পুরনো বন্ধু আরএসএস-এর প্রশংসা হঠাৎ কেন করছেন মমতা?
আরএসএস প্রশংসার মাধ্যমে বঙ্গ বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-র চোরা অন্তর্বিবাদ খুঁচিয়ে দিলেন, পোড় খাওয়া রাজনীতিক মমতা?
রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ পোড় খাওয়া রাজনীতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! রাজনীতি নিয়েই এবার আক্ষেপ মমতার গলায়! কিন্তু এই আক্ষেপের মধ্যেই ফের তৃণমূল সুপ্রিমো উসকে দিলেন তাঁর আরএসএস-স্মৃতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যে ঝরে পড়ল পুরনো বন্ধু আরএসএস-এর প্রতি এক অমোঘ টান! নাকি মুখ ফসকেই প্রশংসা করে ফেললেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ অর্থাৎ আরএসএস-এর! না কি আরএসএস প্রশংসার মাধ্যমে বঙ্গ বিজেপি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-র চোরা অন্তর্বিবাদ খুঁচিয়ে দিলেন, পোড় খাওয়া রাজনীতিক মমতা!
৩১ অগাস্ট বিকেলে নবান্নের সাংবাদিক বৈঠক আর যা যা গুরুত্ব ধারণ করল, তার তুলনায় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের আরএসএস-বক্তব্যই হয়ে দাঁড়াল আলোচনার বিষয়বস্তু। কেন? এই দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য এবং কলকাতা পুলিশের জন্য একাধিক ঘোষণা, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বিরোধী নেতাদের আক্রমণ এবং গণমাধ্যমের ভূমিকায় উষ্মা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, "একটা করে লোক গিয়ে আরএসএসের নাম করে থাকছে (সংবাদমাধ্যমে)। আরএসএস এত খারাপ বলে আমি বিশ্বাস করি না, এখনও ওঁদের মধ্যে কিছু ভদ্রলোক আছেন, যাঁরা বিজেপিকে ওইভাবে সমর্থন করেন না!"
কয়েক সেকেন্ডের এই মন্তব্যই ফিরিয়ে এনেছে পুরনো বিতর্ক। মমতার সঙ্গে বিজেপি এবং আরএসএসের 'আঁতাঁত' নিয়ে সরব হয়েছে সিপিএম। বিতর্ক উসকে দিয়েছে বিজেমূল-তত্ত্ব নিয়েও। ঠিক কী নিয়ে বিতর্ক! মমতার এই হালকা ছলে আরএসএস-প্রশংসা কি আসলে কোনও নয়া জল্পনা উসকে দিল?
আরও পড়ুন: বদলে যাচ্ছেন মমতা! এবার কি বদলাচ্ছে তাঁর রাজনৈতিক লাইন?
সাম্প্রতিক সময়ে, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রের সরকার এবং সেই সরকারের কাজকর্ম নিয়ে মাঝে মাঝেই চাপা অসন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের নেতৃত্ব। আরএসএসের বর্তমান প্রধান মোহন ভাগবত এবং বিজেপির বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের যে খুব ভালো সম্পর্ক, তা হলফ করে বলতে চাইবেন না কেউই! ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আরএসএস, বিজেপি-র মূল দলের কোনও শাখা সংগঠন না হলেও ভারতীয় জনতা দলের যে কোনও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে অচিরেই ভূমিকা পালন করে। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিজেপি শীর্ষ নেতাদের একাংশ এবং আরএসএস নেতৃত্বের একটা ঠান্ডা লড়াই রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ চওড়া করার চেষ্টা করলেন, রাজনৈতিক কৌশলে ছোট্ট এক চাল দিলেন, না কি অন্য কোনও জল্পনা!
এইসব প্রশ্নের অবতারণার স্তিমিত আবহেই চড়া হচ্ছে মমতা এবং আরএসএসের সম্পর্কের ইতিহাস। যে বিতর্ক, যে সংযোগ মমতা এবং তাঁর তৈরি দল তৃণমূলের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে এক কঠিন 'কাঁটা' বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের। কেন?
