মমতাই শাসক, মমতাই বিরোধী! রাজ্যে শুভেন্দু-সেলিমদের ভূমিকা কতটুকু আর?

Mamata Banerjee: এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে ইস্যুর অভাব নেই কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব নেই।

২১ জুলাই তৃণমূলের শহিদ দিবসের দিকে শাসক-বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা, পর্যবেক্ষক এবং সাধারণ মানুষ সবাই তাকিয়ে থাকেন 'চমক' দেখার জন্য। ২০২৪ সালের শহিদ দিবসের সমাবেশের আগেও জল্পনা-কল্পনার অন্ত ছিল না। কাকে কাকে এই সমাবেশের মঞ্চে দেখা যেতে পারে, কে কে তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন, এই নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে ছিল। এছাড়াও, নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী বার্তা দেন দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে তা নিয়েও জল্পনা ছিল।

সেই অর্থে দেখতে গেলে এবারের সমাবেশে সমাজবাদী পার্টির অখিলেশ যাদবের উপস্থিতি ছাড়া তেমন কোনও চমক ছিল না। এবছর সদ্য একটি নির্বাচন শেষ হয়েছে, সামনে বড় নির্বাচন এই বছরে আর নেই। সুতরাং নির্বাচনকে ঘিরে নেত্রীর নতুন কোনও দিশা দেখানো বার্তা আসার সম্ভাবনাও কম ছিল। অনেকেই অবশ্য ভাবছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দু'বছর পরের বিধানসভা নির্বাচনের দিকনির্দেশ এই সভা থেকেই করে দেবেন।

পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট কোনও বার্তা না দিলেও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেন শাসক-বিরোধী দুই পক্ষেরই ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে। এটা অবশ্য খুব নতুন বিষয় নয়।

আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা একটি দলের নেত্রী হিসেবে তিনি যতটা বিপাকে থাকতে পারতেন, ততটা বিপাকে তিনি যে নেই তা লোকসভা নির্বাচনের ফলেই বোঝা গেছে। ২০১৯-এর থেকে তিনি আসন সংখ্যা বাড়িয়েছেন। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এবং খানিকটা উজ্জীবিত বাম-কংগ্রেসের প্রতিরোধ কাজেই আসেনি। বিজেপি গতবারের জেতা আসন হারিয়েছে, বামেরা খাতাই খুলতে পারেনি আর কংগ্রেস বুড়িছোঁয়া করে একটি আসনে জয় পেয়েছে।

আরও পড়ুন-ভাঙছে হাসিনা-মমতার সম্পর্ক! মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে দিল্লিকে কেন নালিশ বাংলাদেশের?

যখন রাজ্যের ক্যাবিনেট মন্ত্রী থেকে শুরু করে বিধায়ক, নেতারা জেলের ঘানি টানছেন, শিক্ষক-নিয়োগ দুর্নীতির ছবি স্পষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন, আদালতে বিপাকে পড়ছে রাজ্য সরকার, রেশন দুর্নীতির চূড়া দেখা যাচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় শাহজাহান শেখদের দাপটে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ — তখনও লোকসভা নির্বাচনে দাপটে জয় ছিনিয়ে আনছে তৃণমূল কংগ্রেস।

এটা অবশ্য নতুন কোনও বিষয়ও নয়। তৃণমূল ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতিটি নির্বাচনের আগেই দুর্নীতির অভিযোগের সামনে পড়েছে। নারদ-কাণ্ড বাদ দিলে সব দুর্নীতিরই শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষ। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কয়েকটি পকেট ছাড়া সারা রাজ্যের মানুষ সেই তৃণমূলেই আস্থা রেখেছেন। অন্যদিক থেকে দেখলে বলা যায়, বিরোধী দলগুলির উপর সেই আস্থা দেখাতে পারেনি সাধারণ মানুষ।

অনেকেই বিরোধীদের হেরে যাওয়ার পিছনে তৃণমূল সরকারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো জনপ্রিয় জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের অজুহাত দিয়ে থাকেন। মনে করে থাকেন যে, তৃণমূল সরকার এই সব দান-ধ্যানের রাজনীতি করে সাধারণ ভোটারদের 'কিনে' নিয়েছেন! কিন্তু অপরদিকে এটাও ঠিক যে, বিরোধীরা এখনও পর্যন্ত ততটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি ও বিকল্প রাস্তাও দেখাতে পারেনি যাতে তৃণমূলকে তারা ছাপিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু বিরোধীদের কাছে ইস্যুর অভাব কখনই হয়নি। অথচ একদিকে বিজেপি প্রধান বিরোধী দল হয়ে আত্মতুষ্টি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ভুগছে, অন্যদিকে বামেরা মীনাক্ষী-সৃজন-দীপ্সিতাদের মতো নতুন মুখকে তুলে এনেও মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।

একেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চরিত্র অনুযায়ী একটি দলের অনেকদিন ধরে ক্ষমতায় থাকাটা একটি রেওয়াজ হয়ে গেছে। এ রাজ্যের মানুষ খুব সহজে শাসককে পরিবর্তন করে না। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করে তারা। শাসকের থেকে বিরোধীদের কাছে বেশি কিছু পেলে তবেই তারা সরকার পরিবর্তন করে।

