জৈন হাওয়ালাকাণ্ডে মুক্ত নন ধনকড়, অভিযোগ খুঁচিয়ে তুলেছিলেন মমতাই...

সব জল্পনা নস্যাৎ করে বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে উপরাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করে ফের একবার চমকে দিয়েছেন মোদি-শাহরা। তাই বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা ধনখড়ের নাম ঘোষণা করতেই হইচই পড়ে যায়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে যাবতীয় জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছিল উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের সামনে বিরোধীরা প্রতিপক্ষ হিসেবে কাকে তুলে ধরবেন, জল্পনা চলছিল তা নিয়ে। তাতে শুরুতেই নাম উঠে আসে মুখতার আব্বাস নকভির। নরেন্দ্র মোদি সরকারে কার্যতই টিমটিম করে টিকে থাকা একমাত্র মুসলিম প্রতিনিধি উপরাষ্ট্রপতি পদে বসানো হচ্ছে বলে একরকম ধরেই নিয়েছিলেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। বিশেষ করে প্রাক্তন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহদের তিক্ততা যে ভাবে বেড়েছে, তাতে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাউকে পদে বসানো গেলে মোক্ষম জবাব দেওয়া যেতে পারে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল।

কিন্তু সব জল্পনা নস্যাৎ করে বাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে উপরাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করে ফের একবার চমকে দিয়েছেন মোদি-শাহরা। তাই বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা ধনখড়ের নাম ঘোষণা করতেই হইচই পড়ে যায়। জাঠ ভোটব্যাঙ্কের কথা মাথায় রেখেই ধনখড়কে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে মত দলের একাংশের। আবার কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে বাংলার সরকারের সঙ্গে যেভাবে শুরু থেকে যুঝে গিয়েছেন তিনি, তার পুরস্কারস্বরূপই উপরাষ্ট্রপতির মনোনয়ন পেলেন বলেও শোনা যাচ্ছে।

কিন্তু ধনখড় মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই প্রশ্ন উঠছে তাঁর রাজনৈতিক রাজনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপট নিয়ে। তিনদশক আগে হাওয়ালাকাণ্ডে নাম ওঠা ধনকড় দুর্নীতিকাণ্ডে ক্লিনচিট পাননি বলে অভিযোগ। সে ক্ষেত্রে উপরাষ্ট্রপতি পদ, এ যাবৎ যার সঙ্গে কিনা ব্যক্তিবিশেষের আদর্শ, নৈতিকতা জড়িয়ে থেকেছে, তার জন্য ধনখড়ের নাম কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ধনখড় যদিও ওই মামলার চার্জশিটে নাম ছিল না বলে দাবি করেছেন আগেই। কিন্তু মামলাকারীদের মধ্যে অন্যতম, হাওয়ালা যোদ্ধা তথা সাংবাদিক বিনীত নারায়ণের দাবি, ধনকড়ের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। ওই মামলায় কোনও অভিযুক্তকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।

২০১৯ সালের ৩০ জুন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধনকড়। তার পর থেকে যত সময় এগিয়েছে, বাংলার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সঙ্গে ততই সংঘাত তীব্রতর হয়েছে তাঁর। বাংলার আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক কাজকর্ম, এমনকি আদালতের বিচারাধীন বিষয় নিয়েও প্রকাশ্যে রাজ্যকে নিশানা করে যাচ্ছিলেন তিনি। সপ্তাহ খানেক আগেই একটি বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজ্যে পরিবর্তনের ডাক দেন তিনি। জানিয়ে দেন, বাংলায় পরিবর্তন এনেই ছাড়বেন তিনি।
এ ছাড়াও বিধানসভার বাজেট অধিবেশন থেকে বালি পুরসভা বিল-সহ একাধিক ইস্যুতে বার বার রাজ্যের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছেন ধনখড়। তার পাল্টা তৃণমূলের তরফে অভিযোগ ওঠে যে, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে নন, ধনখড় আসলে বাংলায় বিজেপি-র হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছেন। বাংলার রাজভবনটিকে ধনকড়ে বিজেপি-র দলীয় কার্যালয়ে পরিণত করেছেন বলেও কটাক্ষ করেন তৃণমূল নেতৃত্ব। রাজ্যপাল নন, ধনখড়কে ‘পদ্মপাল’ হিসেবেও উল্লেখ করতে দেখা যায় দলের নেতা-মন্ত্রীদের অনেককেই। সেই টানাপড়েনের মধ্যেই ২০২১-এর জুন মাসে ধনকড়ের বিরুদ্ধে কার্যত বোমা ফাটান মমতা। গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ) দুর্নীতিগ্রস্ত বলে যখন তাঁকে কাঠগড়ায় তোলেন ধনকড়, সেই সময় তিন দশক পুরনো জৈন হাওয়ালা কাণ্ডে ধনকড়ের নামও ছিল বলে দাবি করেন মমতা।

সেই সময় মমতার বক্তব্য ছিল, “রাজ্যপাল একজন আদ্যোপান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ। হাওড়ার জৈন হাওয়ালাকাণ্ডে ওঁর নাম ছিল। সেই সময়কার এক রিপোর্টার সম্পূর্ণ রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। তাতে রাজ্যপালের নাম ছিল। আদালতে গিয়ে উনি নিজের নাম সরিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু একটি রিট পিটিশন এখনও পড়ে রয়েছে। তাতে নাম রয়ে গিয়েছে এখনও। এরকম দুর্নীতিগ্রস্ত একজন মানুষকে কেন এখনও রাজ্যপাল করে রাখা হয়েছে জানি না।” মমতার এই দাবি ঘিরে তোলপাড় শুরু হয় সেই সময়। তাতে তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক করে সাফাই দিতে এগিয়ে আসেন ধনকড়।