ইতিহাসের অবতারণার আগে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা ধরা যাক। যা প্রকাশ্যে আসতেই মমতার আরএসএস-প্রীতির অভিযোগ সামনে আসে আবার। সরব হয় রাজ্যের বাম নেতারা। যেখানে দেখা যায়, গত মে মাসে প্রায় একই সময়ে পশ্চিম মেদিনীপুর সফরে গিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ওই জেলারই কেশিয়ারি এলাকায় রয়েছেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাগবতের থাকার খবর পেয়ে তাঁর জন্য সমস্ত ব্যবস্থা এবং এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে কোশিয়ারির আইসি-কে বিশেষ নির্দেশ দেন বলে খবর রটে! এমনকী, তাঁকে ফুল-মিষ্টি পাঠান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে ঘটনার পরেই সরব হয় বঙ্গের সিপিএম। মমতা-আরএসএস-এর সম্পর্ক নিয়ে আক্রমণ শানান সুজন চক্রবর্তী, শতরূপ ঘোষরা।
এই ঘটনার আবহেই ফের তৈরি হয় বিতর্ক। সত্যিই কি মমতা আর আরএসএস-এর সম্পর্ক মধুর? রাজনৈতিকভাবে পরস্পরের কাছের? একাধিক প্রশ্নের আবহেই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন সেই ইতিহাস। ১৯৯৮ সাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াকু নেতৃত্বে সবেমাত্র রুখে দাঁড়াচ্ছে মুকুল রায়-সহযোগে গঠিত হওয়া মমতার নব্য তৃণমূল। তীব্র বামশক্তির সামনে কার্যত রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, একাকী মমতা। সোমেন মিত্রর কংগ্রেসের সঙ্গে তখন আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক প্রাক্তন কংগ্রেস নেত্রীর। বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন মমতা, এই প্রচার চালাচ্ছে বঙ্গের কংগ্রেস। একদা পিভি নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভার সদস্য মমতার বিরুদ্ধেও প্রচার তখন তুঙ্গে। হাল ধরতে রাজনৈতিকভাবে বিপরীতমুখী হলেন মমতা। প্রাক্তন কংগ্রেস নেত্রীর গঠিত নতুন দল তৃণমূল মাত্র এক বছরের মধ্যেই যোগ দিল অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারে। এনডিএ সরকারের অন্যতম সহযোগী এবং কালীঘাটে আসা অটলবিহারী বাজপেয়ীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের সুবাদে সরাসরি রেলমন্ত্রকের দায়িত্ব পেলেন মমতা। এর সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সঙ্গে সুসম্পর্ক হয়েছে তাঁর। নাথুরাম গডসের সমর্থক, সংগঠনের কর্মীরা যে আসল 'দেশপ্রেমিক', এমন মন্তব্যও ওই সময়কালে করে ফেলেছেন তিনি। ২০০৩ সালের এই মন্তব্য শুধু নয়, অন্যতম পত্রিকা আরএসএস-ঘনিষ্ঠ 'পাঞ্চজন্য'-র সম্পাদক তরুণ বিজয়ের সম্পাদনায় একটি বই প্রকাশিত হয়। দেশপ্রেমিক আরএসএস-এর সাহায্য বঙ্গের কমিউনিস্ট সন্ত্রাসবাদের নির্মূলে যে কাজে লাগবে তাও বলা হয়। এমনকী, একটি জায়গায় বলা হয়, আরএসএস-মনোভাবাপন্ন জনতার মাত্র ১ শতাংশ ভোটও তৎকালীন বাম সরকারের পতনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে! আরএসএস-সম্পর্কিত এই ভাবনা মমতার সংঘের সঙ্গে সম্পর্কের বিতর্ক উসকে দেয় আজও।
এদিকে ২০০০ সালের রেল বাজেট এবং রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরেই রাজ্যের জন্য একাধিক প্রকল্প আনেন মমতা। মোহভঙ্গ ঘটে শীঘ্রই! ২০০০ সালের রেল বাজেট পেশের কিছুদিন পরেই অজিত পাঁজা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পদত্যাগ করেন। পরে আবার ফিরিয়ে নেন সেই পদত্যাগপত্র।
এবার সামনে আসে 'তহেলকা কাণ্ড'। সংসদে সরব মমতা এই দুর্নীতির জেরেই ২০০১ সালে এনডিএ সরকার থেকে বেরিয়ে আসেন। ওই বছরের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে দুর্নীতি-বিরোধী মুখ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেও সফল হননি মমতা। ফের ২০০৩-এর সেপ্টেম্বরে দফতরবিহীন মন্ত্রীত্বসমেত মমতা ফেরেন অটল-সরকারে। পরবর্তীতে কয়লা মন্ত্রকের দায়িত্ব পান তিনি। তারপরে ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচন। তথাগত রায়ের নেতৃত্বাধীন বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে ২৯-১৩ ফরমুলায় লড়াই করেন মমতা। ১৯৯৮, ১৯৯৯ সালে তপন