হয় বড় ইস্যু ও সেই ইস্যুর ভিত্তিতে বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব অথবা নিবিড় সংগঠনই বিরোধীদের ক্ষমতায় আনতে পারে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে ইস্যুর অভাব নেই কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব নেই। শুভেন্দু অধিকারী বা সুকান্ত মজুমদারেরা সেই নেতৃত্ব দিতে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ। মহম্মদ সেলিমরা তো ইতিমধ্য়েই পরীক্ষিত। ফলে মীনাক্ষীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার কথা ভাবতে পারছেন না এই রাজ্যের নির্বাচকেরা। আর সংগঠনের কথা তুললে বলতে হয়, বিজেপির সংগঠন ও সংঘ পরিবারের লোকজন তখনই চাঙ্গা হয়, যখন নরেন্দ্র মোদিকে জেতানোর নির্বাচন আসে। এবারে তো সেই সংগঠনও চাঙ্গা করতে ব্যর্থ হয়েছে মোদির দল।

এই অবস্থায় শাসক হয়েই বিরোধীদের কাজ করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে যেমন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, তিনি এই দেড় মাসে সংগঠন থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়ার মাঝে, লোকসভা নির্বাচনের পর্যালোচনা করেছেন, তেমনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই নিজের দলের দুর্বলতাগুলি চিহ্নিত করে ফেলেছেন। লোকসভা নির্বাচনের জয় তাঁদের দু'জনকে আহ্লাদিত করেনি।

একদিকে পুরসভা এলাকাগুলিতে তৃণমূলের ফল ভাল হয়নি বলে যেমন তিনি পুর এলাকার নেতৃত্বকে ধমকেছেন, তেমনই বাংলাভাষি ও অবাঙালি ভোটারদের মধ্যে 'টেনশনও' চিহ্নিত করেছেন। হকার উচ্ছেদ বা স্থানান্তরিত করার মধ্যে দিয়ে যেমন শহুরে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করেছেন, তেমনই অবাঙালি হকারদের ও নিজের দলের নেতা-কর্মীদেরও বার্তা দিয়েছেন। তৃণমূল শাসক দল হিসেবে তাদের পাশে থাকবে অথচ ভোটটি বিজেপি নিয়ে চলে যাবে, এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি।

একই বার্তা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিয়েছেন দলের কর্মী ও নেতাদের। পুরসভার কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে গেলেই যে তাঁদের দলের প্রতি কাজ শেষ হয়ে যায় না এবং বিধায়ক ও সাংসদদের জেতানোর দায়িত্বও তাঁদের উপর বর্তায় তা ঠারে ঠারে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। সেই সব নেতারা নিশ্চয়ই চিহ্নিত হয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন- দুর্নীতি, গণপিটুনি! মমতা বিরোধী হলে কী করতেন? বিজেপি-সিপিএম সব কোথায় গেল?

আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় 'বিরোধী' নেত্রীর মতোই নিজের দলের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছেন। বিরোধী দলগুলির নেতা-নেত্রীরা যে ইস্যুকে হাতিয়ার করতে পারছে না ঠিক ভাবে, সেই ইস্যুতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের দুর্নীতি নিয়ে নেতা-কর্মীদের প্রকাশ্যে সতর্ক করেছেন।

একটি অভিযোগ বিরোধীরা প্রায়শই করে থাকে যে, তৃণমূল দলটির পুরোটাই দুর্নীতিগ্রস্ত। অন্যদিকে, শাসকদলের মুখপাত্ররা দাবি করেন, তৃণমূল সরকার পরিচালিত পুলিশ-প্রশাসন কিন্তু নিজের দলের অভিযুক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় ও গ্রেফতারও করে। ঠিক কথা। কিন্তু তাঁরা কেন দলে দুর্নীতি বাড়তে দেন, তা নিয়ে খুব একটা সাফাই শোনা যায় না তৃণমূলের মুখপাত্রদের কাছে।

২০১৯ সালের নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে খুব সহজেই নিজের দলের স্থানীয় স্তরের দুর্নীতিকে সেই সময় চিহ্নিত করেছিলেন মমতা। তখন নজরুল মঞ্চে দলের সভা থেকে 'কাটমানি'-র কথা স্বীকার করে নিয়ে দলের নেতাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই চুরি করা টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। পরে প্রশান্ত কিশোরের সাজানো ছকে 'দিদিকে বলো' কর্মসূচি শুরু করে নিজের ইমেজ বদলে ২০২১-এর তরী পার করেছিলেন তিনি।

এবারেও লোকসভা নির্বাচনের ফল তেমন খারাপ না হলেও, নিজেদের ত্রুটিগুলিকে চিহ্নিত করে মাঠে নেমে পড়েছে তৃণমূল। এই ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কতদিন সংগঠন ও সরকার সামলাতে পারবেন তিনি, তা এখনই বলা যায় না। তবে অন্যদিকে, শুভেন্দু-দিলীপ-সুকান্তরা কে রাজ্য বিজেপির নেতৃত্ব দেবে এবং সাংগঠনিক কোন্দল নিয়ে যেমন ব্যস্ত তাতে তৃণমূল খানিকটা খোলা মাঠ পেয়ে গেছে। সেই খোলা মাঠে মমতা তাই এখন একাই শাসক ও একাই বিরোধীদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন রাজ্য রাজনীতিতে।

More Articles