তাঁর বক্তব্য ছিল, “আমার নাম কখনওই চার্জশিটে ছিল না। নাম ছাড়াতে আদালতেও যেতে হয়নি আমাকে।” কিন্তু হাওয়ালাকাণ্ডে নাম জড়ায়নি,রাজ্যপাল সে কথা একটি জোর দিয়ে বলতে পারেননি বলে পাল্টা দাবি করেন তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা হাইকোর্টের একটি রায়ও প্রকাশ করেন। তাতে তৎকালীন সাংসদ ধনকড়ের বিরুদ্ধে বেআইনি ভাবে বাসযোগ্য জমি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বলে দাবি করেন মহুয়া।

এর মাস খানেক বাদে দিল্লি সফরে গিয়ে সটান হাওয়ালা যোদ্ধা তথা জৈন হাওয়ালাকাণ্ডের অন্যতম মামলাকারী, সাংবাদিক বিনীত নারায়ণের সঙ্গে দেখা করেন মমতা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সঠিক দাবি করেছেন বলে সেই সময় সরব হন বিনীতও। তিনি জানান, তদন্ত চলাকালীন উদ্ধার হওয়া জৈন ভাইদের ডায়েরিতে নির্দিষ্ট করে ‘প্রাক্তন মন্ত্রী’ হিসেবে ধনখড়ের নামের উল্লেখ ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ৫ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা নেওয়ার কথা লেখা ছিল ডায়েরিতে। কেরলের বর্তমান রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদের নামের উল্লেখও ওই ডায়েরিতে পাওয়া যায় বলে দাবি করেন বিনীত। নৈতিক বোধ থেকেই দু’জনের সাংবিধানিক পদ ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুষমা স্বরাজের মন্তব্যও মেদি-শাহদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন বিনীত। তাঁর দাবি ছিল, সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, কোনও মামলায় অভিযুক্ত কাউকে সাংবিধানিক পদে রাখা উচিত নয়। সে ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নিজেদের প্রাক্তন মন্ত্রীর কথাই মানছে না বলে অভিযোগ করেন বিনীত। হাওয়ালাকাণ্ডে ধনকড়ের ভূমিকা প্রকাশ্যে আনার জন্য সেই সময় মমতাকে ধন্যবাদও জানান তিনি। শুধু আর্থিক দু্র্নীতি নয়, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিকে আর্থিক মদত জোগানোর বিষয় যেখানে জড়িত, ধনখড় দায় ঝেড়ে ফেলতে পারেন না বলে মন্তব্য করেন বিনীত।

আরও পড়ুন-আইনজীবী থেকে উপরাষ্ট্রপতি প্রার্থী- যে ভাবে ধাপে ধাপে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছেন ধনকড়

যে মামলায় ধনখড়ের জড়িত থাকা ঘিরে বিতর্ক, সেটি প্রায় তিন দশক আগের। ১৯৯১ সালে কাশ্মীরের হিজবুল মুজাহিদিন জঙ্গি আশফাক হুসেন গ্রেফতার হয়। তাতে জেরা করে হদিশ মেলে জৈন হাওয়ালাকাণ্ডের। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, হাওড়ার ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রকুমার জৈন এবং তাঁর পরিবারের হাত ঘুরে আর্থিক সাহায্য পৌঁছত হিজবুলের কাছে। আশফাকের বয়ান ধরে সুরেন্দ্র, তাঁর বাড়ি, দফতর, আত্মীয়দের ঠিকানায় তল্লাশি চালান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তাতে বিদেশি মুদ্রা, দু’টি ডায়েরি এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রের খোঁজ মেলে। ওই ডায়েরিতে একাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিক এবং সরকারি আমলাদের নামের আদ্যাক্ষরও পাওয়া যায় বলে জানা যায়। তাঁদের কাছ থেকেও হিজবুলে টাকা গিয়েছিল বলে দাবি করেন তদন্তকারীরা। সেই নিয়ে সিবিআই-এর তরফে চার্জশিট দায়ের করা হলেও, মাঝপথে তদন্ত থেমে যায়। মামলার তদন্তকারী এক অফিসারকেই বদলি করা হয় আচমকা।

এর প্রায় দু’বছর পর ১৯৯৩ সালে জনস্বার্থ আইনে সুপ্রিম কোর্টে জৈন হাওয়ালা কাণ্ড নিয়ে রিট পিটিশন জমা পড়ে। আজও সেই মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বহু প্রভাবশালী নেতার নাম সামনে এসেছে। সুরেন্দ্রর বাড়ি থেকে উদ্ধার ডায়েরিতে ধনকড়ের নাম লেখা ছিল বলে জানা যায়। এই মামলাটি যখন সামনে আসে, সেই সময়, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাজস্থান থেকে লোকসভার সাংসদ ছিলেন ধনকড়। জনতা দলের হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতেন। এর পর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বপ্রতাপ সিংয়ের স্বল্পমেয়াদি মন্ত্রিসভায় প্রতিমন্ত্রীও হন তিনি। পরবর্তী কালে যোগ দেন বিজেপি-তে। জৈন ডায়েরিতে এলকে আডবানী বলে একটি নামও পাওয়া গিয়েছিল বলে জানা যায়। তবে ডায়েরিতে উল্লেখিত এলকে আডবানি এবং রাজনীতিক লালকৃষ্ণ আডবানি একই ব্যক্তি কিনা, স্পষ্ট হয়নি আজও। বিজেপি-র তরফে উপরাষ্ট্রপতি পদে ধনকড়ের নাম মনোনীত করার পরই হাওয়ালাকাণ্ডে তাঁর ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হলেও, বরাবরের মতো তা ফের থিতিয়ে যাবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

More Articles