শিকদারের এই রাজ্য থেকে সাংসদ হিসেবে জয়লাভ। মন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড থাকলেও এই বছর বিপর্যস্ত হন মমতা আর রাজ্য বিজেপি। একটি আসনে শুধুমাত্র জেতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও ২০০১ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে জোট বেঁধে উল্লেখযোগ্য ফল করেন মমতা। ৫০-এর বেশি আসনে যেতে এনডিএ জোট। ফের ২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জোট বেঁধে লড়াই। মাত্র ৩০ আসনে প্রথমে জয়লাভ পরে উপনির্বাচনে ৪ আসনে যেতে তৃণমূল। বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধে লড়ার আনুষ্ঠানিক ইতি ধরা হয় এই বছরের পর থেকেই।
তারপর সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পর্ব। মমতার রাজনৈতিক অবস্থান বদল। কংগ্রেস, ইউপিএ যোগ। মন্ত্রীত্ব। যদিও ২০০৬ বা ২০০১-পূর্ববর্তী সময়ে মমতা সম্পর্কে আরএসএস-এর মত, তাদের একাধিক মুখপাত্রের বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ শুধু নয়, যার আবহ ছড়িয়েছে সাম্প্রতিককালেও। যেখানে মমতা-অটল সম্পর্কের মতোই, বিজেপি-আরএসএস-এর প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূল কংগ্রেস-এর রাজনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান, তা প্রতিফলিত হয়েছে বারবার। যেখানে ২০০৩-এর সময়কাল শুধু নয়, মমতা এই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার পর ২০১২ সালেও প্রশংসা এসেছে আরএসএস-এর এক মুখপাত্র 'পাঞ্চজন্য'-র তরফে। মমতাকে সংঘের নেতাদের পক্ষে মা দুর্গার সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে। ওই মুখপাত্রে বলা হয়, "দেশ মমতার মতো একডজন নেতা পাক, যিনি নিজের স্বার্থ বর্জন করে টাকাহীন রাজনীতি করেছেন।" এমনকী, ভোট-পরবর্তী হিংসা এবং বিজেপি নেতাদের রোজকার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আরএসএস প্রধানের তরফে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বয়ান আসে, যেখানে রাজ্য সরকারের সূক্ষ্ম সমালোচনা করা হয় মমতার নাম না নিয়েই। তা নিয়েও তৈরি হয় বিতর্ক! আরএসএস এবং মমতার সম্পর্ক প্রসঙ্গে 'ইন্ডিয়া টুডে'-র একটি অনলাইন প্রতিবেদনে (২৩.০৫.২০২২), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাক্তন অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত বলেন, মমতার রাজনৈতিক জীবনে বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। আরএসএস-এর নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। তিনি জানতেন, বামেদের মতো সাংগঠনিক দলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাংগঠনিকভাবে শক্ত আরএসএস কাজে লাগতে পারে। বিষয়ের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সম্মানের দিক খানিকটা রয়েছে।"
মমতা-বিরোধী অনেকেই দাবি করেন, বঙ্গে ক্রমশ আরএসএস-এর শাখা বিস্তারে তৎকালীন তৃণমূল এবং সমকালীন তৃণমূল সরকারের ভূমিকা থাকতে পারে! যা অচিরেই ওই সংগঠনের বিস্তারে কাজে লেগেছে। এদিকে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে মোদি-রথ থামিয়ে দেওয়া মমতা সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবেদন বের করে আরএসএস-ঘনিষ্ঠ পত্রিকা 'স্বস্তিকা'। যেখানে, 'মোদি-মমতার রহস্য জোটে ফেঁসে সব দল, ভাঙন বিরোধী শিবিরে' শীর্ষক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মমতার শিল্প সম্মেলনে মোদিকে আমন্ত্রণ প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলা হয়, "মোদি-বিরোধী ১৬ দল একদিকে নেতৃত্বে কংগ্রেস। অন্যদিকে মমতা...।'' ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মোদি আর মমতার লক্ষ্য এক, দু'জনেই কংগ্রেসমুক্ত ভারত চান।
