ত জল্পনার মধ্যেই দেশের বর্তমান নিয়ন্ত্রক নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত পোড় খাওয়া রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি, সুকৌশলে মোদির প্রতি নরম এবং বিজেপির প্রতি গরম মনোভাব ব্যক্ত করে আসলে আগামী নির্বাচনে 'মিথ্যা এবং ভুল, অপপ্রচারের বঙ্গ বিজেপি'- এই তথ্যই স্পষ্ট করার চেষ্টা করতে পারেন। যেখানে দলের নেতা না চাইলেও বঙ্গের নেতারা আর অমিত শাহর মতো নেতারা মিলে এই প্রতিহিংসামূলক কাজ করছেন, যা অসুবিধায় ফেলছে তৃণমূল-সহ বিজেপি বিরোধীদের। যেখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তাহলে কি মোদির মতের গ্রাহ্য না করেই মোদি-প্রভাবহীন দল চালাচ্ছেন অমিত শাহ, জগৎপ্রকাশ নাড্ডারা? রাজনৈতিক মহলের মতে, মমতার সামগ্রিক ভূমিকায় বিজেপির অন্দরে এই সুক্ষ্ম প্রশ্নই ছুড়ে দেওয়া গিয়েছে ফের। যেখানে সেটিং তত্ত্বে-র মধ্যেই বিজেপির কোন্দল আর দলের প্রধানের দলীয় মতে, নীতিতে 'সিটিং' নিয়েও সন্দেহের আবহ তৈরি করে দিয়েছেন মমতা! যা আপাতভাবে সাধারণ মনে হলেও আগামী নির্বাচনের আগে, ভোটের রাজনীতিতে বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। যা পুরনো স্মৃতি আর দুর্নীতি থেকে বাঁচতে মোদি-শরণের বাম-অভিযোগের পাশাপাশি মোদির সঙ্গে মমতার সুসম্পর্ক এবং সৌজন্যের আবহে আসলে কৌশলী মমতার কোনও নয়া 'পলিটিক্যাল ট্রিক', বলছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।