মমতা আর আরএসএস সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় গত লোকসভা নির্বাচনের আগেও। তৃণমূল নেত্রী একটি জনসভায় দাবি করেন, মুর্শিদাবাদের বহরমপুর এবং জঙ্গিপুরে আরএসএস-এর সহযোগে নির্বাচন লড়ছেন কংগ্রেস প্রার্থীরা। যেখানে জঙ্গিপুরের প্রার্থী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায় পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় আর বহরমপুরে কংগ্রেসের হয়ে লড়েন অধীররঞ্জন চৌধুরী। যদিও মমতার এই অভিযোগ উড়িয়ে পাল্টা সরব হন, অভিজিৎ-অধীর। বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেস নয়, মমতার দল জোট করেছিল, মনে করিয়ে আক্রমণ করেন রাহুল গান্ধীও। এদিকে বারবার তৃণমূল এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-র গোপন আঁতাঁত নিয়ে সরব হতে দেখা যায় অধীরকেও।
যদিও আগের ওই জোট প্রসঙ্গ রাজনৈতিক স্বার্থেই এসেছিল বলে সম্পূর্ণ বিষয়টি এক করে দেখতে নারাজ তৃণমূল কংগ্রেস। স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন জনসভায় স্পষ্ট করেন, আরএসএস-এর হিন্দুত্ব না মানার বিষয়ে। রাজনৈতিক মহলের মতে, একদা বিজেপির জোটসঙ্গী মমতা নিজের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তির গড়ে তোলার যে প্রয়াস শুরু করেছিলেন, সেই ক্ষেত্রে তিনি সম্পূর্ণ সফল। যার ফলে মমতা এবং আরএসএস-এর সম্পর্ক নিয়ে যে রটনা, তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অচিরেই জনতার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন মমতা।
যদিও কারও কারও দাবি, মমতার দিল্লি সফর এবং বিজেপির প্রবীণ নেতা, বিশেষত লালকৃষ্ণ আদবানিদের সঙ্গে দেখা করা এখনও সৌজন্য সাক্ষাতের আবহেও রাজনৈতিক জল্পনা জিইয়ে রাখে। যেখানে আদবানি প্রসঙ্গে, সমসাময়িক বিজেপিতে তিনি প্রায় নিষ্ক্রিয় হওয়ার পরে মমতাকে বলতে শোনা যায়, ব্যক্তিগতভাবে আদবানিজির জন্য খারাপ লাগছে, আমি মনে করি, ওল্ড ইজ গোল্ড! বিজেপি নেত্রী সুষমা স্বরাজের প্রশংসা যেমন করেছেন। বিপরীতে প্রবীণ যশোবন্ত সিনহা, নবীন শত্রুঘ্ন সিনহার মতো বিজেপির প্রাক্তনদের কাছে টেনেছেন মমতা। দাবি, সরাসরি বিজেপির কঠোর সমালোচনা করলেও আরএসএস-এর বিরুদ্ধে খুব একটা সরব হন না মমতা বা তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা। অনেকেই বলেন, রাজনৈতিকভাবে একদা, 'একলা দুর্বল মমতা'-র বঙ্গে শক্তিশালী উত্থান এবং ক্রমশ রাজনৈতিক ভিত শক্ত করতে বিজেপি, বিশেষত, আরএসএস-এর ভূমিকা রয়েছে। যেখানে টালির চালের ঘরে বহু সময় ধরে বৈঠকও করেছেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বিশের দশকে মমতা এবং আরএসএস নেতাদের সম্পর্ক, রাজনৈতিক সমঝোতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। কট্টর হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী সংগঠনের সাহায্যে রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের ভিত্তি আরও শক্ত হয়েছে, এমন জল্পনাও চলে মাঝে মাঝেই! একাধিক আরএসএস নেতার মুখে, প্রকাশ্যে বা গোপনে মমতার লড়াকু গতিপথের প্রশংসা শোনা যায় বারবার। এমনকী, মমতার নন্দীগ্রাম লড়াইয়ে কেন্দ্রীয় বিজেপির প্রতিনিধি দলের আগমনও ঘটে। বরাবর বিজেপি-বিরোধী বাম সাম্রাজ্যের পতনে মমতার ভূমিকা, প্রশংসা-সহ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-র অন্দরেও। যাঁদের অনুষ্ঠানে কংগ্রেসের অন্যতম প্রাক্তন নেতা তথা দেশের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোাধ্যায়ের উপস্থিতিও পরিলক্ষিত হয়েছে।
যদিও সে-কালের আর এ-কালের মমতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতে রাজনীতির গতিপথ বদলে যায় নিরন্তর। সকলেই খুঁজে নেন নতুন নতুন পন্থা। কৌশল। সেই প্রেক্ষাপটে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমসাময়িক যা যা কৌশল তাঁকে নিতে হয়েছে, তাই-ই নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন সময় বদলেছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন মমতা। বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করেছে তাঁর নীতি, আদর্শ। সেখানে দাঁড়িয়ে পুরনো কাসুন্দি আর মমতার আরএসএস-প্রীতির ঢাক বাজিয়ে সমালোচনা অপ্রাসঙ্গিক বলেই মত, রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশের। কিন্তু বিপরীতপন্থীদের দাবি, কাঁটা ঘা থাকলে তাতে তো নুনের ছিটেও লাগবে!

Whatsapp
